অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith) একজন বিশ্বখ্যাত স্কটিশ দার্শনিক এবং অর্থনীতিবিদ যিনি রাজনৈতিক অর্থনীতি তত্ত্বের জনক এবং একইসঙ্গে স্কটল্যান্ডের নবজাগরণের এক অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তাঁকে অনেকেই ‘অর্থনীতির জনক’ তথা ‘পুঁজিবাদের জনক’ বলে থাকেন। তাঁর লেখা ‘ওয়েলথ অফ নেশন’ বইটি আধুনিক যুগের অর্থনীতি চর্চার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠতম বলে মনে করা হয়। শ্রম ও শ্রম-বন্টন, মূল্যের তত্ত্ব কিংবা পরম সুবিধার তত্ত্বেরও (Absolute Advantage) জনক অ্যাডাম স্মিথ। দর্শনের ক্ষেত্রে তিনি মানুষের নৈতিকতা সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিয়েছেন। আধুনিক ঔপনিবেশিক যুগে মুক্ত বাজার তত্ত্বের প্রবর্তন করেন অ্যাডাম স্মিথ।
১৭২৩ সালের ৫ জুন স্কটল্যান্ডের ফাইফ প্রদেশের কার্কক্যাল্ডিতে অ্যাডাম স্মিথের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নামও ছিল অ্যাডাম স্মিথ যিনি একজন স্কটিশ লেখক, আমদানি-রপ্তানির নিয়ন্ত্রক এবং একজন বিচারক ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল মার্গারেট ডগলাস। স্মিথের জন্মের দুই মাস আগেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর বাবা মারা যান। বলা হয় ১৭২৩ সালের ৫ জুন তারিখেই অ্যাডাম স্মিথ খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হন। মাত্র তিন বছর বয়সে ইন্দো -আর্য যাযাবর জাতি রোমানি কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন স্মিথ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাঁকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
প্রাথমিকপর্বে ১৭২৯ থেকে ১৭৩৭ সাল পর্যন্ত কার্কক্যাল্ডির বার্গ স্কুলে পড়াশোনা করেন অ্যাডাম স্মিথ। সেখানে ইতিহাস, গণিত এবং লিখনশৈলী শিখেছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে ১৪ বছর বয়সে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। সেখানে ফ্রান্সিস হাচিসনের অধীনে তিনি নৈতিক দর্শন বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। এখানেই স্বাধীনতা, যুক্তিবাদ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। ১৭৪০ সালে স্নাতক উত্তীর্ণ হয়ে অক্সফোর্ডের ব্যালিওল কলেজে ভর্তি হন স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনার জন্য। তবে অক্সফোর্ডের অধ্যাপকদের খুব একটা ভাল চোখে দেখেননি তিনি, তাঁদের ব্যবহার, শিক্ষণ-দক্ষতা সম্পর্কে খুশি ছিলেন না স্মিথ। একবার ক্লাসের মধ্যে ডেভিড হিউমের লেখা ‘এ ট্রিটিজ অফ হিউম্যান নেচার’ বইটি পড়ার কারণে সেই বই অক্সফোর্ডের অধ্যাপকেরা বাজেয়াপ্ত করে নেন এবং বইটি পড়ার জন্য স্মিথকে শাস্তিও দেওয়া হয়। তবে অক্সফোর্ডে পড়ার সময় বিশাল বোদলেয়ান গ্রন্থাগারে বহু বইপত্র পড়েই দিন কাটাতেন তিনি। কিন্তু এরই মাঝে স্নায়ু-সমস্যার কারণে ১৭৪৬ সালে অক্সফোর্ড ত্যাগ করেন তিনি। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফ্রান্সিস হাচিসনের ব্যক্তিত্ব, তাঁর মেধার প্রাখর্যের প্রতি যারপরনাই আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। ফলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও তাঁরই মত অধ্যাপকদের খুঁজে পেতে চাইতেন স্মিথ। কিন্তু হাচিসনের বিকল্প কাউকেই পাননি তিনি।
