আমেরিগো ভেসপুচি

আমেরিগো ভেসপুচি

দুঃসাহসিক অভিযান এবং নতুন দেশ আবিষ্কারের প্রসঙ্গ উঠলে অনেক সফল অভিযাত্রীর কথা আসে। সেই তালিকায় কলম্বাসদের সঙ্গেই উপরদিকে স্থান পাওয়ার যোগ্য হলেন ইতালীয় বণিক, অভিযাত্রী এবং মানচিত্র নির্মাতা আমেরিগো ভেসপুচি (Amerigo Vespucci)। সর্বপ্রথম এক জার্মান মানচিত্রকার এই আমেরিগো ভেসপুচির নাম অনুসারেই মানচিত্রে একটি নতুন আবিষ্কৃত ভূখন্ডকে চিহ্নিত করতে আমেরিকা শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ভেসপুচি মূলত দুটি সমুদ্রযাত্রায় বর্তমান দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব উপকূল অন্বেষণ করেছিলেন এবং নবাবিষ্কৃত আমেরিকার নাম তিনি রেখেছিলেন নতুন বিশ্ব। ওয়েস্ট ইন্ডিজ যে এশিয়ার অংশ ছিল না আমেরিগো ভেসপুচি প্রথম তা উপলব্ধি করেছিলেন। দক্ষিণ আমেরিকার অভ্যন্তরের কিছু অংশের ম্যাপ তিনি নির্মাণ করেছিলেন এবং কয়েকটি দ্বীপ ও নদীও আবিষ্কার করেন। আমাজন নদীর সূচনাস্থলটিও ভেসপুচির আবিষ্কার।

১৪৫৪ সালের ৯ মার্চ ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে আমেরিগো ভেসপুচির জন্ম হয়। এই শহর তখন রেনেসাঁর অন্যতম কেন্দ্র ছিল। আমেরিগোর পিতা নাস্তাজিও ভেসপুচি ছিলেন মানি-চেঞ্জার গিল্ডের একজন ফ্লোরেনটাইন নোটারি এবং তাঁর মায়ের নাম লিসা ডি জিওভান্নি মিনি। আমেরিগোর ঠাকুরদার নামও ছিল আমেরিগো ভেসপুচি, যিনি সিগনোরিয়া নামে পরিচিত ফ্লোরেন্টাইন সরকারের অধীনে ৩৬ বছর চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আমেরিগোর দুই দাদার নাম আন্তোনিও এবং গিরোলামো। তাঁর এক দাদা পড়াশোনার জন্য চলে গিয়েছিলেন পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

দাদার মতো পড়াশোনার জন্য আমেরিগোও বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাননি, বরং তাঁর নিজের কাকা গুইডো আন্তোনিও ভেসপুচি তাঁকে প্রাথমিক শিক্ষাদান করেছিলেন। এই গুইডো আন্তোনিও সেই সময়ে ফ্লোরেন্সের একজন বিখ্যাত মানবতাবাদী পন্ডিত হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আমেরিগোকে তাঁর সেই কাকা দর্শন, সাহিত্য, অলঙ্কারশাস্ত্র এবং ল্যাটিন বিষয়ে বিস্তৃত শিক্ষাদান করেছিলেন। ভুগোল এবং জ্যোতির্বিদ্যাতেও আমেরিগোর অসাধারণ দখল ছিল। তাঁর পরবর্তীকালের লেখালেখিতে টলেমি, স্ট্র্যাবো প্রমুখ জ্যোতির্বিজ্ঞানীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। অল্প বয়স থেকেই তিনি বই এবং মানচিত্রের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতেন৷ এখানে উল্লেখ্য, সেই সময়ের ইতালির অন্যতম ধনী মেডিসি পরিবারের সঙ্গে ভেসপুচির একটি ঘনিষ্ঠ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৪৭৮ সালে গুইডো আন্তোনিও প্যারিসে একটি ফ্লোরেন্টাইন কূটনৈতিক মিশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং সেখানে তাঁর ভাইপো আমেরিগো ভেসপুচিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। সম্ভবত আমেরিগো তাঁর কাকার ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। প্যারিসে তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল নেপলসের সঙ্গে ফ্লোরেন্সের যুদ্ধে ফ্রান্সের সমর্থন লাভ করা। ফেরার পথে তাঁরা বোলোগনা, মিলান এবং লিয়নে ব্যবসা করেছিলেন।

ফিরে আসার পর আমেরিগো কিছুদিন তাঁর বাবার সঙ্গে কাজ করেন এবং বিজ্ঞান অধ্যয়ন করতে থাকেন। ১৪৮২ সালে তাঁর বাবার মৃত্যু হলে তিনি মেডিসি পরিবারের জুনিয়র শাখার প্রধান লরেঞ্জো ডি পিয়েরফ্রান্সেসকো ডি’ মেডিসির জন্য কাজ করতে যান। আমেরিগো তাঁর চেয়ে বারো বছরের বড় হলেও তাঁরা দুজনেই আন্তোনিও ভেসপুচির কাছে পড়াশুনা করেছিলেন। প্রথমদিকে সেই পরিবারের একজন ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করলেও পরবর্তীকালে দেশে-বিদেশে এই মেডিসি পরিবারের ব্যবসায়িক বিভিন্ন লেনদেনের বিষয় পরিচালনা করতেন। এই সময় ভুগোলের প্রতি তাঁর ক্রমবর্ধমান আগ্রহের কারণে তিনি বিখ্যাত মানচিত্র নির্মাতা গ্যাব্রিয়েল ডি ভালসেকার তৈরি একটি দামি ম্যাপ কিনেছিলেন।

১৪৮৮ সালে লরেঞ্জো ভেসপুচিকে একটি ব্যবসায়িক ঝামেলার তদন্ত করতে এবং তা সমাধানের জন্য সেভিলে পাঠান। সেভিলে মেডিসি পরিবারের ব্যবসায়িক এজেন্ট টমাসো ক্যাপোনির জায়গায় জিয়োনোত্তো বেরার্ডি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, এই বেরার্ডি মেডিসি পরিবারের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি জাহাজের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহেরও ব্যবসা করতেন। ১৪৯২ সালে ভেসপুচি সেভিলে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছিলেন। মেডিসি পরিবারের ব্যবসায়িক লেনদেনের কাজ তো করতেন কিন্তু তখন তাঁর বেরার্ডির উক্ত জাহাজের সরঞ্জাম সরবরাহকারী কর্মকান্ডে বেশি আগ্রহ জন্মেছিল। বেরার্ডির কোম্পানিই ক্রিস্টোফার কলম্বাসের জাহাজের জন্য উপকরণ সরবরাহকারী ছিল। পরবর্তীতে কলম্বাসের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সমুদ্রযাত্রার জন্য জাহাজ নির্মাণের কাজে আমেরিগো বেরার্ডির সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন। ১৪৯৫ সালে বেরার্ডির মৃত্যুর পর সেই জাহাজ সরবরাহকারী কোম্পানির মালিক হন তিনি। সেভিলে স্থায়ী হওয়ার পর আমেরিগো সেখানে মারিয়া সেরেজো নামক এক স্পেনীয় মহিলাকে বিবাহ করেন ৷ ভেসপুচির উইলে সেই মেয়েটিকে বিখ্যাত সামরিক নেতা গঞ্জালো ফার্নান্দেজ ডি কর্ডোবার কন্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

কয়েকটি চিঠিপত্র-সহ যেসব নথিগুলি আমেরিগোর সমুদ্রযাত্রাগুলির প্রমাণস্বরূপ হাজির করা হয়, সেই নথিগুলির বিশেষত চিঠিগুলির লেখক অথবা প্রাপক যে ভেসপুচি নিজে ছিলেন তা নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ভেসপুচির অন্তত দুটি সংশয়াতীত সমুদ্রযাত্রার মধ্যে প্রথমটি স্পেনের পক্ষে এবং পরেরটি পর্তুগালের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছিল বলে জানা গেছে। এই দুটি ছাড়াও আরও কয়েকটি অভিযানে ভেসপুচির অংশগ্রহণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
ভেসপুচির নিজের বক্তব্য অনুযায়ী ১৪৯৭ সালে তিনি একটি সামুদ্রিক অভিযানে গিয়েছিলেন, যদিও এই অভিযানটি সম্পর্কে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রমাণ না থাকায় ঐতিহাসিকেরা এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ১৪৯৮ সালে তিনি এই অভিযান থেকে ফিরে এসেছিলেন বলে জানা যায়। অনেকে বলেন এই কাল্পনিক সমুদ্রযাত্রাটির বর্ণনা দিয়ে তিনি কলম্বাসের আবিষ্কারের উপর প্রাধান্য লাভের চেষ্টা করেছিলেন।

তবে ১৪৯৯ সালে স্পেনের একটি অভিযানে যোগ দেন তিনি এবং ফ্লিট কমান্ডার হিসেবে তাঁর সঙ্গী ছিলেন আলোনসো ডি ওজেদা এবং চিফ নেভিগেটর ছিলেন জুয়ান দে লা কোসা। ভেসপুচির নিজের চিঠি ছাড়াও এই ভ্রমণের অন্যান্য প্রমাণও পাওয়া যায়। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল আফ্রিকার মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ প্রান্তে ভারত মহাসাগরে যাত্রা করা। স্পেনের কাডিজ থেকে যাত্রা করে প্রথমে তাঁরা ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে থেমেছিলেন। গায়ানার উপকূলে পৌঁছে সম্ভবত ওজেদা এবং আমেরিগো আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। ভেসপুচি সেখান থেকে দক্ষিণ দিকে যাত্রা করেন এবং ওজেদা চলে যান উত্তরে আধুনিক ভেনিজুয়েলার দিকে। আমেরিগো ভেবেছিলেন তাঁরা এশিয়ার উপকূলে রয়েছেন এবং টলেমির হিসেব অনুযায়ী দক্ষিণদিকে অগ্রসর হয়ে তাঁরা ভারত মহাসাগরে পৌঁছবেন। দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল ধরে আমেরিগো পারিয়া উপসাগর পর্যন্ত এবং সেখান থেকে ভেনিজুয়েলায় চলে যান। এই অভিযানে আমাজন নদীর মুখ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের হিস্পানিওলায় স্প্যানিশ উপনিবেশে যাওয়ার জন্য উত্তরদিকে রওনা দেন, যাতে ফেরার আগে তাঁদের জাহাজ মেরামত করিয়ে নিতে পারেন। এরপর তাঁরা বাহামাসে অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে ২৩২ জন ক্রীতদাসকে ধরে নিয়ে স্পেনে ফেরেন।

১৫০১ সালে পর্তুগালের প্রথম ম্যানুয়েল আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিমের একটি ভূখন্ড (বর্তমানে ব্রাজিল) তদন্ত করবার জন্য এক অভিযানের আয়োজন করেন এবং এরজন্য ইতিমধ্যেই অভিযাত্রী হিসেবে খ্যাত আমেরিগোকে নিয়োগ করা হয়েছিল। এই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন গনোসালো কোয়েলহো এবং আমেরিগো দ্বিতীয় কমান্ডে ছিলেন। ১৫০১ সালের মে মাসে লিসবন থেকে রওনা হয়ে তাঁদের জাহাজ প্রথমে কেপ ভার্দে চলে যায়। পরে ১৭ আগস্ট তাঁরা ব্রাজিলের উপকূলে পৌঁছন। সেখানকার স্থানীয় আদিবাসীদের মুখোমুখি হন তাঁরা এবং তাঁদের দলের একজনকে হত্যাও করে সেই আদিবাসীরা। এরপর তাঁরা দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল বরাবর যাত্রা করে রিও ডি জেনিরোর উপসাগর খুঁজে পান। যেহেতু তাঁরা ১৫০২ সালের ১ জানুয়ারি এই আবিষ্কার করেছিলেন, তাই এর নাম দেন রিও ডি জেনিরো। সেই বছরই তাঁরা ফিরে গিয়েছিলেন। এই অভিযানেই আমেরিগো বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁদের দ্বারা নতুন আবিষ্কৃত এই নতুন ভূখণ্ড এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপ থেকে পৃথক একটি চতুর্থ মহাদেশ। তাই একে নতুন বিশ্ব বলে সম্বোধন করেছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে জার্মান মানচিত্র নির্মাতা মার্টিন ওয়াল্ডসিমুলার আমেরিগো ভেসপুচির নামানুসারে এই নতুন আবিষ্কৃত ভূখন্ডের নামকরণ করেন আমেরিকা।

১৫০৩ সালে কোয়েলহোর নেতৃত্বে আরেকটি অভিযানে ভেসপুচি অংশ নিয়েছিলেন বলে কথিত আছে কিন্তু এই তথ্য নিয়ে প্রচুর সংশয়ের অবকাশও তৈরি হয়েছে। এই সমুদ্রযাত্রার তারিখ এবং বিশদ বিবরণ নিয়ে নানা অসংগতি দেখা গেছে বলেই পন্ডিতদের মধ্যে এই অভিযানের সত্যতা নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে।

১৫০৫ সালের প্রথমদিকে ভেসপুচি সেভিলে ফিরে যান। একজন অভিযাত্রী এবং নেভিগেটর হিসেবে তাঁর খ্যাতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফেব্রুয়ারিতে রাজা তাঁকে নৌ-চলাচলের বিষয়ে পরামর্শের জন্য ডেকে পাঠান। ১৫০৮ সালে ভেসপুচি হাউস অব কমার্সের পাইলট মেজর পদটির জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। সমুদ্র ভ্রমণের জন্য পাইলটদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতেন তিনি।

অবশেষে ১৫১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সেভিলে ৬০ বছর বয়সে ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে এই কিংবদন্তি অভিযাত্রী আমেরিগো ভেসপুচির মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান