কিপ স্টিফেন থর্ন (Kip Stephen Thorne) একজন মার্কিন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী যিনি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা এবং সফল ভাবে তার অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য ২০১৭ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। বিজ্ঞানী থর্ন মূলতঃ কাজ করেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন শাখার উপর যারমধ্যে অন্যতম হল মহাকর্ষ এবং কৃষ্ণগহ্বর। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সম্পর্কিত তাঁর যুগান্তকারী গবেষণা আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেক দিক প্রশস্ত করেছে।
১৯৪০ সালের ১ জুন আমেরিকার লোগান শহরে কিপ থর্নের জন্ম হয়। তাঁর বাবা ডি. ওয়েইন থর্ন ছিলেন স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিদ। তাঁর মা এলিসন ছিলেন একজন অর্থনীতিবিদ। এলিসন আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি (IOWA STATE UNIVERSITY) থেকে প্রথম মহিলা হিসেবে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। থর্নের চার ভাইবোনের মধ্যে দুজন অধ্যাপনাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। থর্নের বর্তমান স্ত্রী ক্যারোল জয়েস উইন্সটেইন হলেন বায়োকাইনেসিওলজি বিষয়ের একজন অধ্যাপিকা।
পড়াশনার আবহে বড় হওয়া কিপ থর্ন শৈশব থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ আশৈশব। তাঁর মা মাত্র আট বছর বয়সে তাঁকে একটি সৌরজগত বিষয়ক সভায় নিয়ে যান। সেই থেকেই তাঁর পদার্থবিদ্যার প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। মাত্র তেরো বছর বয়সে জর্জ গ্যামো রচিত “ওয়ান, টু,থ্রি…. ইনফিনিটি” বইটি পড়ার পর আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করতে উদ্বুদ্ধ হন। ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে ১৯৬২ সালে কিপ থর্ন পদার্থবিদ্যায় স্নাতক হন। ১৯৬৬ সালে তিনি স্নাতকোত্তর এবং ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে। শুধুমাত্র বিভিন্ন রুশ বিজ্ঞানীদের পদার্থবিদ্যা সম্পর্কিত গবেষণা পড়ার জন্য বিজ্ঞানী থর্ন রুশ ভাষা শেখেন। তিনি সেই কতিপয় মার্কিন বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম যাঁরা বারংবার সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়ে সেদেশীয় বিজ্ঞানীদের সাথে যৌথ গবেষণায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছেন।
বিজ্ঞানী থর্ন কর্মজীবন শুরু করেন ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। অসামান্য দক্ষতা এবং পদার্থবিজ্ঞানে পাণ্ডিত্যের জেরে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সেই তিনি পূর্ণাঙ্গ অধ্যাপক পদ লাভ করেন। ১৯৭১-১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি উটাহ বিশ্ববিদ্যালয় (University of Utah-)তে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল অব্দি তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় (Cornell University)-তেও অধ্যাপনা করিয়েছেন। ১৯৯১ সালে তিনি পদার্থবিদ্যার বিরল সম্মান ফাইনম্যান অধ্যাপক হিসেবে নির্বাচিত হন।
বিশ্ববরেণ্য পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস এবং কিপ থর্ন ছিলেন একাধারে সহকর্মী এবং বন্ধু। ১৯৭৫ সালে এই দুই বিজ্ঞানী একে অপরের সাথে একটি বাজি লড়েন। মহাকাশের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক সিগনাস এক্স ওয়ান যার নাম, তার বংশপরিচয় নিয়ে শুরু হয় তরজা। সিগন্যাস এক্স ওয়ান আসলে কৃষ্ণগহ্বর কিনা তাই নিয়ে লড়া হয় বাজি। চুক্তি ছিল হকিংস যদি জয়ী হন, তবে থর্ন তাঁকে চার বছরের জন্য ব্রিটিশ হাস্যরসাত্মক ম্যাগাজিন প্রাইভেট আই এর গ্রাহক বানিয়ে দেবেন। কিন্তু থর্ন জিতলে হকিংস ওঁকে আমেরিকার আদিরসাত্মক ম্যাগাজিন পেন্টহাউজের গ্রাহক করে দেবেন এক বছরের জন্য। হকিংস যদিও কৃষ্ণগহ্বরের দাবী খারিজ করে দেন, কিন্ত কিপ থর্ন কৃষ্ণগহ্বরের পক্ষেই মত দেন।
আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্বে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্বের কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন মহাকাশে দুটি কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষের ফলে অথবা কোন নক্ষত্রের বিস্ফোরণ জাতীয় বৃহৎ মহাজাগতিক ঘটনা ঘটলে এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সৃষ্টি হয় যা ছায়াপথে আলোর গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলেই মহাকাশে সংকোচন-প্রসারণ ঘটে। তিনি আরো বলেছিলেন এই তরঙ্গ এতটাই ক্ষীণ যে কোন যন্ত্রের সাহায্যে এর শনাক্তকরণ প্রায় অসম্ভব। সেইসময় প্রযুক্তি অতটা উন্নত না হওয়ায়, ব্যবহারিকভাবে এই তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণ করা যায়নি। তাই বহু বিজ্ঞানীই এই তত্ত্ব খারিজ করে দেন।
কিপ থর্ন তাঁর চল্লিশ বছরের সুদীর্ঘ গবেষণাকালে এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নিয়ে কাজ করেছেন। বলা যায় লাইগো (LIGO) প্রোজেক্টের হোতা হলেন থর্ন। LIGO অর্থাৎ LASER INTERFEROMETER GRAVITATIONAL WAVE OBSERVATORY হল একটি যন্ত্র যার সাহায্যে দুটি তরঙ্গের পারস্পরিক বিক্রিয়ালব্ধ ফলাফল পাওয়া যায়। বিজ্ঞানী থর্নের নেতৃত্বে কয়েকটি দেশের বিজ্ঞানীদের যৌথ প্রচেষ্টায় শুরু হয় লাইগো প্রোজেক্ট। তাত্ত্বিক অংশ ছাড়াও বিজ্ঞানী থর্ন লাইগো যন্ত্রের প্রযুক্তিগত রূপরেখা এবং কার্যকরী অ্যালগোরিদমও গণনা করেন। অবশেষে ২০১৫ সালে সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় এক হাজার বিজ্ঞানীর অক্লান্ত অধ্যাবসায়ের ফল হিসেবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করা যায় যার সৃষ্টি হয়েছিল লক্ষ-কোটি বছর আগে দুটি কৃষ্ণগহ্বরের পারস্পরিক সংঘর্ষের জেরে। এই বিস্ময়কর আবিষ্কার কিপ থর্ন এবং বিজ্ঞানী রেইনার ভাইস ও ব্যারি বারিশকে এনে দেয় নোবেল পুরস্কার। বিশ্বের তাবড় প্রতিষ্ঠানগুলি স্বীকার করে এই গবেষণার ফলে ব্রহ্মান্ডের বহু অজানা তথ্য অনুসন্ধান করার পথ আরো প্রশস্ত হয়েছে।
২০১৪ সালে পৃথিবীখ্যাত চিত্র পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান নিমার্ণ করেন ইন্টারস্টেলার (Interstellar) নামক ছায়াছবি। ছবির বিষয়বস্তু ছিল মহাশূন্য, টাইম ট্রাভেল এবং কৃষ্ণগহ্বর। এই ছবিটির বিজ্ঞানভিত্তিক চেতনার নেপথ্যে ছিলেন থর্ন। ছবিটির অন্যতম প্রযোজকও ছিলেন থর্ন। ছবিটি সমগ্র বিশ্বের কাছে প্রশংসিত হয়। বিশেষত ছবিটিতে যেভাবে ব্ল্যাকহোল, ওয়র্মহোল এবং টাইমট্রাভেলের মতো জটিল বিষয়গুলিকে প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তাতে থর্নের অবদান অনস্বীকার্য। এই ছবিটিতে আলোচিত বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলি সাধারণ মানুষের কাছে আরো সরলভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য থর্ন সায়েন্স অব ইন্টারস্টেলার (The Science of Interstellar) নামক একটি বই লেখেন। পরবর্তী সময়ে পরিচালক নোলানের অপর একটি সিনেমা টেনেট (Tenet) এরও বৈজ্ঞানিক পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন বিজ্ঞানী থর্ন। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ বিগ ব্যাং থিওরি” এর একটি পর্বে তিনি স্বভূমিকায় অভিনয়ও করেন।
সারাজীবনে প্রচুর আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং সম্মান পেয়েছেন থর্ন। ২০০৯ সালে সুইজারল্যান্ডের আ্যলবার্ট আইনস্টাইন সোসাইটি তাঁকে সম্মানিত করেছে আ্যলবার্ট আইনস্টাইন মেডেল প্রদান করে। ২০১০ সালে ইউনেস্কো তাঁকে দেয় ইউনেস্কো নিলস বোহর পদক। বিজ্ঞান চর্চায় তাঁর কৃতিত্বের জন্য সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধিতে ভূষিত করে অ্যারিস্টটল বিশ্ববিদ্যালয় থেসালোনিকি (Aristotle University of Thessaloniki)র পদার্থবিদ্যা বিভাগ। ২০১৬ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাদের বার্ষিক সংখ্যায় প্রথম একশোজন প্রভাবশালী আমেরিকানের তালিকায় কিপ থর্নকে অন্তর্ভুক্ত করে। সাধারণ মানুষের মাঝে বিজ্ঞানচর্চার আগ্রহ বাড়িয়ে তোলার জন্য তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছে। থর্ন রচিত ‘ব্ল্যাক হোলস অ্যান্ড টাইম ওয়ার্পস: আইনস্টাইনস আউটরেজাস লেগাসি’ বইটি সাধারণ মানুষের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। তাছাড়াও তিনি কার্ল সাগান তাঁর কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস ‘Contact’ লেখার সময়ে থর্ন নিজের ওয়ার্মহোল ট্রাভেলের তত্ত্ব দিয়ে সাহায্য করেন। থর্ন দু-দুবার অর্জন করেছেন আমেরিকান ফিজিক্স সায়েন্স রাইটিং ইনস্টিটিউট পুরস্কার। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার উপর লিখেছেন বহু পাঠ্যপুস্তক, যা দেশবিদেশে পদার্থবিদ্যার উচ্চশিক্ষায় বহুল ব্যবহৃত।
সুদীর্ঘ গবেষণাকালে আমেরিকার বহু নামী প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছেন কিপ থর্ন। তাঁর পথ প্রদর্শনায় অন্তত ৫০ জন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষক ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেছেন। থর্ন শুধুমাত্র বিজ্ঞানীমহলে নিজের গবেষণা প্রতিষ্ঠা করেননি, জনসাধারণকে সাবলীল ভাবে মহাকাশবিজ্ঞানের জটিল অঙ্ক বুঝিয়েছেন সহজ ভাষায়। নিজের ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন বিজ্ঞানকে মন থেকে ভালোবেসে কাজ করতে। তিনি বিশ্বাস করেন মানবসভ্যতার উন্নতির জন্য বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিক উন্মোচন অত্যাবশকীয়। সেই পথ কঠিন হলেও একাগ্রতা ও কঠোর পরিশ্রমে সাফল্য অবশ্যই ধরা দেবে। ব্যক্তিগত জীবনে থর্ন নিজেকে নাস্তিক হিসেবে দাবী করেন, যদিও তিনি ক্যাথোলিক পরিবারে বড় হয়েছেন। তিনি বলেন যে তাঁর সহকর্মীদের একটা বড় অংশ ঈশ্বরবিশ্বাসী। আপাত দৃষ্টিতে ঈশ্বর এবং বিজ্ঞানের বিরোধ না থাকলেও তিনি নিজেকে ঈশ্বর অবিশ্বাসী হিসেবেই অভিহিত করবেন। প্রবীণ এই বিজ্ঞানী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি রহস্য উদঘাটনে ব্যস্ত থাকলেও, অবসরে রং-তুলি, সংগীত-কবিতা নিয়ে চর্চা করেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বিজ্ঞানী কিপ থর্ন নিঃসন্দেহে একজন জীবিত কিংবদন্তি।
One comment