বাংলা কবিতার ইতিহাস যাঁদের ছাড়া অসম্পূর্ণ প্রায়, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক কবি শামসুর রহমান (Shamsur Rahman)। তাঁকে বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। তবে কবিতা লেখার পাশাপাশি দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা পেশার সাথেও যুক্ত থেকেছেন তিনি। বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাস নিয়ে মানুষের অধিকারের কথা বলে গেছেন আজীবন। কবিতার মধ্যে যেমন ধর্মীয় মৌলবাদের বিরোধিতা করেছেন, তেমনি অপরদিকে উচ্চকণ্ঠে উদার মানবতার জয় ঘোষণা করেছেন সদর্পে। যৌবনকালের প্রাধান্য তাঁর লেখায় ঘুরে ফিরে এসেছে। উত্তপ্ত সময়ের আলেখ্য তাঁর কবিতায় ধরা আছে নিপুণভাবে। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ বাস্তব জীবনেও যেমন পছন্দ করেন নি কখনও, তাঁর লেখাতেও সেই ছাপ স্পষ্ট। এই সংগ্রামী, মানবতাবাদী কবি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর তারিখে পুরোনো ঢাকার ৪৬ নম্বর মাহুতটুলিরর মামারবাড়িতে শামসুর রহমানের জন্ম হয়। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নরসিংদি জেলার রায়পুরা থানার অন্তর্গত পাহাড়তলী গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মুখলেসুর রহমান চৌধুরী এবং মা আমেনা বেগম। ১৩টি সন্তানের মধ্যে শামসুর ছিলেন চতুর্থ। তাঁর ডাকনাম ছিল বাচ্চু।
১৯৪৫ সালে শামসুর রহমান পুরোনো ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন এবং ১৯৪৭ সালে আই.এ পাস করেন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে। পরবর্তীকালে তিনি ইংরেজি বিষয় নিয়ে স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনবছর নিয়মিত ক্লাস করেও মূলপর্বের পরীক্ষা তখন দেননি শামসুর। আরও পরে ১৯৫৩ সালে পাসকোর্সে বি.এ পাস করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল বদরুদ্দীন উমর, হাসান হাফিজুর রহমান প্রমুখ বিখ্যাত ব্যাক্তিদের সঙ্গে। বি.এ পাস করার পর ইংরেজি বিষয় নিয়েই এম.এ (প্রাথমিক) পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করলেও এখানেও মূলপর্বের পরীক্ষায় বসেননি তিনি।
পেশা হিসেবে শামসুর রহমান বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতাকে। ১৯৫৭ সালে ইংরেজি দৈনিক ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার সহসম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন তিনি৷ পরে এই কাজ ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন রেডিও পাকিস্তানে অনুষ্ঠান প্রযোজকের কাজে। ১৯৫৭ থেকে এই কাজে যুক্ত থাকার পর ১৯৫৯ সালে তিনি পুনরায় মর্নিং নিউজে ফিরে আসেন এবং সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব সামলেছেন তিনি৷ তারপর ১৯৬৪ সালের শেষদিকে প্রেস ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় এবং আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সম্পাদনায় ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের কাজে যোগ দেন এবং ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন। এরপর ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৭ প্রায় একদশক তিনি দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যদিও ১৯৮৭ সালে সামরিক সরকারের শাসনকালে শামসুরকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। তারপরে ‘অধুনা’ নামক একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন তিনি।
ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার পর তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গল্পগুচ্ছ’ পড়ে এক ভিন্ন জগতের সন্ধান পেলেন। সেই বই তাঁকে এক অন্য ব্যক্তিতে রুপান্তরিত করেছিল বলা চলে ৷ ১৯৪৩ সালে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘উনিশ শ উনপঞ্চাশ’ ছাপা হয়েছিল নলিনীকিশোর গুহ সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’পত্রিকায়। ১৯৫০ সালে প্রকাশিত পূর্ব বাংলার প্রথম সাহিত্য সঙ্কলন ‘নতুন কবিতা’য় তেরোজন তরুণ কবির সঙ্গে শামসুর রহমানেরও পাঁচখানি কবিতা ছাপা হয়েছিল। এই কবিতাগুলি পাঠকের কাছে কবি হিসেবে তাঁর পরিচিতি গড়ে তুলতে সাহায্য করে। ১৯৬০ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয়েছিল যে বইটি পাঠকমহলে চুড়ান্ত সাড়া জাগায়। পরবর্তীকালে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় শামসুর রহমানের ‘রুপালি স্নান’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে শুধুমাত্র আর বাংলাদেশ নয়, বৃহত্তর সাহিত্য সমাজে তাঁর প্রবেশ ঘটল। বিভিন্ন সময়ে বিবিধ ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন তিনি। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘মজলুম আদিব’, যার অর্থ বিপন্ন লেখক। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থটি এই ছদ্মনামে লেখা। এই ছদ্মনাম থেকেই তাঁর বাস্তববাদী কবিসত্তার পরিচয় পাওয়া যাবে। মর্নিং নিউজে প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর সৃষ্টিশীলতা এক অন্য মাত্রা পেয়েছিল। এই সময়পর্বে লেখা কবিতাগুলি নিয়ে ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘রৌদ্র করোটিতে’। এই কাব্যের জন্য তিনি আদমজী পুরস্কারে সম্মানিত হন। এই পুরস্কার তিনি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের হাত থেকে গ্রহণ করেছিলেন যাঁর ক্ষমতাগ্রহণকে ব্যঙ্গ করে ১৯৫৮ সালে ‘সমকাল’ পত্রিকায় লিখেছিলেন ‘হাতির শুঁড়’ নামে একটি কবিতা।
শামসুর রহমানের কবিতায় পরতে পরতেই প্রতিবাদের ঝলকানি লক্ষ্য করা যায়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের উন্মাদনায় লিখেছিলেন কয়েকটি কবিতা ও কাব্যনাটক। ১৯৬৮ সালের দিকে আইয়ুব খান পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফের প্রস্তাব রাখলে কবি ক্ষুব্ধ হয়ে লিখেছিলেন মর্মস্পর্শী কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। পুলিশের গুলিতে নিহত রক্তাক্ত আসাদের জামা উঁচুতে তুলে ধরে বয়ে চলা এক প্রতিবাদ মিছিলের অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করে ১৯৬৯ সালের ২০শে জানুয়ারি রচনা করেছিলেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘নিজ বাসভূমে’ তিনি উৎসর্গ করেছিলেন আবহমান বাঙলার সমস্ত শহীদদের উদ্দেশ্যে৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ ইত্যাদি বেশ কিছু কবিতা রচনা করেছিলেন যেগুলি মুক্তিযোদ্ধারা তাদের যুদ্ধ শিবিরে আবৃত্তি করত। মুজিবর রহমান যখন কারাগারে তখন লিখেছিলেন ‘টেলেমেকাস’ নামের অসামান্য কবিতাটি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নিহত হলে তিনি রচনা করেছিলেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখা ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে’। ১৯৮৭ সাল থেকে পরবর্তী চারবছর এরশাদ সরকারের স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিবাদে যে কবিতাগুলি রচনা করেছিলেন সেগুলি হল, ‘শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা’, ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’, ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’ এবং ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা’। ১৯৯১ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর লিখেছিলেন ‘গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা’। মৌলবাদীরা তাঁর বাসভবনে হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যা করবার চেষ্টাও করেছিল। যদিও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। তাঁর স্ত্রী জোহরা বেগম এই হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন।
মুক্তছন্দ ছাড়াও মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ছন্দে দীর্ঘদিন কবিতা লিখেছেন তিনি। শামসুর রহমানের উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি কবিতার বই হল, ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ (১৯৬৭), ‘দুঃসময়ে মুখোমুখি’ (১৯৭৩), ‘আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি’ (১৯৭৪), ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ (১৯৮৩), অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই’ (১৯৮৫), ‘দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে'(১৯৮৬), ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ (১৯৮৮), ‘ধ্বংসের কিনারে বসে’ (১৯৯২), ‘তুমিই নিশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন’ (১৯৯৬), ‘রূপের প্রবালে দগ্ধ সন্ধ্যা রাতে’ (১৯৯৮), ‘স্বপ্নে ও দুঃস্বপ্নে বেঁচে আছি’ (১৯৯৯), ‘ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছে’ (২০০৩), ‘না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন’ (২০০৬) ইত্যাদি। সারাজীবনে মোট ৬৬টি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও তিনি চারখানি উপন্যাস লিখেছিলেন। সেগুলি হল, অক্টোপাশ’ (১৯৮৩), ’অদ্ভুত আঁধার এক’ (১৯৮৫), ‘নিয়ত মন্তাজ’ (১৯৮৫) এবং ‘এলো সে অবেলায়’ (১৯৯৪)। যে দুটি প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছিলেন, সেদুটির নাম, ‘আমৃত্যু তাঁর জীবনানন্দ’ (১৯৮৬) এবং ‘কবিতা এক ধরনের আশ্রয়’ (২০০২)। তিনি নিজে জীবনানন্দের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনাগুলি হল, ‘কালের ধুলোয় লেখা’ এবং ‘স্মৃতির শহর’। এছাড়াও ছোটদের জন্য লিখেছেন বিস্তর। ৩ টি নাটক অনুবাদ করেছিলেন শামসুর। এমনকি রবার্ট ফ্রস্ট (Robert Frost), টেনেসি উইলিয়ামস (Tennessee Williams), খাজা ফরিদ প্রমুখের কবিতাও তিনি অনুবাদ করেছেন।
১৯৬১ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত পাক-ভারত সাংস্কৃতিক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যোগদানকারী লেখক ছিলেন শামসুর রহমান। জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। সাংবাদিক পরিচয়েই তিনি বিদেশ ভ্রমণ করেছিলেন এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বহুদিন নিউইয়র্কে কাটিয়েছিলেন। রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধকরণের প্রতিবাদে মুনীর চৌধুরী লিখিত বিবৃতিতে সাক্ষর করেছিলেন কবি। ১৯৮৮, ১৯৮৯, ১৯৯০, এই পরপর তিনবছর ১ ও ২ ফেব্রুয়ারী তাঁর নেতৃত্বে রাস্তায় প্যান্ডেল খাটিয়ে সারা দেশের কবিদের নিয়ে বিরাট কবিতা উৎসবের আয়োজন হয়েছিল।
সংকীর্ণতামুক্ত উদার মানবতাবোধ, জ্বলন্ত সময়ের চিত্র, প্রতিবাদ, হতাশা, গ্লানি, স্বপ্ন, রোমান্টিকতা, তারুণ্যের জয় এই সবই মিলেমিশে রয়েছে তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে।
সারাজীবনে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন শামসুর রহমান। পেয়েছেন ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’ (১৯৬৯), ‘জীবনানন্দ পুরস্কার’ (১৯৭৩), ‘একুশে পদক’ (১৯৭৭), ‘আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার’ (১৯৮১), ‘নাসিরউদ্দীন স্বর্ণ পদক’ (১৯৮১), ‘ভাসানী পুরস্কার’ (১৯৮২), ‘পদাবলী পুরস্কার’ (১৯৮৪), ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ (১৯৯২) ইত্যাদি। এছাড়াও ১৯৮২ সালে সাংবাদিকতার জন্য পেয়েছিলেন জাপানের ‘মিতসুবিশি পুরস্কার’। ১৯৯৪ সালে কলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠী তাঁকে ‘আনন্দ পুরস্কারে’ সম্মানিত করে। যাদবপুর এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে যথাক্রমে ১৯৯৪ ও ১৯৯৬ সালে সাম্মানিক ডিলিট উপাধি প্রদান করেছিল।
১৯৫৫ সালের ৮ জুলাই শামসুর বিবাহ করেন জোহরা বেগমকে (Johra Begum)। তাঁদের তিনটি পুত্র এবং দুটি কন্যাসন্তান জন্মায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে পাহাড়তলী গ্রামে চলে গিয়েছিলেন।
ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার কবি ও সাংবাদিক শামসুর রহমানের মৃত্যু হয়। ঢাকার বনানী কবরস্থানে নিজের মায়ের কবরের পাশে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
One comment