রামকিঙ্কর বেইজ

রামকিঙ্কর বেইজ

রামকিঙ্কর বেইজ (Ramkinkar Baij) একজন বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি চিত্রশিল্পী তথা ভাস্কর যিনি আধুনিক ভারতীয় ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মনে করা হয় ভারতীয় ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পে আধুনিকতার প্রবেশ প্রথম তাঁর হাত ধরেই ঘটেছিল।

১৯০৬ সালের ২৫ মে ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির বাঁকুড়া জেলার যুগীপাড়ায় রামকিঙ্করের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম চণ্ডীচরণ, মায়ের নাম সম্পূর্ণা। রামকিঙ্করের  পারিবারিক পদবী ছিল পরামাণিক। তিনিই প্রথম ‘বেইজ’ পদবী চালু করেন তাঁদের পরিবারে। সংস্কৃত ‘বৈদ্য’ ও প্রাকৃত ‘বেজ্জ’-র পরিবর্তির রূপ হল। ক্ষৌরকর্ম ছিল তাঁদের পারিবারিক পেশা।

শৈশবে বাঁকুড়ার কুমোরদের কাজ দেখে রামকিঙ্কর বড় হয়েছিলেন। তাঁদের দেখাদেখি কাদা দিয়ে মূর্তি গড়েছেন। এভাবেই ভাস্কর্য শিল্পের প্রতি তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। স্বশিক্ষিত শিল্পী বলতে যা বোঝায় রামকিঙ্কর বেইজ ছিলেন তাই। বাড়ির পাশের অনন্ত সূত্রধর তাঁর প্রথম শিল্পশিক্ষক। অনন্ত সূত্রধর প্রতিমা গড়তেন। তাঁর প্রতিমা তৈরির কাজে সহযোগিতা করতেন রামকিঙ্কর। দু’চার আনার বিনিময়ে নিষিদ্ধ পল্লির রমণীদের মূর্তি গড়তে গড়তেই তাঁর ভাস্কর্যের সহজপাঠ। কিশোর বয়সের এই শিক্ষক অনন্ত সূত্রধরের কথা সারা জীবন ধরেই মনে রেখেছিলেন তিনি।


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

ছেলেবেলায় প্রকট দারিদ্র্যের মধ্যেই প্রচুর ছবি এঁকেছেন রামকিঙ্কর। শিমগাছের পাতা দিয়ে সবুজ, রান্নার হলুদ দিয়ে হলুদ, পুঁই দিয়ে বেগুনি এইভাবে ছবিতে ব্যবহারের জন্য রঙ তৈরি করতেন তিনি। এর সাথে গড়তেন মূর্তি। এই সময়ে স্বদেশী মেলায় তেল রঙে জাতীয় কংগ্রেসের পোস্টার এঁকেও হাত পাকিয়েছিলেন তিনি। শিল্পের প্রতি অপার নিষ্ঠার মনটি সেই তখনই তৈরি হয়ে গিয়েছিল তাঁর।

কলাভবনে রামকিঙ্করই প্রথম তেল রঙে কাজ করেছেন। সে নিয়েও বিতর্কের শেষ ছিল না। প্রথমে আপত্তি করলেও পরে নন্দলাল বসু মেনে নিয়েছিলেন ছাত্রের যুক্তি। রামকিঙ্কর রঁদা, সেজান ও পরবর্তী কিউবিস্ট ছবির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তাঁর কাজে কিউবিস্ট প্রভাব নিয়েও নন্দলালের সঙ্গে বিরোধ ছিল। সে বিরোধ‎ মিটেও যায় পরে।

রামকিঙ্করের কচ ও দেবযানী মূর্তিটি ১৯২৯ সালে তৈরি। প্লাস্টারে করা এই ভাস্কর্যটির উচ্চতা ৩০ সেমি। রামকিঙ্করের পেশাগত জীবনের ভবিষ্যত স্থির হয় ১৯৩৪ সালে। তিনি কলাভবনের স্থায়ী শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পান এই সময়ে। ১৯৩৫ এবং ৩৬ সালে অনেকগুলি কাজ তিনি শেষ করেন। এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির মধ্যে রয়েছে ‘রিলিফ সাঁওতাল ও মেঝেন’, ‘সাঁওতাল দম্পতি’, ‘কৃষ্ণগোপিনী’, ‘সুজাতা’। ১৯৩৭ থেকে তিনি ছাত্রদের মডেলিং শেখানোর দায়িত্ব নেন। এই বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই রামকিঙ্করের তেলরঙ পর্বের শুরু বলে মনে করা যায়। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে তিনি অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ তেলরঙ চিত্রের কাজ শেষ করেন। একই সময়ের মধ্যে শেষ হয় তাঁর অনেকগুলি বিখ্যাত ভাস্কর্যের কাজও। তাঁর সৃষ্টিকর্মের কাল বিচারে এটিই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সময় বলা যেতে পারে। এই পর্বে করা তাঁর বিখ্যাত ভাস্কর্যগুলির মধ্যে কংক্রীটে তৈরি ‘সাঁওতাল পরিবার’, প্লাস্টারে করা রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি ভাস্কর্য, ‘পোয়েটস্ হেড’, সিমেন্টে তৈরি ‘হেড অফ এ উওম্যান’, ‘বাতিদান’ অন্যতম।

১৯৭৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট সম্মাননায় ভূষিত করে। রামকিঙ্করের  চিকিৎসার জন্য ‘লোকচিত্রকলা’ পত্রিকা, ‘পেইন্টার্স ফোরাম’ এবং কয়েকজন বিখ্যাত শিল্পীর পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে আবেদন জানানো হয়। ১৯৮০ সালের ২৩ মার্চ রামকিঙ্করকে কলকাতার শেঠ সুখলাল কারনানি (এস এস কে এম) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর চিকিৎসার খরচের যাবতীয় দায়িত্ব নেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকেও কিছু টাকা দেওয়া হয়।

১৯৮০ সালের ২ আগস্ট রাত্রি সাড়ে বারোটায় রামকিঙ্করের মৃত্যু হয়।

3 comments

আপনার মতামত জানান