১৭৪৮ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন অ্যাডাম স্মিথ। লর্ড কেমসের পৃষ্ঠপোষকতায় এডিনবরার ফিলোজফিক্যাল সোসাইটি এই বক্তৃতাসভার আয়োজন করেছিল। ছন্দ-অলঙ্কার এবং বিশেষ ধরনের লিখনশৈলীর বিষয়েই সেখানে বক্তব্য রাখেন স্মিথ। পরে ঐশ্বর্যের অগ্রগতি বিষয়েও বক্তব্য রাখেন তিনি। দার্শনিক ডেভিড হিউমের সাথে স্মিথের প্রথম পরিচয় হয় ১৭৫০ সালে। পরবর্তীকালে হিউম এবং স্মিথ ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, ধর্ম, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে তাঁদের লেখায় গুরুত্বপূর্ণ মতামত রাখেন। ১৭৫১ সালে স্মিথ যুক্তিশাস্ত্র (Logic) পড়ানোর জন্য অধ্যাপক হিসেবে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত হন। এর পরের বছরই ১৭৫২ সালে তিনি এডিনবরার ফিলোজফিক্যাল সোসাইটির সদস্য হন। সেখানেই লর্ড কেমসের সঙ্গে পরিচিত হন তিনি। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নৈতিক দর্শনের অধ্যাপক মারা গেলে, অ্যাডাম স্মিথ সেই জায়গায় অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন। পরবর্তী ১৩ বছর ধরে এই পদে অধ্যাপনা করেন তিনি। এই অধ্যাপনার সময়পর্বটিকে তিনি তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ১৭৫৯ সালে গ্লাসগো-তে দেওয়া কিছু বক্তৃতার সংকলন করে অ্যাডাম স্মিথ প্রকাশ করেন ‘থিওরি অফ মর্যাল সেন্টিমেন্টস’ নামে একটি বই। এই বইতেই তিনি নৈতিক অনুভূতির মূল ভিত্তি হিসেবে পারস্পরিক সহানুভূতির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি এও বলেন যে মানুষের নৈতিকতা নির্ভর করে সহানুভূতির উপর। এই বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে যায় যে অন্যান্য প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে ছাত্র-ছাত্রীরা গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মিথের অধীনে পড়াশোনা করার জন্য ভর্তি হতে শুরু করে। এরপরের একটি বক্তৃতায় অ্যাডাম স্মিথ বলেন যে শ্রমের মাধ্যমেই জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি পায় এবং কোনও দেশের বাণিজ্যের মূল ভিত্তি হল সেই দেশের সঞ্চিত সোনা বা রূপো। ১৭৬২ সালে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অ্যাডাম স্মিথ ডক্টর অফ ল’স ওরফে এলএলডি উপাধি পান। ১৭৬৩ সালের শেষ দিকে চার্লস টাউনসেন্ড তাঁর সৎ পুত্র হেনরি স্কটকে পড়ানোর জন্য অ্যাডাম স্মিথকে নিযুক্ত করেন। ১৭৬৪ সালে গৃহশিক্ষকতা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেন স্মিথ।
