সামাদ

সৈয়দ আবদুস সামাদ

বাংলার ক্রীড়া-ইতিহাসে ‘ফুটবলের জাদুকর’ হিসেবেই বিখ্যাত সৈয়দ আবদুস সামাদ (Syed Abdus Samad)। অবিভক্ত বাংলায় জন্ম হলেও দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানকেই তিনি মাতৃভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, তবু জীবদ্দশায় সার্বভৌম বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি তিনি। কলকাতার ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান দলের হয়ে ফুটবলে কৃতিত্বের নিদর্শন রেখেছেন সামাদ এবং একইসঙ্গে ভারতীয় জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়কত্বও পালন করেছেন। বাঙালির ফুটবল ইতিহাসে সৈয়দ আবদুস সামাদ এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক।

১৮৯৫ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের বিহার রাজ্যের পূর্ণিয়ায় সৈয়দ আবদুস সামাদের জন্ম হয়। ছোটবেলা থেকেই তিনি ফুটবল খেলায় দক্ষতার প্রদর্শন করেন

সামাদের পড়াশোনায় মন বসতো না একেবারেই। মেধায় নয়, পায়ের জাদুতেই ছিল তাঁর ভবিতব্য। মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েই তাঁর পড়াশোনা সমাপ্ত হয়। শোনা যায় যে স্কুলে যাওয়া-আসার সময়েও তাঁর পায়ে ফুটবল থাকতো। কিশোর বয়সে তিনি ফুটবল খেলতেন পূর্ণিয়া ডিস্ট্রিক্ট টাউনের হয়ে। কিষাণগঞ্জ স্কুলের বিপক্ষে পূর্ণিয়াতে হওয়া একটি ফোকাস কাপের ম্যাচে তিনি ১০টি গোল করেন।

প্রথম জীবনে সামাদ তথাকথিত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি করেননি। তাঁর সমগ্র জীবনটাই কেটেছে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে। তবে দেশভাগের সময় ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে চলে এলে পাকিস্তান রেলওয়েতে চাকরি পান তিনি। পাকিস্তান রেলওয়েতে সেই সময় কোনো ইন্সপেক্টর পদ ছিল না, শুধুমাত্র সামাদের প্রতি সম্মানজ্ঞাপনের জন্য তাঁকে এই পদে নিয়োগ করা হয়। টানা ১০ বছর এই চাকরিতে বহাল ছিলেন সামাদ। রেল কর্মচারী থাকাকালীনও খেলাকে ছেড়ে দেননি তিনি।

পূর্ণিয়ার জুনিয়র একাদশ দলে তাঁর  ফুটবলে হাতেখড়ি হয়। আর এই দলের হয়ে খেলতে খেলতেই কলকাতার ফুটবল ক্লাব ম্যানেজারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই কলকাতার বুকে পা রাখেন সামাদ। ১৯১২ সালে তিনি কলকাতা মেন টাউন ক্লাবে যোগ দেন। এখান থেকেই তাঁর ক্রীড়া-জীবনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯১৫ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত সামাদ রংপুরের তাজহাট ক্লাবে খেলেন। সেসময়কার রংপুরের বিশিষ্ট ফুটবলার মহারাজ গোপাল লাল রায় এই ক্লাব তৈরি করলেও এই তাজহাট ক্লাব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এই ক্লাবের হয়ে কোচবিহারে সামাদ মোহনবাগান দলের বিপক্ষে খেলেছিলেন। এই ম্যাচে প্রথমার্ধে মোহনবাগানের কাছে এক গোল খেয়ে গোপাল রায় মরিয়া হয়ে ওঠেন। সামাদ তখন মজার ছলে বলেন যে- মহারাজ গোপাল রায়ের হাতের দামী ঘড়িটি পেলে তিনি গোল শোধ দিয়ে দেবেন। সেই ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে দুটি গোল করেছিলেন তিনি। ১৯১৬ সালে সামাদ ইংল্যাণ্ডের শক্তিশালী ফুটবল ক্লাব সমারসেটের হয়ে মাঠে খেলতে নামেন। এরপর ১৯১৮-তে কলকাতার ওরিয়েন্টস ক্লাবেও খেলেন তিনি। ১৯২১ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গল রেলওয়ে দলের হয়ে সামাদ ফুটবল খেলেন। ১৯২৭ সালে ইস্টবেঙ্গল দলের হয়ে তাঁর দেওয়া এক অভূতপূর্ব গোলে ইংল্যাণ্ডের ম্যাশউড ফরেস্ট ক্লাবের বিপক্ষে ইস্টবেঙ্গল জিতে যায়। ভারতীয় জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পান সামাদ ১৯২৪ সালে এবং দু বছর পরে অর্থাৎ ১৯২৬-এ ভারতীয় জাতীয় দলের অধিনায়ক হন তিনি।

