দীনেশচন্দ্র সেন

দীনেশচন্দ্র সেন

বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস রচনার জগতে অন্যতম বিখ্যাত ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সেন (Dinesh Chandra Sen)। ভারতীয় উপমহাদেশের লোকসংস্কৃতি বিষয়েও তাঁর গভীর গবেষণা সর্বজনবিদিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, অধ্যাপক এবং রামতনু লাহিড়ী গবেষক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব অপরিমেয়। লোকসাহিত্যের অপর এক সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে-র মাধ্যমে দীনেশচন্দ্র সেন সংকলন করেন ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যের লোকগানগুলি। অতীতের বাঙালির লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধার করার এই প্রয়াস তাঁকে বাঙালি বোদ্ধামহলে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। ১৮৯৬ সালে প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ যেখানে বাঙালির প্রাচীন সাহিত্যধারার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন তিনি। এই বইটিরই ইংরেজি অনুবাদ ‘হিস্ট্রি অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাণ্ড লিটারেচার’ তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকীর্তি। তারপর বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস বিষয়ে তিনি লেখেন আরো কতগুলি আকর গ্রন্থ ‘বৃহৎ বঙ্গ’, ‘বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়’ ইত্যাদি। এছাড়াও ইংরেজি ভাষায় তিনি লিখেছেন অজস্র গবেষণামূলক বই যার মধ্যে ‘দ্য ফোক লিটারেচার অফ বেঙ্গল’, ‘চৈতন্য অ্যাণ্ড হিজ কম্প্যানিয়নস’, ‘দ্য বৈষ্ণব লিটারেচার অফ মিডায়েভাল বেঙ্গল’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তবে শুধুই গবেষণা-গ্রন্থ নয়, ‘তিন বন্ধু’, ‘চাকুরির বিড়ম্বনা’, ইত্যাদি উপন্যাস এবং ‘বেহুলা’, ‘সতী’, ‘ফুল্লরা’, ‘জড়ভরত’ ইত্যাদি পৌরাণিক কাহিনিও লিখেছেন দীনেশচন্দ্র সেন। তাঁর লেখা আত্মজীবনী ‘ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য’ প্রকাশ পায় ১৯২২ সালে।

১৮৬৬ সালের ৩ নভেম্বর অধুনা বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ এলাকার বগজুরি গ্রামে মামার বাড়িতে দীনেশচন্দ্র সেনের জন্ম হয়। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ঢাকা জেলার সুয়াপুর গ্রামে। তাঁর বাবা ঈশ্বরচন্দ্র সেন মানিকগঞ্জ আদালতে আইনজীবীর কাজ করতেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল রূপলতা দেবী। ভারতে প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনকারী বাঙালি হিসেবে খ্যাত হীরালাল সেন ছিলেন দীনেশচন্দ্র সেনের মামাতো ভাই এবং সম্পর্কের বিচারে আরেক বিখ্যাত বাঙালি কবি ও সাহিত্য-সমালোচক সমর সেনের ঠাকুরদাদা ছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন।

ঢাকার জগন্নাথ স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা সম্পূর্ণ করেন তিনি। ১৮৮২ সালে জগন্নাথ স্কুল থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপরে ঢাকা কলেজ থেকে এফ.এ পাশ করেন তিনি ১৮৮৫ সালে এবং ১৮৮৯ সালে ঐ কলেজ থেকেই ইংরেজি ভাষায় অনার্স সহ স্নাতক উত্তীর্ণ হন দীনেশচন্দ্র সেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

