কুমিল্লা

কুমিল্লা জেলা

বাংলাদেশ ৬৪টি জেলাতে বিভক্ত। বেশিরভাগ জেলাই স্বাধীনতার আগে থেকে ছিল, কিছু জেলা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গঠিত, আবার কিছু জেলা একটি মূল জেলাকে দুভাগে ভাগ করে তৈরি হয়েছে মূলত প্রশাসনিক সুবিধের কারণে। প্রতিটি জেলাই একে অন্যের থেকে যেমন ভূমিরূপে আলাদা, তেমনি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও স্বতন্ত্র। প্রতিটি জেলার এই নিজস্বতাই আজ বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছে। সেরকমই একটি জেলা হল কুমিল্লা জেলা (Comilla)।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে গোমতী নদীর তীরে অবস্থিত একটি মহানগরী হল কুমিল্লা জেলা। তাঁত শিল্প হোক কিংবা খাদি, রসমালাই কিংবা মৃৎশিল্প এই সবের জন্য সমগ্র বাংলাদেশে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে কুমিল্লা জেলা। এই জেলা পূর্বে ত্রিপুরা জেলা নামে পরিচিত ছিল৷ দেশ বিভাগের পরবর্তী সময়ে ১৯৬০ সালে এই জেলা কুমিল্লা জেলা নামে পরিচিত হয়৷

বাংলাদেশের একটি অন্যতম জেলা হল কুমিল্লা জেলা। এই জেলার উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা, দক্ষিণে ফেনী জেলা ও নোয়াখালী জেলা; পূর্ব দিকে ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশ অবস্থিত এবং পশ্চিমে চাঁদপুর জেলা, মেঘনা নদী ও মুন্সিগঞ্জ জেলা ঘিরে রয়েছে সমগ্র জেলাটিকে। এছাড়া এই জেলার উত্তর-পশ্চিমে মেঘনা নদী ও নারায়ণগঞ্জ জেলা অবস্থান করছে।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

কুমিল্লা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলির মধ্যে প্রধান নদী গোমতী। এছাড়া ডাকাতিয়া, কাঁকরী নামে আরো দুটি নদীও রয়েছে। এই জেলার অধিকাংশ অংশই আসলে প্লাবনভূমি তবে ত্রিপুরার কাছাকাছি পার্বত্যভূমিও রয়েছে। পশ্চিমে মেঘনা সমভূমি থেকে পূর্বে ত্রিপুরা পর্বতের পাদদেশ পর্যন্ত এই জেলার ঢাল পূর্ব থেকে পশ্চিমে গড়িয়েছে। এই জেলার উৎকৃষ্ট জলবায়ুর জন্য উদ্ভিদের প্রাচুর্য দেখা যায়। গাছপালার মধ্যে আম, জাম, কাঁঠাল, তেঁতুল, বেল, বট, খেজুর, নারিকেল, শিমুলতুলা, মান্দার, সুপারি, তাল, নিম, রয়না বা পিতরাজ, কদম্ব, শেওড়া, হিজল, গাব, জাম্বুরা, কুল, বন্য জামরুল, জারুল, জলপাই, আমড়া, গামার বা মেড্ডা, শাল, শিশু, ঝাউ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

কুমিল্লা জেলার মোট আয়তন ৩০৮৫.১৭ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জনসংখ্যার বিচারে কুমিল্লা জেলা সমগ্র বাংলাদেশের তৃতীয় জনবহুল জেলা। এই জেলার জনসংখ্যা সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় ৫৬,০২,৬২৫ জন।

চৈনিক পরিব্রাজক ওয়াং চোয়াঙ কর্তৃক সমতট রাজ্য পরিভ্রমণের বৃত্তান্তে ‘কিয়া-মল-ঙ্কিয়া’ (Kiamolonkia) নামক যে স্থানের বিবরণ রয়েছে সেটি থেকেই কমলাঙ্ক বা কুমিল্লার নামকরণ হয়েছে বলে পন্ডিতেরা মনে করেন। কুমিল্লা জেলার আদিনাম কমলাঙ্ক যেটির অপভ্রংশ কুমিল্লা যার অর্থ পদ্মফুলের দীঘি।

এই অঞ্চল থেকে যে সমস্ত প্রাচীন নিদর্শনাদি পাওয়া গেছে তার থেকে জানা যায়, আনুমানিক খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে ত্রিপুরা (যা পরবর্তীকালে কুমিল্লা জেলা নামে পরিচিত হয়) গুপ্ত সম্রাটদের অধীনে ছিল। নবাব সুজাউদ্দিন খানের ত্রিপুরা আক্রমণের কথা ইতিহাসে জানা যায়। ঐতিহাসিকদের মতে, সপ্তম থেকে অষ্টম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এই অঞ্চলে বৌদ্ধ দেববংশের রাজত্ব ছিল। নবম শতাব্দী থেকে হরিকেলের রাজারা কুমিল্লার শাসনভার অধিকার করে। তারপরে দশম শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত এই অঞ্চলে চন্দ্র রাজবংশের শাসন ছিল। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায় এই জেলার শাসনভার।

