ভারতীয় বিচারালয়ের ইতিহাসে যেসব যুগান্তকারী মামলা এবং ঐতিহাসিক রায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে, সেগুলির মধ্যে অন্যতম একটি হল সুলতানা মির্জা বনাম উত্তর প্রদেশ মামলা । দুজন সমলিঙ্গের মানুষের পরস্পরকে ভালোবেসে উভয়ের সম্মতিক্রমেই একসঙ্গে বসবাস ( লিভ-ইন রিলেশনশিপ) করাকে কেন্দ্র করেই মূলত এই মামলার সূচনা হয়েছিল। সেই সমকামী দম্পতির যেকোনো রকম সামাজিক হয়রানি বা হেনস্থার কবল থেকে মুক্তিলাভের আবেদনের ওপর ভিত্তি করেই এলাহাবাদ হাইকোর্ট একটি সংবেদনশীল এবং মানবিক রায় ঘোষণা করেছিল। নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারগুলির যথাযথ পর্যবেক্ষণ, সুরক্ষা এবং আবেদনকারীদের পুলিশি নিরাপত্তাও সুনিশ্চিত করেছিল এলাহাবাদ হাইকোর্ট। সমকামী সম্পর্ককে সুপ্রিম কোর্ট বৈধতা দেওয়া সত্ত্বেও এধরনের ঘটনা আদালতের চৌহদ্দিতে এসে পড়েছিল, সেটাই বিস্ময়কর।
সুলতানা মির্জা এবং তাঁর সঙ্গিনী কিরণ রাণী উভয়েই পরস্পরের সম্মতি অনুযায়ী কেবল ভালোবাসার আকর্ষণেই একসঙ্গে লিভ-ইন রিলেশনশিপে ছিলেন দীর্ঘদিন। দুজনেই অর্থনৈতিক দিক থেকেও স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, অতএব অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকার প্রয়োজন ছিল না তাঁদের। একজন ছিলেন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং অন্যজন একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল সুলতানা মির্জারা দুজনেই ছিলেন প্রাপ্তবয়স্ক, অতএব সাবালক হওয়ার খাতিরে সংবিধান বর্ণিত স্বাধীনতার অধিকার ছিল তাঁদের প্রাপ্য। অর্থাৎ তাঁদের দুজনের এই সম্পর্কের মধ্যে অর্থনৈতিক কারণ কিংবা বয়সজনিত কোন বিষয়ে তৃতীয় কোন ব্যক্তির হস্তক্ষেপ অযৌক্তিক এবং অসাংবিধানিক। তাছাড়াও সমলিঙ্গের সম্পর্ককেও সুপ্রিম কোর্ট বৈধতা প্রদান করেছিল আগেই। অতএব তেমন সম্পর্কে স্বেচ্ছায় লিপ্ত থাকা দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে হেনস্থা করা হলে, সামাজিকভাবে নানা কটুক্তি, তিক্ত মন্তব্যের সম্মুখীন হতে হলে, এমনকি সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হলে, তেমন ঘটনা সংবিধানে বর্ণিত নাগরিকদের অধিকার এবং তার যথাযথ সুরক্ষার যে অঙ্গীকার সেবিষয়েই সন্দেহের অবকাশ তৈরি করে।
এই ঘটনাই ঘটেছে সুলতানা মির্জা এবং তাঁর সঙ্গীনি কিরণ রাণীর সঙ্গে। তাঁদের অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিন লিভ-ইন রিলেশনশিপে থাকার ফলে পরিবার তো বটেই, সমাজের নানারকম প্রতিরোধ, প্রতিবাদ, কটুক্তি, হেনস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছে দুজনকে। এমনকি তাঁদের জীবনহানির হুমকিও পেতে হয়েছিল সমকামী হিসেবে সমাজের মধ্যে বসবাস করবার কারণে। সেই কারণেই সুলতানা এবং কিরণ নিরাপত্তার অভাব বোধ করে এবং অবশ্যই সাংবিধানিক অধিকার খর্ব হওয়ার অভিযোগ নিয়েই হাজির হয়েছিলেন এলাহাবাদ হাইকোর্টে।
আবেদনকারী এবং তাঁদের আইনজীবীদের কাছে পূর্ববর্তী নভতেজ সিং জোহর মামলা ছিল একটি সুদৃঢ় অবলম্বন। সেই নভতেজ সিং মামলায় ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট এলজিবিটিকিউআইএ+ (LGBTQIA+) সম্প্রদায়ের নানারকম সামজিক দুর্দশা, তাঁদের প্রাপ্য অধিকার, ইত্যাদি বিষয়ে ভীষণই সংবেদনশীলভাবে বিচার করে রায় ঘোষণা করেছিল। সেই মামলার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে সুলতানা মির্জাদের পক্ষ থেকে জোরালো যুক্তিপরম্পরা উপস্থাপন করা হয়েছিল।