এই গৃহশিক্ষকতার সুবাদেই হেনরি স্কটের সঙ্গে স্মিথ সমগ্র ইউরোপ ভ্রমণ করেন এবং এই সময়েই শিষ্টাচার, আচার-ব্যবহার বিষয়ে নানাভাবে স্কটকে শিক্ষিত করেন তিনি। প্রতি বছর সমস্ত খরচা বাদে স্মিথকে ৩০০ পাউন্ড বেতন এবং ৩০০ পাউন্ড পেনশন দেওয়া হত। প্রথমে গৃহশিক্ষকতার জন্য তিনি ফ্রান্সের টুলোউসে (Toulouse) যান এবং সেখানে প্রায় দেড় বছর সময় কাটান। এরপরে তাঁরা চলে আসেন জেনেভায় যেখানে স্মিথের সঙ্গে পরিচয় হয় ভলতেয়ারের। জেনেভা থেকে আবার তাঁরা যখন প্যারিসে যান, সেখানে অ্যাডাম স্মিথ দেখা করেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের সঙ্গে। ১৭৬৬ সালে হেনরি স্কটের ছোট ভাই মারা গেলে স্মিথের এই ভ্রমণপর্ব সমাপ্ত হয়। এরপরে কার্কক্যাল্ডিতে ফিরে এসে অ্যাডাম স্মিথ তাঁর শ্রেষ্ঠতম বইটি লেখার কাজে মনোনিবেশ করেন। ১৭৭৩ সালে রয়্যাল সোসাইটি অফ লন্ডনের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি এবং ১৭৭৫ সালে তিনি লিটারারি ক্লাবের সদস্য হন। ১৭৭৬ সালে প্রকাশ পায় তাঁর বিখ্যাত বই ‘ওয়েলথ অফ নেশন’ এবং মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই প্রথম সংস্করণের সমস্ত কপি নিঃশেষিত হয়ে যায়। বইটির সম্পূর্ণ নাম ছিল ‘অ্যান এনকোয়ারি ইনটু দ্য নেচার অ্যান্ড কসেস অফ দ্য ওয়েলথ অফ নেশনস’। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, আইনশাস্ত্র, নৈতিকতা, ইউরোপের অর্থনীতির ইতিহাস, কৃষি ও শহরায়ন, বাণিজ্যবাদের সমালোচনা, কর-ব্যবস্থা, অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিপুণভাবে এই বইয়ে আলোচনা করেছেন অ্যাডাম স্মিথ। ১৭৭৮ সালে স্কটল্যান্ডে কমিশনার অফ কাস্টমস পদে নিযুক্ত হন তিনি। এর পাঁচ বছর পরে এডিনবরার ফিলোজফিক্যাল সোসাইটির সদস্য হিসেবে তিনি রয়্যাল সোসাইটি অফ এডিনবরার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হন। ১৭৮৭ থেকে ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানীয় লর্ড রেক্টর পদে বহাল ছিলেন অ্যাডাম স্মিথ।
স্মিথ মনে করেন যে কোনও জাতির সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলে রয়েছে সেই জাতির সামগ্রিক শ্রম যা মূলত উৎপাদনশীল এবং অনুৎপাদনশীল এই দুই ভাগে বিভক্ত। শ্রমের পাশাপাশি শ্রম-বন্টনের কথাও ভেবেছিলেন স্মিথ। তাঁর মতে, শ্রম-বন্টন যেমন শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে, উৎপাদনের গতি বৃদ্ধি পায়, শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি করে, সেক্ষেত্রে অন্যদিকে শ্রম-বণ্টনের ফলে শ্রমিকদের চিন্তাশীলতার কোনও জায়গা থাকে না এবং একঘেঁয়েমি তৈরি করে। কোনও দেশের সম্পদ নির্ভর করে শ্রম-বন্টনের উপর আর সেই শ্রম-বন্টন নিয়ন্ত্রিত হয় মূলধন দ্বারা। এছাড়া অ্যাডাম স্মিথই প্রথম কোনও পণ্যের দুই ধরনের মূল্যের কথা বলেন – একটি বিনিময় মূল্য এবং অন্যটি ব্যবহারিক মূল্য। সর্বোপরি তিনি এও বলেন যে কোনও পণ্য উৎপাদনে যত বেশি শ্রম লাগে, সেই পণ্যের মূল্যও তত বেশি হওয়া উচিত। ‘অবাধ বাণিজ্য নীতি’ স্মিথের আলোচিত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর এই অবাধ বাণিজ্য বা মুক্ত বাজার কোনওভাবেই অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপকে অস্বীকার করে। দীর্ঘ আট বছর ধরে লেখা এই বইকে অনেকে অর্থনীতির বাইবেল হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।
১৭৯০ সালের ১৭ জুলাই এডিনবরার পানমুর হাউসে অ্যাডাম স্মিথের মৃত্যু হয়।