লাল বাহাদুর শাস্ত্রী

লাল বাহাদুর শাস্ত্রী

স্বাধীন ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী (Lal Bahadur Shastri) যিনি সাদা বিপ্লব তথা হোয়াইট রেভোলিউশনের প্রবর্তক। ভারতবর্ষে দুধ উৎপাদনে জোয়ার এসেছিল এই প্রকল্পের মাধ্যমে। গুজরাটের আমূল মিল্ক কো-অপারেটিভের সাথে এই প্রকল্পের প্রচার করেছিল লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার। ভারতের খাদ্যশস্য উৎপাদনে বৃদ্ধি আনতে তিনি বিশেষ পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন এই প্রকল্পকে ভারতের সবুজ বিপ্লব বা গ্রিন রেভোলিউশন ইন ইন্ডিয়া বলা হয়ে থাকে। ১৯৬৫ সালে তাঁর এই প্রকল্পের সূচনা হয়। এর ফলে বিশেষ করে পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তর প্রদেশ খাদ্যশস্য উৎপন্নকারী প্রথম সারির রাজ্যে পরিনত হয়।

১৯০৪ সালের ২ অক্টোবর তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন ইউনাইটেড প্রভিন্স তথা বর্তমান উত্তর প্রদেশের মুঘলসরাইতে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর জন্ম। তাঁর বাবা সারদা প্রসাদ শ্রীবাস্তব এবং মা রামদুলারী দেবী। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী পৈতৃক পূর্বপুরুষেরা বেনারসের রাম নগরের জমিদারিতে কাজ করতেন। ফলে শৈশবের কিছু দিন তিনি বেনারসে কাটিয়ে ছিলেন। তাঁর বাবা এলাহাবাদে একটি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। যখন শাস্ত্রীর বয়স যখন মাত্র ৬ মাস বয়স তখন বিউবনিক প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর বাবা মারা যান। সেই সময় তাঁর মা গর্ভবতী (তৃতীয় সন্তান) ছিলেন। শাস্ত্রী এরপর মুঘলসরাইয়ে তাঁর মামারবাড়ি চলে আসেন। দিদিমার মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি সেখানেই বসবাস করেছিলেন।

লাল বাহাদুর শাস্ত্রী উত্তর প্রদেশের হরিশ চন্দ্র হাই স্কুল থেকে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করবার পর ইস্ট সেন্ট্রাল রেলওয়ে ইন্টার কলেজে পড়াকালীন মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

হরিজন সমাজের উন্নতির জন্য মুজফফরপুরে কাজ করাকালীন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী জন্মসুত্রে প্রাপ্ত শ্রীবাস্তব পদবি ত্যাগ করেন। স্বামী বিবেকানন্দ, অ্যানি বেসান্ত ও মহাত্মা গান্ধীর জীবন দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং মতাদর্শে বিশ্বাসী লাল বাহাদুর ১৯২০ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। প্রথমে তিনি লালা রাজপত রাই প্রতিষ্ঠিত লোক সেবক মন্ডলের একজন সদস্য রূপে কাজ শুরু করেন। আজীবন তিনি এই সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। গান্ধীজীর দেখানো পথ অনুযায়ী তিনি সারা জীবন হরিজন সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করে গেছেন। এরপর গান্ধীজীর আমন্ত্রনে কংগ্রেসে যোগ দেন তিনি।  কিছুদিনের মধ্যেই শাস্ত্রী ভারতের জাতীয় কংগেসের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করেন। ১৯৪০ সালে সত্যাগ্রহের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেফতার করেন। একবছরের জন্য কারাবাস হয় তাঁর। এর আগেও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য বহুবার কারাবরন করেছেন তিনি। উত্তর প্রদেশের পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠনের ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ন। ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত উত্তর প্রদেশের পার্লামেন্টারি বোর্ডের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ক্যাবিনেট মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত রেলমন্ত্রী এবং পরবর্তীকালে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। নেহেরুর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালের ৯ জুন শাস্ত্রীকে ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত করে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন শাস্ত্রী ভারতের দুধ উৎপাদন এবং খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিপুল উন্নয়ন করেন। যা সাদা বিপ্লব এবং ভারতের সবুজ বিপ্লব নামে অভিহিত হয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক যুদ্ধ চলাকালীন তাঁর একটি স্লোগান- ‘জয় জওয়ান জয় কিষান’ যা আজও জনপ্রিয় এবং প্রাসঙ্গিক।

১৯২৮ সালের ১৬ মে মিরজাপুর নিবাসী ললিতা দেবীর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের চার পুত্র এবং দুই কন্যা সন্তান। হরি কৃষ্ণ শাস্ত্রী, সুমন শাস্ত্রী, সুনীল শাস্ত্রী, অশোক শাস্ত্রী হলেন চার পুত্র এবং বড় কন্যার নাম কুসুম শাস্ত্রী ।

১৯৬৬ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের অবসান হয় উজবেকিস্তানের ( তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ) তাশকেন্ত শহরে চুক্তি সইয়ের মধ্য দিয়ে। ১০ জানুয়ারি ওই চুক্তি স্বাক্ষরের দিনই তাশকেন্ত শহরে হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি এবং ১১ জানুয়ারি ৬১ বছর বয়সে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু হয়।   

লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মরণোত্তর ভারতরত্ন সম্মানে সম্মানিত হন ১৯৬৬ সালে।

4 comments

আপনার মতামত জানান