জাতীয় দলের অধীনে খেলার সময় সামাদ বার্মা(মায়ানমার), সিলোন(শ্রীলঙ্কা), সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও(ইন্দোনেশিয়া), মালয়, সিঙ্গাপুর, হংকং, চীন এবং ইংল্যাণ্ডে ম্যাচ খেলতে যান। ১৯২৬ সালেই চীন সফরে চীনের বিপক্ষে চারটি গোল দিয়ে ৪-৩ গোলে ভারতীয় দলকে জয়ীর শিরোপা এনে দেন সামাদ। এই খেলায় ৩-০ গোলে পিছিয়ে থাকা ভারতীয় দলের পক্ষে সামাদের অসম্ভব কৃতিত্ব ছাড়া জয়ী হওয়া সম্ভব ছিল না। চীনের বিপক্ষে তাঁর ফুটবল ক্রীড়াশৈলী লক্ষ করে জনৈক স্কটিশ ক্রীড়াবিদ বলেছিলেন যে- সামাদ ইউরোপে জন্মালে খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বসেরার খেতাব পেতেন। আবদুস সামাদের ক্রীড়া-জীবন ছিল মাত্র ২৩ বছরের, ১৯১৫ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যেই তিনি আপামর ফুটবলপ্রেমীর চোখে অসামান্য দক্ষতার দৃষ্টান্ত রেখেছেন যা বাঙালির কাছে অত্যন্ত গর্বের।

১৯৩৩ সালে সামাদ ইংল্যাণ্ডের বিপক্ষে মাঠে নামেন এবং তাঁর অধিনায়কত্বে গ্রেট ব্রিটেন ৪-১ গোলে এবং ইউরোপীয় দল ২-১ গোলে পরাজিত হয়। এক কৃষ্ণাঙ্গ বাঙালির দেওয়া গোলে ইংল্যাণ্ড দলের এই পরাজয় প্রত্যক্ষ করে কলকাতার ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকা প্রতিবেদনে লিখেছিল – সামাদ যেন গঙ্গাজলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। ভারতীয় জাতীয় দলের হয়ে তিনি ইংল্যাণ্ডের ‘সার্ভিসেস ইলেভেন’ দলের বিরুদ্ধেই শেষ মাঠে নামেন। তারপরে ঐ বছরই সামাদ যোগ দেন কলকাতার মহামেডান ক্লাবে। ১৯৩৪-এ মহামেডানের হয়ে ফুটবলে প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে লিগ জয়ের খেতাব পান তিনি। এরপর কলকাতা সিনিয়র ডিভিশন লিগে মহামেডান পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়।

