অরুণা আসফ আলি

অরুণা আসফ আলি

অরুণা আসফ আলি (Aruna Asaf ali) ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন একনিষ্ঠ যোদ্ধা। তাঁকে ”ভারত ছাড়ো আন্দোলনের নায়িকা” বলা হয়ে থাকে। সক্রিয় স্বাধীনতা সংগ্রামী হওয়ার পাশাপাশি অরুণা ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী, ভারতীয় শিক্ষাবিদ এবং প্রকাশক। ভারতকে স্বাধীনতা এনে দেওয়ার পরেও দীর্ঘদিন তিনি ভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থেকেছেন এবং নিজের অবদান রেখেছেন।

১৯০৯ সালের ১৬ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবের (এখন হরিয়ানায়) কালকায় (Kalka, Punjab) অরুণা গাঙ্গুলির জন্ম হয়। তাঁর বাবা উপেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি ছিলেন বাংলাদেশের বরিশাল জেলার একজন হোটেল মালিক। আর মা ছিলেন অম্বালিকা দেবী।

ব্রাহ্ম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা অরুণা ছোটবেলা থেকেই মুক্ত চিন্তা ও শিক্ষিত পরিবেশে বড় হন। তিনি প্রথমে লাহোরের স্যাক্রেড হার্ট কনভেন্ট বিদ্যালয়ে (Sacred Heart Convent School) পড়াশোনা করতেন। পরে নৈনিতালের অল সেন্টস মহাবিদ্যালয় (All Saints’ College) থেকে স্নাতক হন। স্নাতক হওয়ার পরে তিলি কলকাতার গোখেল মেমোরিয়াল বিদ্যালয়ে (Gokhale Memorial School) শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করতে থাকেন।


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

ঘটনাচক্রে এলাহাবাদে তাঁর সঙ্গে কংগ্রেস দলের এক নেতা আসফ আলির (Asaf Ali) আলাপ হয়। অরুণা এবং আসফ আলি জাতিগতভাবে পৃথক হওয়ায় এবং আসফ আলি আলি বয়সে অরুণার থেকে তেইশ বছরের বড় হওয়ায় অরুণার বাড়ি থেকে তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হয় কিন্তু, বিভিন্ন সমস্যার পরেও ১৯২৮ সালে তাঁদের বিয়ে হয়।

আসফ আলির মাধ্যমেই অরুণা আসফ আলি ভারতীয় রাজনীতিতে পা রাখেন। তাঁদের বিয়ের পরই তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য হন। লবণ সত্যাগ্রহ চলাকালীন তিনি একটি শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন এবং ভবঘুরেরে তকমা দিয়ে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। বিয়ের দুই বছরের মধ্যে তিনি কারাবরণ করেন। এমনকি ১৯৩১ সালে গান্ধী-আরউইন চুক্তির সময় যখন প্রত্যেক রাজনৈতিক বন্দীকেই মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তখনও তাঁকে জেলেই রাখা হয়। শেষে মহাত্মা গান্ধীর হস্তক্ষেপে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।  

১৯৩২ সালে তাঁকে তিহার জেলে পাঠানো হয় যেখানে তিনি রাজনৈতিক বন্দীদের প্রতি উদাসীন আচরণ করার প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন। তাঁর এই প্রতিবাদ অনশনে তিহার জেলে অবস্থার উন্নতি হয় কিন্তু তাঁকে অম্বালা জেলে নির্জন কারাবাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অম্বালা জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে তাঁকে রাজনৈতিকভাবে আর তেমন সক্রিয় হতে দেখা যায়নি, তবে ১৯৪২-এর শেষে তিনি অজ্ঞাতবাসে থেকে আবার সক্রিয় হয়ে উঠতে থাকেন।

১৯৪২ সালের ৮ অগস্ট সর্বভারতীয় কংগ্রেস সমিতি (All India Congress Committee) মুম্বাইতে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিষয়ে ঘোষণা করা মাত্র ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের সমস্ত বড় বড় নেতাদের গ্রেফতার করা শুরু করেন এই ভেবে যে নেতৃত্বের অভাবে আন্দোলনটি মুখ থুবড়ে পড়বে। কিন্তু তেত্রিশ বছর বয়সী অরুণা আসফ আলি পরেরদিন অর্থাৎ ৯ আগস্ট মুম্বাইয়ের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানে (Gowalia Tank Maidan) জাতীয় কংগ্রেসের পতাকা উত্তোলন করে আন্দোলনের সুচনা করেন। গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানে জমায়েতের ওপর ব্রিটিশ পুলিশ গুলি চালায়। অভিজ্ঞ নেতৃত্বের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও অরুণার সাহসী পদক্ষেপ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। অরুণার বীরত্বের কাহিনি গোটা দেশের ছাত্র যুবদের স্বাধীনতা অর্জনের প্রবল ইচ্ছাকেই প্রতিফলিত করেছিল।