দেশের বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে কুমিল্লা জেলার নাম বিশেষভাবে জড়িত৷ ১৭৬৪ সালে সমশের গাজীর নেতৃত্বে ত্রিপুরার রাজাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছিল কৃষক আন্দোলন যা আজও স্মরণীয়৷ প্রিন্স ওয়ালেসের ভারত ভ্রমণের প্রতিবাদে ২১ নভেম্বর ১৯২১ সালে দেশব্যাপী ডাকা ধর্মঘটে কুমিল্লাবাসী সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিল। সেই সময় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লায় ছিলেন এবং তিনি তাঁর লেখা বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা দ্বারা জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এইসময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মহাত্মা গান্ধী কুমিল্লা ভ্রমণ করেন। আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল চাষিদের বিদ্রোহ যেটি সংগঠিত হয়েছিল চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় ১৯৩১ সালে। মোহিনী গ্রামের প্রায় চার হাজার চাষি রাজস্ব প্রদানের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ করে যাতে ব্রিটিশ গোর্খা সৈনিকদের অনবরত গুলিবর্ষণে চারজন চাষি প্রাণ হারান। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কুমিল্লার জনগণ অংশগ্রহণ করেছিল। কুমিল্লায় বেশ কয়েকটি স্থানে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল যেমন, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, লাকসাম, হোমনা, বেলতলী এবং রসুলপুর। আবার এই জেলার বেতিয়ারা, মুদাফ্‌ফরগঞ্জ নগরিপাড়া, ক্যান্টনমেন্ট, কৃষ্ণপুর, ধনঞ্জয়, দিলাবাদ ও লাকসাম বিড়ি ফ্যাক্টরিতে গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন গান্ধীজী কুমিল্লায় ‘অভয় আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন যা খাদি শিল্পের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনুশীলন চক্রের আশ্রয়স্থল হিসেবে ‘অভয় আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল৷ গান্ধিজীর ডাকে বিদেশি কাপড় বর্জন করে ব্যাপক হারে চরকায় সূতা কাটা শুরু হয়েছিল। অভয় আশ্রম তখন বাজারে চরকা বিক্রির পাশাপাশি নিজেরাও খাদি বস্ত্র তৈরি করতে থাকে এবং বিভিন্ন গ্রামে তৈরি খাদি বস্ত্রও এই সময় অভয় আশ্রমের মারফত বাজারে বিক্রি হতে শুরু করেছিল।

কুমিল্লা জেলায় ‘বাংলা’ ভাষার ব্যবহার প্রচলিত হলেও এই জেলার ভাষায় আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়৷ কুমিল্লার দাউদকান্দি, তিতাস, মেঘনা, হোমনা প্রভৃতি উপজেলার আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে সন্নিহিত ঢাকা অঞ্চলের ভাষার, চৌদ্দগ্রাম ও লাকসাম উপজেলার আঞ্চলিক ভাষায় নোয়াখালি এলাকার ভাষার অনেকটাই মিল পাওয়া যায়। এছাড়া এই জেলায় বেশ কিছু অনগ্রসর জাতি বসবাস করে যাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়৷

এই অঞ্চলে মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও হিন্দু, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষরাও এখানে সমান অধিকারে বসবাস করেন।

সমগ্র কুমিল্লা জেলা সতেরোটি উপজেলায় বিভক্ত। এছাড়া আঠারোটি থানা, আটটি পৌরসভা এবং সাতাশটি ওয়ার্ডযুক্ত একটি নগর-কর্পোরেশন রয়েছে কুমিল্লা জেলায়। এর উপজেলাগুলি হল যথাক্রমে – কুমিল্লা আদর্শ সদর, ব্রাহ্মণপাড়া, চান্দিনা, চৌদ্দগ্রাম, তিতাস, দাউদকান্তি, দেবিদ্বার, নাঙ্গলকোট, বড়ুরা, বুড়িচং, মনোহরগঞ্জ, মুরাদনগর, মেঘনা, লাকসাম, লালমাই, সদর দক্ষিণ এবং হোমনা। এই জেলার সংসদীয় আসনগুলির প্রতিটিই বাংলাদেশ আওয়ামী লিগের শাসনাধীনে রয়েছে।

