হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ

বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি তথা এককালে বাংলাদেশের প্রাক্তন সেনাপ্রধান ছিলেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ (Hussain Muhammad Ershad)। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বিখ্যাত বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ এরশাদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন ছিলেন। সামরিক শাসন জারি করার মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছিলেন তিনি। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ‘জাতীয় পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে তাঁরই শাসনকালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম নির্বাচিত করে বাংলাদেশের সংবিধানে অষ্টম সংশোধনী আনা হয়েছিল। মোট ৭ বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন মূলত স্বৈরতান্ত্রিক সামরিক শাসনপদ্ধতিকেই অবলম্বন করেছিলেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল তাঁর শাসনকালে একদিকে যেমন বাংলাদেশের রাস্তা, সেতু এবং পরিকাঠামোর নানা দিকে বিশেষ উন্নতি দেখা গিয়েছিল, তেমনি শাসনব্যবস্থায় প্রবল দুর্নীতি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করার অভিযোগে জাতীয় প্রেস ক্লাব তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিল। ১৯৯০ সালে খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্রকামী অভ্যুত্থানের চাপে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।

১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের দিনহাটার কুড়িগ্রামে একটি বাঙালি নস্য-শেখ পরিবারে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জন্ম হয়। তাঁর বাবা মকবুল হুসেইন পেশায় একজন আইনজীবি ছিলেন এবং তৎকালীন কোচবিহারের মহারাজার দরবারে কর্মরত ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল মাজিদা খাতুন। তঁদের নয় সন্তানের মধ্যে এরশাদ ছিলেন সবার বড়। তাঁর অন্যান্য ভাই-বোনদের মধ্যে পরবর্তীতে বিখ্যাত হন জি এম কাদের, মোজাম্মেল হুসেইন লালু এবং মেরিনা রহমান। ১৯৪৮ সালে দেশভাগের পরেই তাঁর পরিবার দিনহাটা থেকে পূর্ববঙ্গে চলে আসে। পরবর্তীকালে ১৯৫৬ সালে রওশন এরশাদকে বিবাহ করেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তাঁদের এক পুত্র সাদ এরশাদ এবং এক কন্যা জেবিন এরশাদ।

১৯৪৬ সালে দিনহাটা হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছিলেন তিনি। স্কুলে পড়াকালীন তাঁর একটি বিখ্যাত ডাকনাম ছিল ‘পেয়ারাদা’। রংপুরের কারমাইকেল কলেজে পড়াশোনা করেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তারপর ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ হন তিনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৫১ সালে কোহাটে অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিকর্তা প্রশিক্ষণ স্কুলে যোগ দেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এবং ঠিক তার পরের বছর ১৯৫২-তেই তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে অ্যাডজুট্যান্ট পদে কাজে নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৬৬ সালে কোয়েটার কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ থেকে উচ্চস্তরের আধুনিক কোর্স সমাপ্ত করেন এরশাদ। শিয়ালকোটের ব্রিগেডে কিছুদিন কাজ করার পরে ১৯৬৯ সালে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার পদে অধিষ্ঠিত হন এরশাদ এবং ১৯৭১ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টেও যোগ দেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রারম্ভ থেকেই এরশাদ রংপুরে ছুটি কাটাচ্ছিলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে তিনি পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানে নিযুক্ত অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে এরশাদও গৃহবন্দী হন এবং ১৯৭৩ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর মধ্যে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় তাঁদেরকে একত্রে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। বাংলাদেশে ফিরে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের নির্দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল পদে নিযুক্ত হন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে পেশাদার সেনাবাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত সংঘাত আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের কেন্দ্র করে পৃথক পৃথক অভিজ্ঞতার, পৃথক সংস্কৃতির কারণে এক অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের থেকে সেই সময় যারা দেশের বাইরে ছিল কিংবা সেনাদের মধ্যে যারা বন্দি ছিলেন, তারা কোনও না কোনও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছিলেন। ফলে দেশের জাতীয় রাজনীতিতে তথা সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা বাড়তে থাকছিল। সেই সময় ভারতে ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য এরশাদকে পাঠানো হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবর রহমানের হত্যার পরে ঐ বছরই ৩ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু ৭ নভেম্বর তারিখেই লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতায় ফিরে আসেন। বাংলাদেশের প্রধাম বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ঐ সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, তারপরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন এবং তিনিই ১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান নিযুক্ত করেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে। সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অভিষিক্ত হন এবং বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। তাঁর নির্দেশেই এরশাদ সেনাবাহিনীর নতুন প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। খুব সুন্দর বক্তৃতা লেখার ক্ষমতা থাকায় খুব কম সময়ের মধ্যেই তিনি জিয়াউর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও সামরিক পরামর্শদাতা হয়ে ওঠেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানকে হত্যার পরেও সরকারের প্রতি অনুগত ছিলেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের অভ্যুত্থান দমনের জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। জিয়াউর রহমানের পরে নতুন রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেছিলেন এরশাদ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসেন তিনি। ১৯৮৩ সালের ১১ নভেম্বর এ এফ এম আহসানউদ্দিন চৌধুরীর স্থলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অভিষিক্ত হন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। জিয়াউর রহমান হত্যার পরে তাঁর স্ত্রী এবং বিএনপি দলের বেগম খালেদা জিয়ার মূল অভিযোগ ছিল যে জিয়াউরের মৃত্যুর পিছনে এরশাদেরই সবথেকে বড় ভূমিকা ছিল, তিনিই সম্ভবত আবুল মঞ্জুরকে হত্যা করে সব প্রমাণ লোপাট করেছিলেন।

