অকালবোধন কথার অর্থ হল অসময়ে দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে আহ্বান করা। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী শ্রীরামচন্দ্র সীতাকে উদ্ধারের জন্য শরৎকালে দেবী দুর্গার পূজা করে অকালে তথা অসময়ে দেবীকে জাগ্রত করেছিলেন বলে এই পূজা অকালবোধন নামে পরিচিত। শাস্ত্রমতে একমাত্র বসন্তকাল দুর্গাপূজার উপযুক্ত সময়।পৌরাণিক বর্ণনা অনুযায়ী সূর্যবংশীয় রাজা সুরথ বসন্তকালে চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী ও নবমী তিথিতে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। বসন্তকালে দুর্গাপূজার প্রচলন হয় বলে এই পূজা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত। বসন্তকালে মর্তে দেবী দুর্গার প্রথমবার পূজা করা হয়েছিল বলে দেবী বাসন্তিকা নামেও পরিচিত। কিন্তু এখনকার সময় এই অকালবোধন পূজা বা শারদীয়া দুর্গাপূজাই অধিকতর প্রচলিত। জেনে নেওয়া যাক এই অকালবোধন প্রথার আড়ালে থাকা পৌরাণিক কাহিনীটি।
শ্রীরামচন্দ্র যখন সীতা এবং লক্ষণকে নিয়ে বনবাসী হয়েছিলেন, তখন লঙ্কেশ্বর রাবণ একদিন সীতাকে হরণ করে অশোক বনে লুকিয়ে রাখেন। এই সময়টা ছিল স্বর্গের দেবীগণের নিদ্রাগমনের সময়, অর্থাৎ যখন বৃষ্টি হওয়ার আর সম্ভাবনা থাকে না। সীতা হরণ হওয়ায় রাম বিভিন্ন দেবদেবীর শরণাপন্ন হচ্ছিলেন কীভাবে সীতাকে উদ্ধার করা যায়। তখন ভগবান ব্রহ্মা শ্রীরামচন্দ্রকে মা দুর্গার উপাসনার কথা বলেন। মা দুর্গাই শক্তির আধার। শক্তির বিভিন্ন রূপে তিনি পূজিত হন। কখনও তিনি মহিষাসুরমর্দিনী, কখনও দুর্গতিনাশিনী, কখনও জগৎজননী আবার কখনও ধনধান্যে পূর্ণদায়িনী।
রাম সেইমত শরৎকালেই দেবীর পূজার ব্যবস্থা করলেন। দুর্গাপূজার উপকরণ হিসাবে প্রধান উপকরণ হল সর্বমোট ১০৮টি নীলপদ্ম। কিন্তু এই নীলপদ্ম মর্ত্যে পাওয়া খুব মুশকিল। কিন্তু অসময়ে দেবীকে জাগ্রত করা হচ্ছে যখন, তখন পূজার প্রধান সামগ্রী তো চাইই। অনেক খোঁজার পর অবশেষে ব্রহ্মসরোবর থেকে নীলপদ্ম জোগাড় হল। এদিকে আবার রাবণ ছিল মা দুর্গার নিত্য পূজারী। তাই দুই ভক্তের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে, তা পরীক্ষা নিতে রামের আনা ১০৮টি নীলপদ্মের মধ্যে মা দুর্গা একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখলেন। পূজার সব আয়োজন করে যখন রাম আসনে বসেন তখন দেখেন যে একটি পদ্ম নেই। পূজার আসনে বসে পূজা ছেড়ে যাওয়া যাবে না তাই রাম অনেক ভেবে অবশেষে ঠিক করেন নিজের নীলরঙের একটি চোখ দিয়েই একটি নীলপদ্মের অভাব দুর করবেন। সেই অনুযায়ী তীর দিয়ে নিজের একটি চোখ উপড়ে ফেলার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, তখন মা দুর্গা এসে তাকে বাধা দেন এবং তার ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে তাকে যুদ্ধে জয়লাভের বর দেন।
তবে গবেষকদের মতে, রাম কখনই দুর্গাপূজা করেননি। প্রথমেই যেটা বলা দরকার সেটা হলো বাল্মীকি রামায়ণে কোথাও অকালবোধনের উল্লেখ নেই। অকালবোধন পুরোটাই কৃত্তিবাস বর্ণিত কাহিনী। বাল্মীকি রামায়ণে দেখা যায়, শরৎকালে দেবীপূজা করে রাবণবধের কোনো প্রশ্নই ওঠে না কারণ রাবণ বধের সময় রামের বয়স ছিল আটত্রিশ বছর দশ মাস। চৈত্র্যের শুক্লা নবমী তিথিতে যাঁর জন্ম, সেই রাম কীভাবে শরৎকালে আটত্রিশ বছর দশ মাস পূর্ণ করবেন? এই থেকেই প্রমান হয় বাল্মীকি বর্ণিত রাম কখনই দুর্গাপূজা করেননি, কারণ রাম রাবণ বধ করেছেন মাঘের হাড় কাঁপানো শীতে।
তবে, শরৎকালে দুর্গাপূজাটা কৃত্তিবাসের মনগড়া নয়, শুধু রামের অকালবোধন ব্যাপারটাই মনগড়া ছিলো। কারণ, শরৎকালে দুর্গাপূজা কংসনারায়ণ প্রথম না করলেও তিনি যে দুর্গাপূজা করেছিলেন সেটা শরৎকালেই ছিল। কৃত্তিবাস শরতের পুজোর ধারণাটা সেখান থেকেই পেতে পারেন। এমন কি মল্লরাজারাও ৯৯৭ সাল থেকে বিষ্ণুপুরে মহিষমর্দিনীর মূর্তি ও মন্দির গড়ে শরৎকালে বাৎসরিক দেবীপুজো করে আসছেন।
এই নিয়ে বিস্তারিত শুনতে পারেন এখানে
তথ্যসূত্র
- শারদীয়া পূজাবার্ষিকী ভাগ্যফল ২০১৭
- ভাগ্যফল ২০১৩, অক্টোবর সংখ্যা
- দুর্গোৎসবের উৎস সন্ধানে, অব্জ কেশব কর, দে'জ পাবলিশিং
- https://bn.wikipedia.org/wiki/অকালবোধন
One comment