নিজের ক্রীড়া জীবনের অন্তিম লগ্নে এসেও স্বমহিমায় এবং একক কৃতিত্বে তিনি মহামেডানকে এই পাঁচবার চ্যাম্পিয়নশিপ এনে দিতে সমর্থ হন। সামাদের ক্রীড়া-নৈপুণ্যে মহামেডান আই.এফ.এ (IFA) শিল্ডও অর্জন করে। সামাদের দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা ছিল প্রশংসনীয়। ইন্দোনেশিয়ার জাভায় খেলা চলাকালীন বিপক্ষের খেলোয়াড়দের ড্রিবল করতে করতে গোলপোস্টের দিকে নিশানা করে দুরন্ত শট করলেও ক্রসবারে লেগে বল ফিরে আসে। এ ঘটনায় বিস্মিত সামাদ পুনরায় কিছুক্ষণের মধ্যেই আবারও একইভাবে শট মারেন। কিন্তু সেবারেও গোল না হওয়ায় রেফারির উদ্দেশে তিনি গোলপোস্টের উচ্চতা কম আছে জানিয়ে চ্যালেঞ্জ করেন। তাঁর কথার প্রেক্ষিতে সঠিকভাবে মেপে দেখা যায় যে সত্যিই গোলপোস্টটি স্বাভাবিক উচ্চতার থেকে চার ইঞ্চি নীচু। এমন অবিশ্বাস্য পরিমাপ ক্ষমতা ফুটবল জগতে সত্যিই বিরল। ১৯৪৪ সালে তিনি তাঁর ছেলে গোলাম হোসেনের সঙ্গে একসাথে ইস্টবেঙ্গল রেলওয়ে দলে খেলেন। কিশোর বয়স থেকে খেলতে খেলতে সামাদ যেন নিছক খেলোয়াড় নয়, হয়ে উঠেছিলেন একজন ফুটবল-শিল্পী। তিনি সাধারণত মাঠে লেফট-আউট পজিশনে খেলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় সামাদ দিনাজপুরের পার্বতীপুর বলে এক শহরে চলে আসেন স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে। পার্বতীপুর সেসময় পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত বৃহৎ রেলওয়ে শহর। এখানে রেলওয়ের চাকরি করতেন বলে রেলওয়ে কলোনিতে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট বাংলোয় স্ত্রী-পুত্র নিয়ে থাকতেন শেষজীবনে। ঢাকায় একটা প্রদর্শনী ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫১ সালে যেখানে তিনি আমন্ত্রিত ছিলেন। সরাসরি খেলায় অংশ না নিলেও সেই প্রদর্শনী ম্যাচে জার্সি পড়ে সারা মাঠে হেঁটে  ‘ফুটবলের জাদুকর’ সামাদ দর্শকদের মনোরঞ্জন করেন বলে জানা যায়। প্রচণ্ড দারিদ্র্যেই কেটেছে তাঁর শেষ জীবন।

১৯৫৭ সালে তাঁকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ফুটবল প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করে বাংলাদেশ সরকার। আর ১৯৬২-তে রাষ্ট্রপতি পদক দিয়ে পাকিস্তান সরকার তাঁকে সম্মানজ্ঞাপন করে। তাঁর মৃত্যুর ২৫ বছর পরে পার্বতীপুরের ইসলামপুর কবরস্থানে তাঁর সমাধিস্থলের কাছে ১৯৮৯ সালে একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়। এই সৌধ নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ৫২ হাজার টাকা। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশের ডাকবিভাগ সৈয়দ আবদুস সামাদের স্মৃতিতে একটি স্মারক ডাকটিকিট এবং একটি উদ্বোধনী খাম প্রকাশ করে। পার্বতীপুরেই পরে ‘সামাদ মিলনায়তন’ নামে একটি সভাঘর স্থাপিত হয়। তাছাড়া আবদুস সামাদের স্মৃতিরক্ষার্থে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন প্রতি বছর ‘জাদুকর সামাদ স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট’ আয়োজন করে।

১৯৬৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত বাংলার শ্রেষ্ঠ ফুটবলার সৈয়দ আবদুস সামাদের মৃত্যু হয়।

3 comments

আপনার মতামত জানান