প্রথমে শ্রীহট্টের হবিগঞ্জের একটি স্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। তারপর ১৮৮৯ সালে কুমিল্লার শম্ভুনাথ ইন্সটিটিউশন এবং পরে ভিক্টোরিয়া স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে আসীন ছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় থেকেই হেঁটে হেঁটে বহু স্থানে ঘুরে ঘুরে পল্লী বাংলার লোকসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে বহু পুঁথি আবিষ্কার করেন তিনি। পুঁথি সংগ্রহই তাঁর একসময়ের অন্যতম আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ১৯০৫ সালে বিনোদবিহারী কাব্যতীর্থের সহযোগিতায় দীনেশচন্দ্রের সংগৃহীত শ্রীকর নন্দীর লেখা ‘ছুটিখানের মহাভারত’-এর পুঁথি এবং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সহায়তায় মানিক গাঙ্গুলীর লেখা ‘শ্রীধর্মমঙ্গল’ পুঁথি দুটি প্রথম প্রকাশ করেন। ১৮৯৬ সালে দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর সংগৃহীত পুঁথির ভিত্তিতে লিখে ফেলেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকর গ্রন্থ ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’। তার অনেক পরে ১৯১১ সালে প্রকাশ পায় দীনেশচন্দ্রের লেখা ‘হিস্ট্রি অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচার’। ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ বইটিই তাঁর গবেষক হিসেবে অমর কীর্তি যাকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী স্বয়ং বাঙালির সাহিত্যিক ঐতিহ্যের আবিষ্কার বলে বর্ণনা করেছেন। শোনা যায় যে কলকাতার মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশনে শিক্ষকতা করতে চাইলেও বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে ‘বাঙাল’ বলে বিদ্রূপ ও উপহাসের পাত্র হন তিনি, এমনকি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও নিছক বাঙাল হওয়ার কারণে তাঁর সঙ্গে কোনোরূপ সাহিত্য-আলোচনায় বসতে সম্মত হননি। প্রাচীন বাংলার নিরক্ষর মানুষেরাও যে কি অনবদ্য ভঙ্গিতে লোকসাহিত্য রচনা করে গিয়েছে, তা খুঁজে খুঁজে বের করে আনাই দীনেশচন্দ্র সেনের লক্ষ্য ছিল। ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলো’ নির্বাচিত হন তিনি এবং এই সময়েই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-কর্মের অঙ্গ হিসেবে তিনি সংগ্রহ করেন ময়মনসিংহ গীতিকার গানগুলি। এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রীডার’ পদে কর্মরত ছিলেন তিনি। ১৯২০ সালে তিনি লেখেন ‘দ্য ফোক লিটারেচার অফ বেঙ্গল’ নামে একটি অসাধারণ গবেষণা-গ্রন্থ। ময়মনসিংহ গীতিকাগুলি মোট আটটি খণ্ডে দীনেশচন্দ্র সেন প্রকাশ করেন ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ ও ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ নামে। ইংরেজি ভাষায় গীতিকাগুলির অনুবাদ হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল ব্যালাডস’। ১৯২৩ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে দীনেশচন্দ্র সেন এই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাভিত্তিক সংকলন প্রকাশ করেন। চন্দ্রকুমার দে নামে এক সংগ্রাহকের লেখা ছোটো একটি প্রবন্ধ ‘মহিলা কবি চন্দ্রাবতী’ পড়ে উৎসাহিত হয়ে চন্দ্রকুমারের সহায়তায় ময়মনসিংহের গ্রামে গ্রামে, মাঠে-ঘাটে ঘুরে সব গীতিকাগুলি সংগ্রহ করে আনেন দীনেশচন্দ্র সেন। সেকালের ময়মনসিংহে ‘সৌরভ’ পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল চন্দ্রকুমার দে-র এই লেখাটি। এ যেন এক অদ্ভুত সমাপতন! তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে দীনেশচন্দ্র সেনকে ‘ডক্টরেট অফ লিটারেচার’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯২৯ সালে দীনেশচন্দ্র সেন হাওড়ায় বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের প্রধান সভাপতির পদে আসীন হন। এর ঠিক দুই বছর পরে ১৯৩১ সালে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ জগত্তারিণী স্বর্ণপদকে ভূষিত হন তিনি। দীনেশচন্দ্র সেনের লেখা আরেকটি বিখ্যাত গ্রন্থ দুই খণ্ডে সমাপ্ত ‘বৃহৎ বঙ্গ’ প্রকাশ পায় ১৯৩৫ সালে। এই গ্রন্থের ভূমিকা অংশ থেকে জানা যায় যে, ১৯১৬ সালের ১৪ অক্টোবর নাগাদ ভারতের প্রাক্তন বড়লাট লর্ড রোনাল্ডসের প্রাইভেট সেক্রেটারি আই.সি.এস ডব্লিউ. আর. গুর্‌লে দীনেশচন্দ্র সেনকে বাংলার একখানি নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রচনায় প্রবৃত্ত হতে অনুরোধ করেন। তাঁর আগে স্টুয়ার্ট রচিত বাংলার ইতিহাস বইটির অনুবাদ করেছেন গোলাম হোসেন। এছাড়া মার্শম্যান এবং বিদ্যাসাগরও একটি করে পৃথক ইতিহাস রচনা করেছিলেন। গুর্‌লে সাহেবের অনুরোধে লেখক সঙ্ঘ স্থাপিত হয় এবং তিনটি খণ্ডে পরিকল্পিত এই বাংলার ইতিহাসের দুটি খণ্ড লেখার ভার ন্যস্ত হয় দীনেশচন্দ্রের উপর। এই দুটি খন্ড একত্রে করেই প্রকাশিত হয় ‘বৃহৎ বঙ্গ’ বইটি। এই বই লেখার সময় ত্রিপুরার রাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্যের কাছ থেকে বহু মূল্যবান ছবি সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। দীর্ঘ দশ-বারো বছরের নিরলস পরিশ্রমের ফসল এই ‘বৃহৎ বঙ্গ’। রাঁচিতে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের মূল ও সাহিত্য শাখার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন, সময়টা তখন ১৯৩৬ সাল।