কুমিল্লা জেলা ভ্রমণপিপাসু মানুষদের জন্য বটেই ইতিহাসপ্রেমী মানুষের কাছেও আকর্ষণীয়। ঐতিহ্যবাহী অতীতের স্বাক্ষর বহন করছে এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনসমূহ যেগুলির মধ্যে লালমাই ময়নামতি পাহাড়ের ধ্বংসাবশেষের মাটি খুঁড়ে প্রাচীন সভ্যতার চিহ্ন খুজেঁ পাওয়া গেছে। এই পাহাড়ের পুরাকীর্তিগুলির মধ্যে শালবন বিহার, রাণীর বাংলোর পাহাড়, রূপবান মুড়া, ইটাখোলা মুড়া, সতের রত্নমুড়া, কুটিলা মুড়া, চন্দ্রামুড়া, চন্ডীমুড়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব স্থান থেকে যে সমস্ত মূর্তি, ধাতব তৈজসপত্র ও অন্যান্য নিদর্শন পাওয়া গেছে তা বর্তমানে ময়নামতি জাদুঘরে রক্ষিত আছে। এছাড়া অন্যান্য ঐতিহাসিক নির্দশনের মধ্যে রয়েছে সপ্তরত্ন মন্দির (জগন্নাথমন্দির), সতিশালা জামে মসজিদ, শশীদলের পাঁচ পীরের মাজার, হরিমঙ্গল মাঠ, রামগর বড়মাঠ, সাইতশালা রামমোহন মন্দির, হাসনাবাদ মাঠ শাহ সুজা মসজিদ, ধর্মসাগর, চন্ডীমাতার মন্দির (বরুড়াতে লালমাই পাহাড়ের উপরে অবস্থিত), চান্দলা শিবমন্দির (ব্রাহ্মণপাড়া, অষ্টাদশ শতাব্দী), হাতিয়াভাঙ্গা দূর্গ এবং শালবন বৌদ্ধ বিহার। কুমিল্লার প্রাচীন ইতিহাসের গন্ধমাখা এসব স্থান পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

কুমিল্লা জেলা বহু বিখ্যাত মানুষের জন্মস্থান যারা বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তজার্তিক পর্যায়ে দেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন নবাব সিরাজুল ইসলাম, মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য, নবাব স্যার সামশুল হুদা, হরদয়াল নাগ, রায়বাহাদুর অমিন্দচন্দ্র রায় , বসন্ত কুমার মজুমদার, ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত, শচীন দেব বর্মন, সৈয়দ আবদুল জব্বার, এম এ আযম প্রমুখ ব্যক্তিত্ব৷ এঁরা সমাজসেবা, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন স্তরে নিজেদের ছাপ রেখে গেছেন। ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন, ফজলে নিজামি এবং ফুলেন্দু দাস কুমিল্লার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এছাড়া এলাকার বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী হলেন ডঃ আখতার হামিদ খান।

কুমিল্লা জেলার খদ্দর বা খাদি সারাদেশে বিখ্যাত। প্রাচীনকাল থেকে এখানের হস্তচালিত তাঁতশিল্প ছিল জগদ্বিখ্যাত। এই তাঁতের কাপড় বিদেশেও রপ্তানি হতো। ‘যুগী’ বা ‘দেবনাথ নামক পেশাজীবী সম্প্রদায় তাঁতশিল্পের সাথে তখন জড়িত ছিলেন। ব্রিটিশ ভারতে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে ঐতিহাসিক কারণবশত এই অঞ্চলে খাদি-শিল্প দ্রুত বিস্তার লাভের পাশাপাশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সেইসময়ে খাদি কাপড় তৈরি হতো রাঙামাটির তুলা থেকে। অসহযোগ আন্দোলনে বিদেশি বস্ত্র বর্জনে গান্ধীজির আহ্বানে সে সময় কুমিল্লায় ব্যাপক সাড়া জাগে যার পাশাপাশি খাদি বস্ত্র উৎপাদনও বেড়ে যায় এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে কুমিল্লার খাদি বস্ত্র। এই বস্ত্র অচিরেই জনপ্রিয়তা অর্জন করে কুমিল্লার খাদি হিসাবে। আবার, বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের সুখ্যাতিও নেহাত কম নয়, বাংলার লোকশিল্পের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম কুমিল্লার মৃৎশিল্প। অন্যান্য কুটির শিল্পের মধ্যে কুমিল্লার বেতের কাজ, শীতল পাটি, হুকা, মাদুর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সবশেষে এখানকার রসমালাইয়ের কথাও না বলে থাকা যায় না।

5 comments

আপনার মতামত জানান