শেখর বসু

শেখর বসু

শেখর বসু (Shekhar Basu) হলেন ভারতের একজন প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী। তিনি দীর্ঘসময় পরমাণু শক্তি কমিশনের (Atomic Energy Commission) চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর থেকে ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারত সরকারের অধীনস্থ পরমাণু শক্তি বিভাগে (Department of Atomic Energy) সেক্রেটারির দায়িত্ব সামলেছেন। ২০১২ সালের ১৯ জুন থেকে ২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী এই দীর্ঘ সময় তিনি ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারে (Bhabha Atomic Research Centre) ডাইরেক্টর ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানেই তিনি নিউক্লিয়ার সাবমেরিন প্রোগ্রামে (Nuclear Submarine Programme) প্রজেক্ট ডাইরেক্টর এবং নিউক্লিয়ার রিসাইকেল বোর্ডে (Nuclear Recycle Board) প্রধান এক্সিকিউটিভ পদে কাজ করেছেন। তিনি ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে ভূষিত। ভারতের প্রথম পরমাণু সাবমেরিন ‘আইএনএস অরিহন্ত’-এর মূল স্থপতি ছিলেন তিনি।

১৯৫২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বিহারের মুজঃফরপুর জেলায় তাঁর জন্ম হয়। কলকাতায় বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি মুম্বাই পাড়ি দেন। মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বীরমাতা জিজাবাঈ টেকনোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট (Veermata Jijabai Technological Institute) থেকে ১৯৭৪ সালে তিনি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক হন।

১৯৭৫ সালে তিনি বিখ্যাত ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটে রিঅ্যাক্টর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে যোগ দেন। একবছরের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হলে সেখানে তিনি নিউক্লিয়ার সাবমেরিন প্রোপালসান প্লান্ট (Nuclear Submarine Propulsion Plant) তৈরির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি তারাপুর, মহারাষ্ট্র, কালপক্কম ও তামিলনাড়ুতে পুনর্নবীকরণযোগ্য নিউক্লিয়ার প্লান্ট তৈরিতে জড়িত ছিলেন। ভারতে নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের সশক্তিকরণে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। দেশকে পরমাণু শক্তিতে বলীয়ান করার জন্য তিনি নিরলস চেষ্টা করেছেন। তাঁর কৃতিত্বেই ভারতে পরমাণু শক্তির চর্চা ত্বরানিত হয়। ২০১৭ সালের মে মাসে ভারত সরকার পরমাণু শক্তি বিভাগকে ১০টি প্রেসারাইজড হেভি-ওয়াটার রিঅ্যাক্টর (Pressurised heavy-water reactors) ও ২টি প্রেসারাইজড ওয়াটার রিঅ্যাক্টর (Pressurised water reactor) তৈরির অনুমতি দেন। এই সিদ্ধান্ত ভারতকে পরমাণু শক্তিতে সুদৃঢ় করে এবং এর ফলে ভারতে সর্বমোট ২১টি রিঅ্যাক্টর নির্মিত হয়। তাঁর তত্ত্বাবধানেই ভারতের কালপক্কমে অত্যাধুনিক প্রোটোটাইপ ফাস্ট ব্রিডার রিঅ্যাক্টর (Prototype Fast Breeder Reactor) নির্মিত হয়। ভারতে পরমাণু শক্তি বিভাগের দ্বারা ইউরেনিয়াম উত্তোলনে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। পরমাণু শক্তি বিভাগের নির্দেশে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প তাঁর দ্বারা রূপায়িত হয়। এর মধ্যে কুদানকুলাম নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে বাণিজ্যিক শক্তি নির্মাণের জন্য দ্বিতীয় ১০০০ এমডব্লিউই (MWe) নিউক্লিয়ার পাওয়ার রিঅ্যাক্টরের প্রতিষ্ঠা অন্যতম। ২০১৭ সালের জুন মাসে দুটি নিউক্লিয়ার পাওয়ার রিঅ্যাক্টর যথাক্রমে এনপিপি ৩ এবং ৪-এর নির্মাণ কাজ তাঁর মাধ্যমেই শুরু হয়।

