হিন্দু দেবতা বিশ্বকর্মাকে (Vishwakarma) সমস্ত রকম নির্মাণ শিল্পের দেবতা বলা হয়। বলা যেতে পারে, বিশ্বকর্মা হলেন স্বর্গলোকের অন্যতম সেরা স্থপতি এবং ভাস্কর। তাই যাঁরা নির্মাণ বা কারিগরি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত তাঁরা সাড়ম্বরে ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিন বিশ্বকর্মা পুজো করে থাকেন। আর বিশ্বকর্মা পুজো এলেই সারা আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ঘুড়ির মেলা। হিন্দুদের কাছে আজও বিশ্বকর্মা পুজো যেন একটা ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব। পুরাণে বিশ্বকর্মার জন্ম ইতিহাস সম্পর্কে নানা কথা বলা আছে। আসুন বিশ্বকর্মাকে নিয়ে ছড়িয়ে থাকা সেই সব অজানা কাহিনী জেনে নেওয়া যাক।
মৎস্যপুরাণ থেকে জানা যায় যে, দেবগুরু বৃহস্পতির বোন যোগসিদ্ধা তথা বরস্রী বিশ্বকর্মার মাতা এবং অষ্টবসুর অন্যতম ঋষি প্রভাস তাঁর পিতা। আবার অন্য একটি মতে ব্রহ্মার নাভিমূল থেকেই তাঁর সৃষ্টি। তাঁর চারটি হাত – যার এক হাতে দাঁড়িপাল্লা ধারণ করেথাকেন তিনি যা জ্ঞান ও কর্মের প্রতীক, আরেক হাতে রয়েছে হাতুড়ি যা শিল্পনির্মাণের সঙ্গে জড়িত। এই দাঁড়িপাল্লা ধারণেরও একটি তাৎপর্য আছে। মনে করা হয় জ্ঞানের দিকে বেশি আগ্রহী হলে কর্মকে অবহেলা করা হয় আর কর্ম না করলে জীবনে সাফল্য আসে না। অন্যদিকে শুধু কর্ম করে গেলে জ্ঞান অর্জন হবে না, তাই দাঁড়িপাল্লা একইসঙ্গে জ্ঞান ও কর্মের সমতা বজায় রাখার জন্য প্রযুক্ত। বিশ্বকর্মার বাহন হাতি। বেদে বিশ্বকর্মাকে বর্ণনা করা হয়েছে ‘ত্বষ্টা’ রূপে।ঋগবেদের বর্ণনায় পাওয়া যায় আকাশ ও পৃথিবী সবটাই সৃষ্টির আদিকালে জলে পরিপূর্ণ ছিল। পরে জলভাগ বাড়তে বাড়তে পৃথিবী ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকে। সেই সময় বিশ্বকর্মাই তা নিরীক্ষণ করে ভূলোক ও দ্যুলোককে আলাদা করে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন। এই বিশ্ব তাঁরই কর্মের প্রতীক বলে তাঁর নাম বিশ্বকর্মা। হিন্দু পুরাণমতে, বিশ্বকর্মার শিল্পের ছোঁয়া সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি সব যুগেই পাওয়া যায়। সত্য যুগে বিশ্বকর্মা দেবরাজ ইন্দ্রের জন্য স্বর্গপুরী নির্মাণ করেছিলেন যেখানে ইন্দ্রদেব অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে বসে মর্ত্যলোক শাসন করতেন। এই ইন্দ্রের স্বর্গপুরী নির্মাণের সঙ্গে একটি পৌরাণিক কাহিনী জড়িয়ে আছে। বিশ্বকর্মা ইন্দ্রের জন্য একবার করে অসাধারণ একেকটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন আর ইন্দ্রদেবের তা পছন্দ হয় না। এভাবে কিছুদিন চলার পরে প্রতিকারের আশায় বিশ্বকর্মা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। তখন বিষ্ণু এক বালকের বেশে ইন্দ্রের কাছে গিয়ে বলেন যে জগতে সবই অনিত্য। তাঁর আগেও কয়েকজন ইন্দ্র ছিলেন আর তাঁর পরেও থাকবেন আর তাই কোনো সৃষ্টিই শ্রেষ্ঠ সুন্দর হতে পারে না। এই কথার পরে বিষ্ণু স্বরূপ ধারণ করলে ইন্দ্রের ভুল ভাঙে। ত্রেতাযুগে বিশ্বকর্মা সোনার লঙ্কা সৃষ্টি করেন। এই সোনার লঙ্কা নির্মাণ নিয়েও একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। পুরাণে বলা হয়, শিবের সঙ্গে পার্বতীর বিবাহ হলে তাঁদের থাকার জন্য বিশ্বকর্মা যখন একটি প্রাসাদ নির্মাণ করে দেন তখন তাঁদের সেই বাসগৃহের গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে প্রাসাদের সৌন্দর্য্য দেখে