সত্যনারায়ণ

সত্যনারায়ণ ব্রত

সত্যনারায়ণ ভগবান বিষ্ণুরই আরেক রূপ। তিনি সত্যপীর নামেও পরিচিত। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী, সত্যনারায়ণ পীরের ছদ্মবেশ ধারণ করে নিজের পূজা প্রচলন করেছিলেন। গবেষকদের মতে, বাংলার সত্যনারায়ণ বা সত্যপীর ধারণাটি হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতির সংমিশ্রণের ফল। পূর্ণিমা বা সংক্রান্তির দিন এই ব্রত পালন করা হয়। যে কেউ এই ব্রত করতে পারে। আসুন জেনে নেওয়া যাক এই ব্রতের পিছনে প্রচলিত কাহিনী।

এক গ্রামে এক বামুন বাস করত। তার সংসারে তার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ ছিল না। ভিক্ষা করাই তার জীবিকা ছিল। বামুন একদিন ভিক্ষায় বেরিয়ে সারাদিনে কিছু না পেয়ে গাছতলায় বসে মনের দুঃখে কাঁদছিল। তা দেখে নারায়ণের মনে করুনা হল। বামুনের পরীক্ষা নেবার জন্য ফকিরের বেশ ধরে তিনি সেখানে উপস্থিত হলেন। ফকির বামুনকে দুঃখের কথা জানতে চাইলে বামুন বলল, “তোমার অবস্থা তো আমারই মতো, তুমিও তো আমার মতো ফকির। তোমাকে আমার দুঃখের কথা বলে কি করব।”
ফকির বলল “তুমি আমাকে সামান্য ভাবছো,পরে জানতে পারবে আমি কে?”
তা শুনে বামুন বলল, “আমি ভিক্ষা করে খাই, আজ সারা দিন ঘুরেও কিছু পেলাম না তাই দুঃখে কাঁদছি।”
শুনে ফকির বলল, “তুমি সত্যপীরের পূজা করো,তাহলে দুঃখ দূর হবে।”
তাই শুনে বামুন বলল, “আমি পীরের পুজো কেন করব? আমি তো বামুন।”
তখন ফকির হেসে তাকে বলল, “তো কি হয়েছে? পীর আর নারায়ণের মধ্যে কোনো প্রভেদ নাই। শুধু নামেই পার্থক্য।”
কিন্তু বামুনের মন থেকে সন্দেহ যাচ্ছে না দেখে ফকির তারপর শঙ্খ, চক্র,গদা,পদ্ম ধারী চতুর্ভুজ নারায়ণের রূপে বামুনকে দর্শন দিলেন। তিনি বললেন, “আমিই পীর ,আমিই নারায়ণ!”এই বলে তিনি তাঁর পূজার নিয়মও বামুনকে বললেন। বামুন ভক্তিভরে নারায়ণকে প্রনাম করল এবং বাড়ি ফিরে বামুনিকে সব বলল। পর দিনই সত্য নারায়ণ পুজোর ভালো দিন ছিল, তারা ভালো করে পুজো দিল। আর পুজোর প্রসাদ প্রতিবেশীদের বিতরণ করল। এর পর দেখতে দেখতে বামুন বামুনির সুসময় ফিরল। বামুন একদিন সত্যনারায়ণ পুজোর জোগাড় করছে, তখন বনের এক কাঠুরে তার ঘরে জল চাইতে এল। কি পুজো হচ্ছে জিজ্ঞেস করলে বামুন কাঠুরেকে সত্যনারায়ণ পুজোর মাহাত্য বলল। সেই শুনে সেও তার ঘরে এই পুজো দিলো এই ভাবে মুখে মুখে এই পূজা প্রচার পেল।

কাঠুরের ঘরে মধু নামে এক বেনে কাঠ কিনতে এল। কাঠুরে সেদিন সত্যনারায়ণ পুজোর আয়োজন করেছিল। কি পুজো হচ্ছে জিজ্ঞেস করলে কাঠুরে মধুবেনেকে এই পুজোর মাহাত্য খুলে বলল। শুনে মধুবেনে নারায়ণের কাছে মানত করল যদি তার একটি সুন্দর কন্যা হয় তাহলে সেও এই পূজা করবে। নারায়ণের ইচ্ছায় তার মনোকামনা পূর্ণ হলে মধুবেনে খুব ধুমধাম করে সত্যনারায়ণ পুজো দিল। দেখতে দেখতে মধুবেনের মেয়ে বিবাহযোগ্যা হল। অনেক খুঁজে মেয়ের জন্য পাত্র স্থির হল। বিয়ের পর মধুবেনে তার জামাইকে নিয়ে বাণিজ্যে বের হল। কিন্তু ধীরে ধীরে সত্যনারায়নের কথা তারা ভুলে গেল। তারা যে রাজ্যে বাণিজ্যে গেল সেই রাজার রাজভান্ডার থেকে বহুমূল্য রত্ন, ধন চুরি গেল। রাজা চারিদিকে লোক লাগালেন তা খোঁজার জন্য। নারায়ণের ছলনায় তা মধুবেনের নৌকায় জড়ো হল। তার নৌকা ঘাটে নোঙর করলে রাজার লোক তার নৌকা থেকেই সব ফিরে পেল। রাজা তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করল। এই ভাবে দিন যায়। ওই দিকে মধুবেনের বাড়ির সেই শ্রী রইলো না, তাদের অবস্থা খারাপ হতে থাকল। মধুবেনের মেয়ে ,বউ তাদের ফেরার আসায় প্রতিবেশীর বাড়ি সত্যনারায়ণ পুজোয় গিয়ে মানত করে এল। আর দিনরাত আবার নারায়ণের নাম করতে লাগল। তা দেখে আবার নারায়ণের মনে দয়া জাগল। তিনি রাজাকে স্বপ্নে মধুবেনে আর তার জামাইকে কারাগার থেকে মুক্ত করার আদেশ দিলেন। রাজা ভয়ে নারায়ণের কাছে ক্ষমা চেয়ে মধুবেনে আর তার জামাইকে মুক্ত করে অনেক ধন দিয়ে পাঠালেন। নারায়ণের এবার মধুবেনের পরীক্ষা নিতে ইচ্ছা হল। তিনি ফকিরের বেশ ধরে তার ডিঙির সামনে হাজির হলেন। বেনেকে বললেন তাকে ভিক্ষা দিলে তার ধন তিনগুন বেড়ে যাবে,তা শুনে বেনে জানায় সে তো নিজেই ফকির সে আবার তাকে কি আশীর্বাদ করবে! ফকির বলে আমার আদেশেই তুমি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছ। বেনে তা বিশ্বাস করে না। সে জানায় তার ডিঙিতে শুধু ছাই আছে। এই কথা ফকিরের হৃদয়ে আঘাত করে। এরপর বেণে নৌকায় উঠে দেখে সত্যি সব ছাই হয়ে গেছে। তার জামাই বলল, “বাবা এসব ফকিরের অভিশাপে হয়েছে,চলুন তার কাছে ক্ষমা চাই।”
তারা আবার ডিঙি ফিরিয়ে ফকিরের পা ধরে অনেক কেঁদে ক্ষমা প্রার্থনা করলো। ফকিরের আবার দয়া হল এবং তিনি সব ফিরে পাবার আশীর্বাদ করলেন। এরপর দেশে ফিরে মধুবেনে তার নৌকাতে আগে সত্যনারায়ণ পুজো দিল এবং সেই প্রসাদ প্রতিবেশী পরিজন সবাইকে বিলিয়ে নিজে খেল। এই ভাবে এই সত্যনারায়ণ পুজো প্রচার পেল।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ব্রতকথাটি দেখুন এখানে

তথ্যসূত্র


  1. মেয়েদের ব্রত কথা -লেখক গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য সম্পাদিত ও রমাদেবী কর্তৃক সংশোধিত। পাতা নং-(২০৪-২০৮)
  2. https://www.kolkata24x7.com/
  3. https://sabrangindia.in/

One comment

আপনার মতামত জানান