১৯৮৪ সালে ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশকে সমর্থন করেছিলেন এরশাদ যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার ভাড়াটেদের বিশেষ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অধিকার দেয়। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় ‘সার্ক’ (SAARC) আয়োজিত প্রতিষ্ঠাকালীন শীর্ষ সম্মেলনে এরশাদ মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ জিয়া-উল-হকের মধ্যে সখ্যতা গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনী অনুমোদন করেন যার বলে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষিত হয়। এর ফলেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা প্রথমবার খর্ব হয়। গ্রামীণ প্রশাসনের উন্নতির জন্য তিনি উপজেলা ও জেলা পরিষদ ব্যবস্থা চালু করেন। ১৯৮৫ সালেই এরশাদের নির্দেশে প্রথম গ্রামীণ পরিষদের গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়। তিনি বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে স্থিতিশীল করেন। বাংলাদেশের দেশীয় রাজনীতিতে এরশাদ বিভিন্ন দল থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী, শাহ আজিজ, মওদুদ আহমেদ সহ আরও বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিকে একত্রিত করে ‘জাতীয় পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই জাতীয় পার্টির সঙ্গে একত্রে ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে। ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ প্রথমবারের মত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণের অনুমোদন দেন। সশস্ত্র বাহিনীকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম করে তোলেন তিনি।

অনেকেই বলে থাকেন এরশাদের শাসন ছিল সম্পূর্ণ স্বৈরতান্ত্রিক। তাঁর আমলের সহিংস অভ্যুত্থান, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতির নিন্দা করা হয়ে থাকে। ২০১১ সালের ১৫ মে সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ে এরশাদের সামরিক শাসনকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে। তাঁর শাসনামলেই একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৮৫ সালের ৩ জুলাই যমুনা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষ-এর প্রকল্প চালু করা হয়। ভারতের সঙ্গে সফলভাবে তিস্তা প্রকল্পের রূপায়ণ করেছিলেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তাঁর অপশাসনের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের সদস্যরা অবিরাম গণ অভ্যুত্থান জারি রাখে এবং প্রবল চাপের মুখে বাধ্য হয়ে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ১৯৯১ সালে এরশাদকে গ্রেপ্তার করা হয়, ঐ বছরই সংসদ নির্বাচনে কারাবন্দি থাকা অবস্থাতেও রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচনে বিজয়ী হন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি জামিনে ছাড়া পান জেল থেকে। ১৯৯১ সাল থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে

পরপর দুই বার রাষ্ট্রসংঘের বিজয়ী হিসেবে সম্মানিত হন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ১৯৮৭ সালে ‘রাষ্ট্রসংঘ জনসংখ্যা পুরস্কার’ অর্জন করেন তিনি।  

২০১৯ সালের ১৪ জুলাই ৮৯ বছর বয়সে বাংলাদেশের ঢাকায় হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যু হয়।             

আপনার মতামত জানান