লঙ্কাধিপতি রাবণ মুগ্ধ হন। জানা যায় যে রাবণকেই গৃহপ্রবেশের পুজোর জন্য আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। সেই পুজোর পর দক্ষিণা হিসাবে রাবণ এই সোনার লঙ্কাই মহাদেবের কাছে চেয়ে বসেন। মহাদেব তখন বিশ্বকর্মাকে নির্দেশ দেন লঙ্কাপুরী নির্মাণের জন্য। তারপর থেকে বিশ্বকর্মার নির্মিত এই সোনার লঙ্কা বা স্বর্ণলঙ্কা রাবণের রাজধানী। দ্বাপরযুগে বিশ্বকর্মা শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকানগর তৈরি করেন। মহাভারতে দ্বারকা শ্রীকৃষ্ণের কর্মভূমি হিসাবে উল্লিখিত। এটি বিশ্বকর্মার অন্যতম সৃষ্টি। কলিযুগে কৌরবদের জন্য হস্তিনাপুর এবং পাণ্ডবদের জন্য ইন্দ্রপ্রস্থও বিশ্বকর্মা নির্মাণ করেন। এই ইন্দ্রপ্রস্থ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য যেখানে পুরোটাই ছিল মায়া দিয়ে তৈরি। জল আর স্ফটিকের ধাঁধায় এই ইন্দ্রপ্রস্থের প্রাসাদ অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পনির্মাণের মর্যাদা পেয়েছিল। এই মায়ানগরের মায়া বুঝতে না পেরে দুর্যোধন চলতে চলতে স্ফটিক ভেবে জলে পড়ে গিয়েছিলেন বলে মহাভারতে জানা যায়। এছাড়াও কুবেরের অলকাপুরী, পুষ্প রথ, রাবণের রাজপ্রাসাদের সংলগ্ন সুন্দর উদ্যান, কুঞ্জর পর্বতে অবস্থিত অগস্ত্য মুনির ভবন এই সবই বিশ্বকর্মার সৃষ্টি।
আবার পুরাণ মতে, ভগবান বিষ্ণুর চক্র, শিবের ত্রিশূল, পরশুরামের কুঠার, হরধনু সবই তাঁর সৃষ্টি। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে উল্লেখ পাওয়া যায় মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য মহামায়াকে বর্ষা, অভেদ্য কবচ, আরও শক্তিশালী অস্ত্র প্রদান করেছিলেন বিশ্বকর্মা। তিলোত্তমা নাম্নী মহাশক্তির সৃষ্টির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে বিশ্বকর্মার নাম। সুন্দ উপসুন্দ নামে দুই অসুরের প্রতাপে অতিষ্ঠ দেবলোককে বাঁচাতে বিশ্বকর্মা ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত বস্তুর মধ্যে থেকে শক্তি তিলে তিলে সঞ্চয় করে গড়ে তোলেন তিলোত্তমাকে যে মহামায়ার অংশ বিশেষ। পুরাণের কাহিনী এখানেই শেষ নয়। সূর্যকে বিবাহ করে বিশ্বকর্মার কন্যা সংজ্ঞা যখন প্রবল তেজ সহ্য করতে পারছিলেন না, ঠিক সেই সময় বিশ্বকর্মা সূর্যের তেজকে আট ভাগে বিভক্ত করে তাঁর একটি ভাগ দেন সূর্যকে আর বাকি সাতটি ভাগ দিয়ে নির্মাণ করেন বিষ্ণুর চক্র, শিবের ত্রিশূল, কার্তিকের তীর-ধনুক ইত্যাদি। প্রবল পরাক্রমী বৃত্রাসুরের অত্যাচারে পীড়িত দেবকুল যখন ব্রহ্মার পরামর্শে দধীচি মুনির শরণ নেন, তখন তাঁর অস্থি দিয়ে শোভনকর্মা ও সুপ্রেরণীয় নামে দুটি বজ্র নির্মাণ করেছিলেন বিশ্বকর্মা।
বিশ্বকর্মা জগতের কল্যাণার্থে বাস্তুনির্মাণের উপর গ্রন্থও রচনা করে গেছেন যাকে বাস্তুশাস্ত্র বলা হয়। পুরাণে জানা যায়, চারটি বেদের মতো চারটি উপবেদও রয়েছে – আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গান্ধর্ববেদ এবং স্থাপত্যবেদ। এই স্থাপত্যবিদ্যার রচয়িতা বিশ্বকর্মা। তাঁকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রধান বাস্তুকার বলা হয়ে থাকে। বিশ্বকর্মা এবং প্রহ্লাদের কন্যা বিরোচনার পুত্র ময় বিশ্বকর্মার মতোই এক অনন্য স্থপতি। সর্বমেধ যজ্ঞের মাধ্যমে তিনি মাঝে মাঝেই বিশ্বের সবকিছুকে আহুতি দেন, নিজেকেও আহুতি দেন আর বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যায় তখন। তারপর পুনরায় সৃষ্টিপাগল ছন্দে নেচে ওঠেন বিশ্বকর্মা।
4 comments