শেখর বসুর তত্ত্বাবধানে ছ’টি হাসপাতালের উন্নয়ন কাজও সম্ভব হয়েছিল যার দ্বারা প্রায় দেড় লক্ষ রোগীর চিকিৎসার পথ খুলে যায়। ক্যান্সার চিকিৎসায় এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি ঘটে। ২০১৭ সালের মে মাসে শেখর বসুর তত্ত্বাবধানে বিহারের মুজঃফরপুর জেলার মুশাহারিতে জাতীয় লিচি রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (National Litchi Research Institute) লিচি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মিত হয়। এই প্ল্যান্টে ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারে নির্মিত টেকনোলজ্যির মাধ্যমে ষাট দিন পর্যন্ত লিচু সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। লিচুর ব্যবসায় এই প্রকল্প নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে। গুজরাটের আহমেদাবাদে তাঁর তত্ত্বাবধানে ভারতের প্রথম বর্জ্য আবর্জনা থেকে সার তৈরির প্ল্যান্ট নির্মিত হয়েছিল। এখানে প্রতিদিন একশো টন বর্জ্যের শোধন ও সার তৈরি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। রেডিয়েশন টেকনোলজ্যির মাধ্যমে এই শোধন প্রক্রিয়া চলে যা পরিবেশ সংরক্ষণে যথেষ্ঠ গুরুত্ববাহী। অন্যান্য শহরও এর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে এই কাজ শুরু হয়। বিজ্ঞানের বৃহৎ প্রকল্পসমূহ যেমন উচ্চশক্তিসম্পন্ন সুপার কানেক্টিং অ্যাকসিলেরেটর (high energy Superconducting Accelerators), লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরি বা লিগো (Laser Interferometer Gravitational wave Observatory or LIGO), ইন্টারন্যাশনাল থার্মোনিউক্লিয়ার এক্সপেরিমেন্টাল রিঅ্যাক্টর বা আইটার (International Thermonuclear Experimental Reactor or ITER) ইত্যাদি শেখর বসুর নেতৃত্বেই ত্বরান্বিত হয়। বর্তমানেও তিনি কৌশলভিত্তিক বিভিন্ন প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত রয়েছেন।

সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে তিনি পরমাণু শক্তি বিভাগের সহায়তায় বিভিন্ন প্রয়াস নিয়েছেন। ২০১৭ সালের ২৬শে জানুয়ারী ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে তিনি পরমাণু শক্তি বিভাগের মাধ্যমে ট্যুইটারে পরমাণু শক্তি সম্পর্কে প্রচার শিবির আয়োজন করেন। স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া স্কিল ইন্ডিয়া (Startup India Skill India) প্রোগ্রামের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে স্পিন-অফ প্রযুক্তিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে তিনি দেশ জুড়ে উদীয়মান উদ্যোক্তাদের অনুপ্রাণিত করেন।

শেখর বসু তাঁর অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ২০০২ সালে ভারতের নিউক্লিয়ার সোস্যাইটি (Indian Nuclear Society) দ্বারা সম্মানিত হন। ভারতের পরমাণু শক্তি বিভাগ তাঁকে ২০০৬ ও ২০০৭ সালে পুরস্কৃত করে। তিনি ভারতের জাতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাকাডেমি (Indian National Academy of Engineering or INAE) এবং ইন্ডিয়ান সোস্যাইটি ফর নন-ডেসট্রাক্টিভ টেস্টে (Indian Society for Non-Destructive Testing or ISNT) ফেলো নির্বাচিত হন। ভারত সহ অন্যান্য দেশের আটটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেটে ভূষিত করে। ২০১৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ২০১৪ সালে ভারত সরকার তাঁকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কার প্রদান করে।

২০২০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান