বাঙালি তথা ভারতীয় পদার্থবিদ অশোক সেন (Ashoke Sen)সমগ্র বিশ্বে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার জগতে ‘স্ট্রিং থিওরি’ এবং ‘ব্ল্যাক হোল’ বিষয়ে গবেষণার জন্য বিখ্যাত। ভারতের হরিশচন্দ্র রিসার্চ সেন্টারের অধ্যাপক ও গবেষক অশোক সেন স্ট্রিং তত্ত্বের গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১২ সালে ‘ফাণ্ডামেন্টাল ফিজিক্স’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। নোবেল পুরস্কারের পরে এটিই পদার্থবিজ্ঞানের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হিসেবে ধরা হয়। ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করেছে। ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ভারতের ‘টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফাণ্ডামেন্টাল রিসার্চ’-এ অধ্যাপনা করেন তিনি। ভুবনেশ্বরের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যাণ্ড রিসার্চ’ সংস্থার একজন সম্মানীয় সদস্য অশোক সেন। তাছাড়া ‘ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’তেও তিনি মর্নিংস্টার ভিজিটিং অধ্যাপক ছিলেন।
১৯৫৬ সালের ১৫ জুলাই কলকাতায় অশোক সেনের জন্ম হয়। তাঁর বাবা অনিল কুমার সেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে পদার্থবিদ্যার পূর্বতন অধ্যাপক ছিলেন এবং তাঁর মা গৌরী সেন ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধূ।
কলকাতার শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা সম্পূর্ণ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন তিনি। ১৯৭৫ সালে এই কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক উত্তীর্ণ হন অশোক সেন। এরপর কানপুরের ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। প্রেসিডেন্সিতে স্নাতক স্তরে পড়ার সময়েই অধ্যাপক অমল কুমার রায়চৌধুরীর গবেষণা ও অধ্যাপনার প্রতি আকৃষ্ট হন অশোক। আমেরিকার স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অশোক সেন পদার্থবিদ্যার উপর গবেষণাকর্ম সম্পূর্ণ করেন।
প্রথমে মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফাণ্ডামেন্টাল রিসার্চে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন অশোক সেন। ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এই সংস্থায় অধ্যাপনা করেছেন তিনি। তবে তার আগে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ফার্মি ন্যাশনাল অ্যাক্সিলারেটর ল্যাবরেটরিতে পোস্ট-ডক্টরাল সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। এছাড়া ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে অশোক সেন স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার অ্যাক্সিলারেটর সেন্টারেও পোস্ট-ডক্টরাল সহায়ক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। তারপরে তিনি আসেন টাটা ইনস্টিটিউটে এরপরে ১৯৯৭ সালে এলাহাবাদের হরিশচন্দ্র রিসার্চ সেন্টারে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। অধ্যাপনা আর গবেষণাই তাঁর জীবনের প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে তিনি হরিশচন্দ্র রিসার্চ সেন্টারে অধ্যাপনা করছেন তিনি। বর্তমানে অশোক সেন এই সংস্থার একজন ডিস্টিঙ্গুইশড অধ্যাপক।
অশোক সেনের গবেষণার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল স্ট্রিং তত্ত্ব যা কিনা মহাবিশ্বের গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটনে সহায়ক এবং মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে নতুন ধারণার জন্ম দেয়। পদার্থবিদ্যার ধারণা অনুযায়ী যে কোন অণুর মধ্যে থাকে পরমাণু এবং পরমাণুর মধ্যে থাকে ইলেক্ট্রন, প্রোটন, নিউট্রন এবং মেসন কণা। স্ট্রিং তত্ত্বের মূল বক্তব্য হল এই সকল কণা একে অপরের সঙ্গে একটি রবার ব্যাণ্ডের মতো তন্তু দিয়ে যুক্ত থাকে। সেতারের তারে বিভিন্ন ধরনের কম্পনে যেমন বিভিন্ন সুর নির্গত হয়, তেমনি পরমাণুর মধ্যে এই তন্তুর কম্পনের ফলে বিভিন্ন মৌল কণা সৃষ্টি হয়। তন্তুর ঐ প্রকার কম্পনের ফলেই উৎপত্তি হয় গ্র্যাভিটনের যা কিনা মহাকর্ষের বাহক। মহাবিশ্বের সার্বিক কাঠামো ব্যাখ্যা করতে হলে কিংবা ব্ল্যাক হোলের রহস্য ভেদ করতে হলে কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব খুবই প্রয়োজনীয়। আর এই তত্ত্বের ব্যাখ্যার জন্য আরও কয়েকটি তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে যার মধ্যে সবথেকে সফল তত্ত্ব হল স্ট্রিং তত্ত্ব। মহাবিশ্বের যে কোনও প্রকার অমীমাংসিত বিষয় এই তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। ড. অশোক সেনের প্রবর্তিত এই স্ট্রিং তত্ত্ব ব্ল্যাক হোলের রহস্যভেদ করতে অনেকাংশেই সক্ষম বলে মনে করেন পদার্থবিদরা। তাঁর এই তত্ত্ব কণা-পদার্থবিদ্যার বিন্দু কণার ধারণাকে প্রতিস্থাপিত করে স্ট্রিং বা তন্তুর ধারণাকে প্রতিষ্ঠা দেয়। ভর, আধান ইত্যাদি কণার বৈশিষ্ট্যগুলি এই তত্ত্ব অনুযায়ী স্ট্রিং-এর কম্পনের দ্বারা নির্ধারিত হয়। ‘এস-ডুয়ালিটি’ বা ‘স্ট্রং-উইক কাপলিং ডুয়ালিটি’র ধারণা দেন অশোক সেন যা তাঁর গবেষণার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অস্থিত ডি-ব্রেনের বিষয়েও তিনি চর্চা করেছেন এবং এই ধরনের ব্রেনের ক্ষেত্রে ওপেন স্ট্রিং ট্যাকিওন ঘনীভবনের বিষয়ে ‘সেন কনজেকচার’ নামে একটি অভিনব ধারণার সূত্রপাত করেন। স্ট্রিং মহাবিশ্বতত্ত্বের ক্ষেত্রে তাঁর ঘূর্ণায়মান ট্যাকিওনের ধারণা খুবই প্রভাবশালী ধারণা হিসেবে কাজ করে। অন্যান্য আরো বিখ্যাত গবেষকদের সঙ্গে একত্রে স্ট্রিং তত্ত্বের উপর তিনি আরো বেশ কিছু গবেষণা সন্দর্ভ লিখেছেন।
১৯৯৮ সালে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং-এর সুপারিশে অশোক সেন রয়্যাল সোসাইটির সদস্যপদ পান। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদানের মধ্যে রয়েছে সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের এনট্রপি ফাংশান ফর্মালিজম নির্ণয়। সম্প্রতি আকর্ষী কৌশল এবং ব্ল্যাকহোলের মাইক্রো-স্টেটের নির্ভুল গণনা বিষয়ে গবেষণা করছেন তিনি। তাছাড়া স্ট্রিং পার্টুবেশন তত্ত্বের নানাবিধ উন্নতিসাধনের চেষ্টাও করে চলেছেন অশোক সেন। ভুবনেশ্বরের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যাণ্ড রিসার্চ’ সংস্থায় পদার্থবিজ্ঞানের একজন সম্মানীয় অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন অশোক সেন। তাছাড়া ২০২০ সালে ভোপালের ‘ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যাণ্ড রিসার্চ’ –এর পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন তিনি।
১৯৮৯ সালে তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে অশোক সেন আইসিটিপি পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৯১ সালে তিনি ইণ্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেসের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৪ সালে শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কারে ভূষিত করা হয় অশোক সেনকে। ১৯৯৬ সালে তিনি ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমির সদস্যপদ লাভ করেন। এরপরে ২০০১ সালে ভারত সরকার অশোক সেনকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করে। এছাড়া ২০০৯ সালে গণিতবিজ্ঞানে ইনফোসিস পুরস্কার, খড়গপুর আইআইটি এবং শিবপুরের ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যাণ্ড টেকনোলজি-র পক্ষ থেকে ‘ডক্টর অফ সায়েন্স’ উপাধি লাভ করেন অশোক সেন। ২০১২ সালে তাঁর প্রবর্তিত স্ট্রিং তত্ত্বের জন্য তাঁকে ফাণ্ডামেন্টাল ফিজিক্স পুরস্কার দেওয়া হয়। এই পুরস্কারের অর্থমূল্য ছিল ত্রিশ লক্ষ ডলার। ঠিক এর পরের বছর ২০১৩ সালে ভারত সরকারের কাছ থেকে পদ্মবিভূষণ উপাধি এবং এম. পি. বিড়লা মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন তিনি। ২০১৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তাঁকে ডিরাক পদকে সম্মানিত করা হয়। মোটামুটিভাবে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে নোবেল পুরস্কারের পরেই এই পদকের স্থান। ডিরাক পদকের অর্থমূল্য পাঁচ হাজার ডলার। ২০১৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সম্মানীয় ‘ডক্টর অফ লেটার্স’ উপাধিতে ভূষিত হন তিনি।
বর্তমানে অশোক সেন ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স’-এর সায়েন্টিফিক কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য।