ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তি পরিচালকদের মধ্যে অনতম একজন হলেন তপন সিংহ। কেবল বাংলা নয় বহু হিন্দি চলচ্চিত্রও আমরা তাঁর হাত ধরে উপহার পেয়েছি৷ বাংলা চলচ্চিত্রকে তিনি তাঁর নিজস্ব মুন্সিয়ানায় এক অনন্য মাত্রা দিয়েছিলেন।
১৯২৪ সালের ২ অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ত্রিদিবেশ সিংহ, মাতা প্রমিলা সিংহ। ষাটের দশকের পরিচালক তপন সিংহ ছিলেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনের সমসাময়িক।
১৯৪৬ সালে নিউ থিয়েটার এবং কলকাতা মুভিটোন ষ্টুডিওতে শব্দযন্ত্রী হিসাবে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। তারপর ১৯৫০ সালে তিনি ইংল্যান্ড চলে যান এবং প্রায় দুই বছর সেখানে পাইনউড্ স্টুডিওতে কাজ করেন। ভারতে ফিরে আসার পর পরিচালক রূপে তাঁর প্রথম ছবি ‘অঙ্কুশ’ যেটি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এর লেখা ‘সৈনিক’ গল্পের উপর ভিত্তি করে তৈরী করা। এরপর তিনি ‘উপহার’ ‘টনসিল’, ‘কাবুলীওয়ালা’, ‘লৌহ কপাট’, ‘কালা মাটি’ ‘ক্ষণিকের অতিথি’, ‘নির্জন সৈকতে’, ‘গল্প হলেও সত্যি্, ‘আপনজন’, ‘বাঞ্ছারামের বাগান’, ‘আজব গাঁয়ের আজব কথা’, ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’ ইত্যাদি বাংলা সিনেমা পরিচালনা করেন। রবিঠাকুরের লেখা ‘কাবুলিওয়ালা’ ছোট গল্পের উপর ভিত্তি করে ‘কাবুলিওয়ালা'(১৯৫৭) চলচ্চিত্রটি বাঙালি দর্শকদের মন জয় করে নেয়। এই ছবিটি শ্রেষ্ঠ ভারতীয় ছবি হিসেবে রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক এবং শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসেবে রৌপ্যপদক পায়। তপন সিংহের খ্যাতি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৫৮ সালে তপন সিংহ পরিচালিত ‘লৌহ-কপাট’ জরাসন্ধের লেখা জেল কয়েদিদের জীবনের করুণ আলেখ্য। ‘ক্ষণিকের অতিথি’ (১৯৫৯) মানবিক আবেদনে ভরপুর বিয়োগান্তক প্রেমের কাহিনী। ১৯৬১ সালে ‘ঝিন্দের বন্দি’ বাংলা সাহিত্যের সুপরিচিত সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার, অরুন্ধতী দেবী, সৌমিত্র চ্যাটার্জী, রাধামোহন ভট্টাচার্য, তরুণ কুমার, দিলীপ রায়, সন্ধ্যা রায়। উত্তম ও সৌমিত্র প্রথমবার এই সিনেমায় একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন এবং সৌমিত্র চট্টপাধ্যায় প্রথমবার এখানে ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ (১৯৬২) ছবিটিতে এত চরিত্র রয়েছে যে চরিত্র চিত্রায়ণই ছিল খুব কঠিন কাজ। তবে সে কাজও অসাধারণভাবে সম্পন্ন করেছিলেন তপন সিংহ। ১৯৮০ সালে মনোজ মিত্রের লেখা নাটক ‘সাজানো বাগান’ -অবলম্বনে তপন সিংহ ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ পরিচালনা করেন। এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে ছিলেন মনোজ মিত্র।
‘এক যে ছিল দেশ’ তপন সিংহের একটি ফ্যান্টাসি সিনেমা যেটি উনি নির্মান করেছিলেন সাহিত্যিক শংকর এর উপন্যাস অবলম্বনে। ১৯৮১ সালে তপন সিংহ পরিচালনা করেন ‘আদালত ও একটি মেয়ে’। কাহিনীকার তপনবাবু নিজেই। এটি একটি সামাজিক অবক্ষয়ের ছবি, ছবিটি শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।
১৯৯৪ সালে তপন সিংহ পরিচালনা করেন ‘হুইল চেয়ার’। হুইল চেয়ারে রয়েছে প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে অপরাজেয় মানুষের দুঃসাহসিক সংগ্রামের কাহিনী। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অক্ষমতার বিরুদ্ধে অসীম মনোবল নিয়ে লড়াই চালিয়ে বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজে নেওয়াই এই চলচ্চিত্রে উপজীব্য।
কেবল বাংলা নয় হিন্দি চলচ্চিত্র জগতেও তাঁর অবদান রয়েছে, ১৯৭৪ সালে তাঁর নিজের লেখা গল্প ‘সফেদ হাতি’ নামে ছোটদের জন্য একটি সিনেমা নির্মাণ করেন। এছাড়া ‘আদমি আউর অউরত’ (১৯৮৪), ‘আজ কা রবিনহুড’ (১৯৮৭), ‘এক ডক্টর কি মউত’ (১৯৯১), ‘আনোখা মোতি’ (২০০০) উল্লেখযোগ্য।
কমার্শিয়াল চলচ্চিত্রের ধারায় তাঁর চলচ্চিত্র অন্য খাতে বয়েছে চিরকাল। সমাজের অন্য এক আঙ্গিক ফুটে ওঠে তাঁর চিত্রায়ণে, সাধারণ স্ক্রীপ্টও অসাধারণ ভঙ্গিমায় আলো পেয়েছে তাঁর চিত্রায়ণে।
তপন সিংহ বহু বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। যে সমস্ত সিনেমার জন্য পুরস্কার লাভ করেছেন সেগুলি হল, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘লৌহকপাট’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘অতিথি’, ‘হাটে বাজারে’, ‘আপনজন’, ‘এক ডক্টর কি মওত’। তপন সিংহ ভারতীয় ছবির জন্য রাষ্টপতির স্বর্ণ পদক পেয়েছেন একাধিকবার । ২০০৬ সালে তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯২ সালে তিনও পদ্মশ্রী পুরস্কার পান। এছাড়া বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কারও রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। স্বাধীনতার ষাট বছরে ‘লাইফ টাইম আ্যচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয় তাঁকে। এত পুরস্কার এত সমাদর পেলেও তাঁর শেষ জীবন ছিল নিঃসঙ্গতায় ভরা। নিঃসঙ্গ জীবনের এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “এখন কী ভাল লাগে জানো, বিকেলবেলা একান্তে বসে শুধু ‘গীতবিতান’-এর পাতা উল্টে যেতে। বারান্দায় বসে গীতবিতানের গান গুনগুন করি। কোনওটায় সুর আসে, কোনওটায় আসে না।…এখন যে রবীন্দ্রনাথই আমার আশ্রয়।” তাঁর স্ত্রী অরুন্ধতী ছেলের কাছে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন অনেক আগেই। কলকাতার নিউ আলিপুরের তিন তলা বাড়িতে তিনি একলা, শ্বাস কষ্ট আর বুকে পেস মেকার নিয়ে শেষ জীবনটা কেটেছে তাঁর। ২০০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি তপন সিংহের মৃত্যু হয়। চলচ্চিত্র প্রেমীদের কাছে তিনি তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকবেন চিরকাল।
One comment