ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে আসছি যে হাই ওঠার অর্থ শরীর ক্লান্ত বা ঘুম পাচ্ছে। এই ধারণাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। হাই ওঠার বিষয়টা ভাবলে, শুনলে বা অন্য কাউকে হাই তুলতে দেখলে আমাদেরও হাই ওঠে। শুধুমাত্র মানুষেরই হাই ওঠে এমনটা নয়, অন্যান্য জন্তু জানয়ারের মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। হাই ওঠা একটা স্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া যা শরীরের প্রয়োজন অনুসারে নিজে নিজেই হয়ে থাকে। এখানে আমরা আমাদের হাই ওঠে কেন সেই বিষয়ে আলোচনা করব।
হাই ওঠে কেন – এই প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানা মতবাদ প্রচলিত আছে। দীর্ঘ সময় মনোযোগ সহকারে কাজ করলে মস্তিষ্ক গরম হয়ে যায়। তা ঠাণ্ডা করার জন্য শীতল রক্তের সঞ্চালনের প্রয়োজন। হাই ওঠার মাধ্যমে অনেক পরিমাণ প্রশ্বাস নেওয়া হয় এবং তুলনামুলকভাবে সংক্ষিপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়া হয়, এর ফলে মুখের চোয়াল ও সংশ্লিষ্ট পেশিগুলো দ্রুত সংকুচিত ও প্রসারিত হয়।এই ঝাঁকুনির ফলে মাথায় থাকা শিরা ও ধমনীর মধ্যে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায় ও মস্তিষ্ক ঠাণ্ডা হয়। শরীরের তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রিত হয়। হাই ওঠার ফলে হৃৎপিণ্ডের রিদম (cardiac rhythm) পুনরায় সক্রিয় হয় যার ফলে শরীরের জড়তা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে ।
অনেক স্বাস্থ্য বিশারদের মতে একটানা কাজ করলে আমাদের মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে যায়, তাই পুনরায় মস্তিষ্ককে নতুন উদ্যোগ নিয়ে শুরু করতে শরীর হাই তোলে ।ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র অনেক সময় টানা ব্যবহার করলে হ্যাং হয়ে যায়, তখন প্রয়োজন হয় রিস্টার্ট করার। তেমন ভাবে মস্তিষ্ককেও মুলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে হাই তোলা রিস্টার্ট এর কাজ করে । মস্তিষ্কের মিরর স্নায়ুর কাজ মূলত কোন ঘটনাকে হুবহু নকল করার প্রবণতা তৈরি করা, সেজন্য হাই ওঠার কথা ভাবলে, শুনলে বা অন্য কাউকে হাই তুলতে দেখলে আমাদেরও হাই ওঠে। হাই ওঠার সময় মস্তিষ্কের ডোপামাইন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে অক্সিটোসিন নামক রাসায়নিকের ক্ষরণ বেড়ে গিয়ে মন মেজাজ ফুরফুরে করে তোলে।
আসলে হাই ওঠা এক ধরনের বাঁধাধরা প্রতিবর্ত ক্রিয়া (stereotypical reflex) যার মাধ্যমে অবচেতন মস্তিষ্ক ও শরীর সামঞ্জস্য বিধান করে। ফুসফুসের মাধ্যমে আমরা অক্সিজেন শোষণ করলেও শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি ফুসফুস বুঝতে পারে না। শ্বাসপ্রশ্বাস ও হাই ওঠা দুটোই মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া। হাইপোথ্যালামাসের প্যারা ভেন্টিকুলার নিউক্লিয়াস (PVN) শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে ডোপামাইন, গ্লাইসিন, অক্সিটোসিন, এ সি টি এইচ (ACTH) ইত্যাদি রাসায়নিক বার্তাবহের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এরাই হাই তুলতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেয়। হাইপোথ্যালামাসের প্যারা ভেন্টিকুলার নিউক্লিয়াসকে মস্তিষ্কের হাই ওঠার কেন্দ্র (yawning centre) বলা হয় । এ সি টি এইচ রাত্রিতে ও বিশেষত ঘুম থেকে ওঠার আগে সবথেকে বেশি মাত্রায় থাকে যা ঘুম ভাঙার পর হাই ওঠা ও আড়মোড়া ভাঙতে উৎসাহিত করে। গবেষণায় আরও জানা গেছে প্যারা ভেন্ট্রিকুলার নিউক্লিয়াসের কিছু নির্দিষ্ট নিউরন নাইট্রিক অক্সাইড উৎপন্ন করে যা ব্রেন স্টেমসেলকে উত্তেজিত করে ও হাই ওঠে। অর্থাৎ হাই ওঠা একটা প্রতিক্রিয়া (feedback component)। এর ফলে মস্তিষ্কে বাড়তি অক্সিজেন পৌঁছায়। আমাদের কাজ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও অলসতা কেটে যায়। হাই ওঠাকে তাই কখনও জোর করে বন্ধ করা বা অসম্পূর্ণ রাখা উচিৎ নয়। নিয়মিত হাই ওঠা আসলে সুস্থ শরীরের লক্ষণ।