দীনেশচন্দ্র সেনের লেখা অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গবেষণাগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বঙ্গ-সাহিত্য পরিচয় (১৯১৪), ‘দ্য ফোক লিটারেচার অফ বেঙ্গল’ (১৯২০), ‘চৈতন্য অ্যাণ্ড হিজ কম্প্যানিয়নস’ (১৯১৭), ‘দ্য বৈষ্ণবা লিটারেচার অফ মেডিয়াভেল বেঙ্গল’ (১৯১৭), ‘দ্য বেঙ্গলি রামায়ণা’ (১৯২০) এবং ‘দ্য বেঙ্গলি প্রোস স্টাইল’ (১৯২১)। এছাড়াও বহু মৌলিক রচনার লেখক হিসেবেও দীনেশচন্দ্র সেন স্মরণীয়। যদিও তুলনায় কম চর্চিত তাঁর লেখা উপন্যাসগুলির মধ্যে ‘তিন বন্ধু’ (১৯০৪), ‘আলোকে আঁধারে’ (১৯২৫), ‘চাকুরীর বিড়ম্বনা’ (১৯২৬), ‘মামুদের শিবমন্দির’ (১৯২৮) ইত্যাদি বিখ্যাত। ‘বেহুলা’ (১৯০৭), ‘সতী’ (১৯০৭), ‘ফুল্লরা’ (১৯০৭), ‘জড়ভরত’ (১৯০৮)-এর মতো কিছু পৌরাণিক কাহিনীও লিখেছেন তিনি। বৈষ্ণবদের আরাধ্য দেব-দেবী রাধা ও কৃষ্ণকে নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘সাঁঝের ভোগ’, ‘মুক্তোচুরি’, ‘রাখালের রাজনি’, ‘রাগরঙ্গ’ ও ‘গায়ে হলুদ’ নামের কয়েকটি সুরম্য আখ্যান। দীনেশচন্দ্র সেনের আত্মজীবনী ‘ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য’ নামে ১৯২২ সালে প্রকাশ পায়।

পল্লীকবি জসীমউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। দীনেশচন্দ্র সেন নিজের উদ্যোগে জসীমউদ্দিনের লেখা ‘কবর’ কবিতাটিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিক পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং বৃদ্ধ বয়সে জসীমউদ্দিনের ‘নক্‌শী কাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থের প্রুফ সংশোধন করে দিয়েছিলেন তিনিই। মূলত আই.এ ক্লাসের ছাত্র হিসেবে জসীমউদ্দিনের সঙ্গে অধ্যাপক দীনেশচন্দ্রের সম্পর্কের নৈকট্য তৈরি হয়েছিল। আত্মজীবনীতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানসিকতার বিস্তর ফারাকের দিকটি দৃষ্টান্ত সহকারে তুলে ধরেছেন দীনেশচন্দ্র সেন। বাংলার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে খ্যাত হীরালাল সেনের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক ও কর্মসূত্রের সম্পর্কের কথাও উঠে এসেছে ঐ বইতে।

১৯৩৯ সালের ২০ নভেম্বর দীনেশচন্দ্র সেনের মৃত্যু হয়।

তথ্যসূত্র


  1.  ‘সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান’, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু,সাহিত্য সংসদ, মে ১৯৬০, ১ম সং, কলকাতা, পৃ ২০১-২০৪
  2. https://en.wikipedia.org/
  3. https://app.box.com/
  4. https://www.anandabazar.com/
  5. https://www.prohor.in/
  6. https://www.sahos24.com/
  7. https://archive.org/details/\

3 comments

আপনার মতামত জানান