নবাবহাটের ১০৮ শিব মন্দির

বর্ধমানের ১০৮ শিব মন্দির

পূর্ব বর্ধমান জেলার বর্ধমান শহরের নবাবহাট বাসস্ট্যান্ডের কাছে ১০৮ শিব মন্দির অবস্থিত। সমগ্র ভারতের মধ্যে মাত্র দুটি জায়গায় এই ধরনের মন্দির আছে। তার মধ্যে একটি হল এই নবাবহাটের ১০৮ শিব মন্দির । নামে ১০৮ মন্দির হলেও এখানে মোট ১০৯ টি মন্দির দেখতে পাওয়া যায়।

এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বর্ধমান রাজপরিবারের নাম। আজ থেকে ২০০ বছরেরও বেশি আগে অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় দশকে বর্ধমান শহরে শুরু হয় এক ভয়ানক মহামারী। এই মহামারীর কবলে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। সেই সময় এখানকার শাসনভার ছিল মহারাজ তিলকচাঁদের স্ত্রী মহারাণী বিষ্ণুকুমারীর হাতে। মহারাজ তিলকচাঁদ যখন মারা গিয়েছিলেন, তখন তাঁর ও রাণী বিষ্ণুকুমারীর ছেলে ছিল নাবালক। তাই রাণী নিজেই সিংহাসনে বসেন ও রাজ্য পরিচালনার ভার নিজের হাতে তুলে নেন। মহামারীতে বহু প্রজার মৃত্যু এবং বাকিদের দুর্দশা দেখে মহারাণী বিষ্ণুকুমারীর মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তিনি তখন সিদ্ধান্ত নেন, প্রজাদের মনে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি জাগিয়ে তুলে তাদের শোক থেকে মুক্ত করবেন। রাণীর এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই বর্ধমান শহরে শুরু হয় ১০৮ শিব মন্দির তৈরির কাজ।

১৭৮৮ সালে এই মন্দির তৈরি করার কাজ শুরু হয়। দুই বছর পরে অর্থাৎ ১৭৯০ সালে শেষ হয় মোট ১০৯টি শিব মন্দিরের নির্মাণ। বিশাল আড়ম্বর ও ধুমধাম করে মন্দিরগুলি প্রতিষ্ঠা করেন মহারাণী বিষ্ণুকুমারী। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে, শেষ মন্দিরটি অর্থাৎ ১০৯তম মন্দিরটির প্রতিষ্ঠার সময় মন্দির প্রাঙ্গণে নাকি এক লক্ষ সাধু ও মহাত্মার সমাবেশ হয়েছিল। এই সমস্ত সাধুদের পায়ের ধুলো একটি সোনার কলসীতে সংগ্রহ করে রেখেছিলেন রাজপরিবারের সদস্যরা।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

নবাবহাটের ১০৮ শিব মন্দির এর প্রবেশদ্বার পশ্চিমমুখী। প্রবেশ পথের সামনেই তৈরি করা হয়েছে একটি কৃত্রিম পাহাড়। সেই পাহাড়ের সামনে আছে বেশ বড় আকারের শিব ও পার্বতীর মূর্তি। আছে বজরংবলীর মূর্তিও। মূল মন্দিরের ভিতরে ঢুকলে চোখে পড়ে দুইটি সারিতে মালার মতো সাজানো একশো আটটি শিব মন্দির। এই সারি দুটি থেকে কিছুটা দূরে জপমালার ‘মেরু’ চিহ্নের মত আছে আরো একটি শিব মন্দির। অর্থাৎ মোট ১০৯টি মন্দির আছে এখানে। প্রতিটি মন্দিরই নির্মিত হয়েছে ওড়িশার বালেশ্বর শিব মন্দিরের আটচালা নকশার আদলে। মন্দিরের গায়ে সামান্য টেরাকোটার কাজ আছে। মন্দিরগুলি একে অপরের সঙ্গে পুরোপুরি লাগানো, দুটি মন্দিরের মধ্যে একটুও ফাঁক দেখা যায় না। প্রতিটি মন্দিরের সামনেই আছে খোলা টানা চাতাল। শোনা যায়, মন্দির প্রতিষ্ঠার সময়ে প্রত্যেকটি মন্দিরের গা ঘেঁষে একটি করে বেলগাছ লাগানো হয়েছিল। দর্শনার্থীরা মন্দির সংলগ্ন বেলগাছগুলির পাতা দিয়েই শিবের পুজো করতেন। তবে এখন আর বেলগাছগুলির অস্তিত্ব নেই। মন্দিরের ডানদিকে আছে একটি দোতলা বাড়ি। এখানে বাইরে থেকে আসা তীর্থযাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা আছে। বাঁদিকে আছে একটি সুন্দর বাগান। মন্দিরের পিছনে পূর্বদিকে আছে একটি জলাশয়। এটির আকার পুরোপুরি গোল নয়, বরং কিছুটা লম্বাটে ধরনের। জল অতটা স্বচ্ছ নয়, কিছুটা ঘোলা প্রকৃতির। এটির পাড় বাঁধানো এবং লোহার জাল দিয়ে ঘেরা। মন্দির চত্বরের মধ্যে এক জায়গায় একটি লোহার ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা আছে ১০৮টি ঘণ্টা। মাঝারি সাইজের ঘণ্টাগুলি পিতলের তৈরি। ভক্তেরা প্রতিটি মন্দিরে পুজো দিয়ে এসে ঘণ্টাগুলি বাজান। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে, মহাদেবের পুজো দিয়ে এসে এই ঘণ্টাগুলি বাজালে ভক্তদের মনের সব ইচ্ছা পূর্ণ হয়।

রাণীর বানানো মন্দিরগুলি এক সময় বয়সের ভারে জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তাই ১৯৬৫ সালে বিড়লা জনকল্যাণ ট্রাস্টের আর্থিক সহায়তায় মন্দিরগুলি সংস্কার করা হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে বর্ধমানের মহারাজাধিরাজ উদয়চাঁদ মহতাব গঠিত অছি পরিষদ বর্তমানে এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ, নিত্যপুজো ও সেবাকার্যের দায়িত্বে রয়েছে।

১০৯টি মন্দিরের প্রতিটির ভিতরে আছে একটি করে কালো কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ। শিবলিঙ্গগুলির সঙ্গে যুক্ত আছে গৌরীপট্ট।
এই মন্দিরে প্রতিদিনই অনেক ভক্ত পুজো দিতে আসেন। এমনকী ভিন রাজ্য থেকেও অনেক দর্শনার্থী আসেন এই স্থানে। তবে মহাশিবরাত্রির সময় এখানে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়। সবাই প্রতিটি শিবলিঙ্গের মাথায় দুধ ও গঙ্গাজল ঢেলে বেলপাতা দিয়ে পুজো করেন। এই সময় এখানে মেলা বসে যেটি সাতদিন ধরে চলে। চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে চড়ক পূজাও এখানে বড় করে পালিত হয়। শ্রাবণ মাসের সোমবারেও এখানে অনেক ভক্ত পুজো দিতে আসেন।

One comment

আপনার মতামত জানান