এই ঘটনার পরে অরুণার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় এবং তিনি গ্রেফতারি এড়াবার জন্য গা ঢাকা দিয়ে থাকতে শুরু করেন। এর মধ্যেই তিনি রাম মানোহর লোহিয়ার সঙ্গে মিলিতভাবে কংগ্রেসের মাসিক পত্রিকা ইনকিলাব (Inquilab) সম্পাদনা করতে শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে একটি সংখ্যায় তিনি দেশের যুবসমাজকে হিংসা অহিংসার ব্যর্থ তর্ক ছেড়ে বিপ্লবের পথে পা বাড়াতে উৎসাহ দেন।

১৯৪২ সালের শেষের দিক থেকে অরুণা আসফ আলি গা ঢাকা দিয়েই থাকতেন। এই অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন তাঁকে যে বন্দী করতে পারবে তাকে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। তিনি অসুস্থ হয়ে দিল্লির করোলবাগে ডাঃ যোশীর চেম্বারে দীর্ঘদিন লুকিয়ে থাকেন। মহাত্মা গান্ধী তাঁকে হাতে লেখা চিঠি পাঠিয়ে অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে আসার অনুরোধ করেন এবং তাঁর নামে যে মূল্য নির্ধারিত হয়েছে, তা হরিজনদের জন্য ব্যয় করার পরামর্শ দেন। যদিও অরুণা ১৯৪৬ সালে তাঁর নামে জারি হওয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তুলে না নেওয়া অবধি তিনি প্রকাশ্যে আসেননি। অরুণা আসফ আলিকে “গান্ধীর রাজনৈতিক সন্তান কিন্তু কার্ল মার্ক্সের বর্তমান ছাত্র” হিসাবে বর্ণনা করা হত সেই সময়। তবে তিনি ভারতীয় নৌসেনাদের বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিলেন বলে গান্ধীজি দ্বারা সমালোচিতও হয়েছিলেন।

১৯৪৮ সালে অরুণা আসফ আলি কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলে (Congree Socalist Party) যুক্ত হন। কিন্তু অচিরেই তা ছেড়ে দেন। ১৯৫০ সালের গোড়ার দিকে ভারতীয় কম্যুনিস্ট দলের (Communist Party of India) সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। ১৯৫৪ সালে ভারতীয় কম্যুনিস্ট দলের মহিলা বিভাগ ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান উইমেন (National Federation of Indian Women) প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করলেও তিনি ১৯৫৬ সালে ভারতীয় কম্যুনিস্ট দল ত্যাগ করেন। ১৯৫৮ সালে অরুণা আসফ দিল্লির প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। তিনি এবং এদাতাতা নারায়ণন (Edatata Narayanan) যৌথভাবে লিঙ্ক (Link) নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, এবং প্যাট্রিয়ট (Patriot) নামে একটি দৈনিক এবং লিঙ্ক (Link) নামে একটি সাপ্তাহিক কাগজ প্রকাশ করেন।

অরুণা আসফ আলি ১৯৬৪ সালে আন্তর্জাতিক লেনিন শান্তি পুরস্কার (International Lenin Peace Prize) পান। ১৯৯১ সালে জওহরলাল নেহরু অ্যাওয়ার্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং (Jawaharlal Nehru Award for International Undersatnding) সম্মান পান। ১৯৯২ সালে তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ পান।

১৯৯৬ সালের ২৯ জুলাই সাতাশি বছর বয়সে নতুন দিল্লিতে অরুণা আসফ আলির মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরে  ১৯৯৭ সালে তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্নে ভূষিত করা হয়। ১৯৯৮ সালে তাঁর স্মৃতিতে একটি স্ট্যাম্প চালু করা হয়। দিল্লিতে তাঁর স্বামীর স্মৃতিতে আসফ আলি মার্গ নামে একটি রাস্তাও আছে।

2 comments

আপনার মতামত জানান