নভতেজ সিং জোহর মামলায় সুপ্রিম কোর্ট মূলত যে রায় জানিয়েছিল, সেগুলি বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায়, তা সূত্রাকারে দেখা যাক।
প্রথমত আদালত জানিয়েছিল, যে, যেকোনো যৌন অভিমুখিতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে স্বাধীনতা, গোপনীয়তা, মর্যাদা, ব্যক্তিগত স্বায়ত্তশাসন এবং সমতার মতো বিষয়গুলিও। তাই পারস্পরিক সম্মতিক্রমে সমলিঙ্গের প্রাপ্তবয়স্ক দুজন মানুষের ঘনিষ্ঠতা রাষ্ট্রের বৈধ স্বার্থের বাইরে।
দ্বিতীয়ত, অধিকারের ভিত্তিতে সাংবিধানিক নির্দেশের অধীনে স্বাধীনতায় বিশ্বাসী একটি সমাজ গঠনের জন্য ভালোবাসার অধিকার এবং সমলিঙ্গের সম্পর্কের মধ্যে পরিপূর্ণতা খুঁজে পাওয়ার তৃপ্তি খুবই প্রয়োজন। সুপ্রিম কোর্ট জানায়, যে, যৌন অভিমুখিতার কারণে বৈষম্য দূর করলেই কেনল চলবে যথাযথ অধিকার প্রদান করাও প্রয়োজন, যা সমলিঙ্গের সম্পর্কে পরিপূর্ণতা আনতে পারে। আবেদনকারীদের পক্ষে তাঁদের আইনজীবীরা আরও জানান যে, সুলতানা ও কিরণের বিশেষ এই যৌন প্রবণতার কারণে তাঁদেরকে যে সামাজিক হুমকি বরদাস্ত করতে হচ্ছে তাতে সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁরা।
নভতেজ সিং জোহর মামলায় প্রদত্ত সুপ্রিম কোর্টের এই ঐতিহাসিক রায়ের পরে ভালোবাসার একপেশে অভিমুখ বদলে গিয়েছিল। সমস্তরকম সম্পর্ককে সে সমলিঙ্গেরই বা হোক না কেন, একটি মর্যাদার আসনে বসিয়ে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। সমলিঙ্গের সম্পর্ককে বৈধতা প্রদান করেছিল ভারতের সর্বোচ্চ বিচারালয়। অথচ তারপরেও ভারতবর্ষীয় সংকীর্ণ মানসিকতাপূর্ণ সমাজে আখছার ঘটেছে অসাংবিধানিক সব কার্যকলাপ। সমলিঙ্গের সম্পর্কে লিপ্ত থাকা বহুজনকেই সহ্য করতে হয়েছে কটুক্তি, হেনস্থা, জীবননাশের হুমকি এমনকি সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মতো অবস্থারও মুখোমুখি হতে হয়েছে। সুলতানা মির্জা এবং কিরণ রাণী তাঁদের মতোই দুজন মানুষ।
এই গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির বিচারের দায়িত্বে ছিলেন, শশী কান্ত গুপ্ত এবং পঙ্কজ ভাটিয়া। অনেক সওয়াল জবাবের পর এলাহাবাদ হাইকোর্ট জানিয়েছিল যে, সাংবিধানিক আদালত হিসেবে সাংবিধানিক নৈতিকতা পর্যবেক্ষনের দায় রয়েছে তার, এমনকি নাগরিকদের অধিকারের যথাযথ পর্যবেক্ষণ ও সুরক্ষার দায়িত্ব আদালত পালন করতে বাধ্য, যে অধিকারগুলি আজও বিশেষ যৌন অভিমুখিতার কারণে খর্ব হয়। এলাহাবাদ হাইকোর্ট মামলার সমস্ত ঘটনা এবং পরিস্থিতি গভীরভাবে এবং অভিনিবেশ সহকারে বিবেচনা করার পরে ২০২০ সালের ২ নভেম্বরে শামলির পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেয় যে, আবেদনকারীরা প্রয়োজনীয় সুরক্ষার জন্য পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলে যেন তাঁদের যথাযথ সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয় এবং পরবর্তীকালে কোনোরকম হয়রানির শিকার যাতে আর না হতে হয় সুলতানাদের, সে বিষয়েও যেন পুলিশ নিশ্চয়তা প্রদান করে।
সুলতানা মির্জা বনাম উত্তর প্রদেশ মামলা এবং এলাহাবাদ হাইকোর্টের এই গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক রায় এলজিবিটিকিউআইএ+ সম্প্রদায়ের মানুষদের স্বাধীন ও মুক্তভাবে বাঁচবার অধিকার সমাজে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটিকে এগিয়ে দিয়েছিল অনেক ধাপ।