স্টিফেন হকিং (Stephen Hawking) একজন পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, বিশ্বতাত্ত্বিক ও বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন জনপ্রিয় গ্রন্থের লেখক। তাঁকে বিংশ শতকের অন্যতম সেরা তাত্ত্বিক পদার্থবিদ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। জটিল স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত এই বিজ্ঞানী তাঁর অদম্য জীবনীশক্তি নিয়ে লড়াই করে গেছেন সারাজীবন।
১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড শহরে স্টিফেন হকিং-এর জন্ম হয়। তাঁর প্রকৃত নাম স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। স্টিফেনের বাবার নাম ছিল ফ্রাঙ্ক হকিং এবং মায়ের নাম ছিল আইসোবেল এলিন হকিং। বাবা ছিলেন চিকিৎসা বিদ্যার গবেষক (medical researcher) এবং মা ছিলেন একটি মেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর সম্পাদক। হকিংয়ের আরো দুই বোন ছিল, তাঁদের নাম ছিল ফিলিপা এবং মারি। এছাড়াও ছিল এক পালিত ভাই, যাঁর নাম এডওয়ার্ড ফ্রাঙ্ক ডেভিড। পরবর্তী জীবনে জেন ওয়াইল্ড নামে এক লেখিকার সঙ্গে হকিংয়ের বিবাহ হয়। এই দম্পতির টিমোথি ও রবার্ট নামে দুই পুত্রসন্তান এবং লুসি নামে এক কন্যাসন্তান ছিল। স্টিফেন ও জেনের এই সম্পর্ক স্থায়ী হয়নি। বিবাহ বিচ্ছেদের পর হকিং বিবাহ করেন এলিন ম্যাসন নামে এক মহিলাকে। কিন্তু তাঁর সঙ্গেও বিচ্ছেদ হয়ে যায় হকিংয়ের।
স্টিফেন হকিংয়ের পড়াশোনা শুরু হয় লন্ডনের হাইগেট শহরের বায়রন হাউস স্কুলে। ১৯৫০ সালে হকিংয়ের বাবা ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর মেডিক্যাল সায়েন্স’-এর পরজীবীবিদ্যা (parasitology) বিভাগের প্রধান নির্বাচিত হন। তখন পরিবারটি হার্টফোর্ডশায়ারের সেন্ট অ্যালবানসে চলে আসে। এখানে এসে আট বছরের হকিং কিছু মাসের জন্য ভর্তি হন সেন্ট অ্যালবানস স্কুল ফর গার্লস-এ। তিনি দুটি স্বাধীন স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। সেগুলি হল রেডলেট স্কুল এবং প্রাথমিক স্তরের শেষ পরীক্ষায় পাশ করার পর সেন্ট অ্যালবানস স্কুল। তাঁর পরিবারের ইচ্ছা ছিল যে তিনি ওয়েস্টমিনস্টার স্কুলে পড়বেন। কিন্তু বৃত্তি পরীক্ষার দিনেই স্টিফেন অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বৃত্তির সাহায্য ছাড়া এই স্কুলের খরচ চালানো তাঁর পরিবারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তিনি সেন্ট অ্যালবানসেই রয়ে গেলেন।
১৯৫৯ সালে এখান থেকে পাশ করে তিনি ভর্তি হন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি কলেজে। তাঁর বাবা চাইতেন যে হকিং মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনা করুক। কারণ বাবার মতে মেডিসিন নিয়ে স্নাতক পাশ করার পর চাকরি পাওয়া অপেক্ষাকৃতভাবে সহজ হয়। কিন্তু হকিং বাবার কথা না শুনে পদার্থবিদ্যা এবং তার পাশাপাশি রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তিন বছর পর পদার্থবিদ্যায় প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি স্নাতক স্তরের পড়াশোনার জন্য চলে যান কেমব্রিজের ট্রিনিটি হল-এ। ডেনিস উইলিয়াম স্কিয়াম (Dennis William Sciama)-এর অধীনে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু এই সময়েই তাঁর মোটর নিউরনের জটিল রোগ ধরা পড়ায় হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন স্টিফেন। এই রোগটি চিকিৎসকদের পূর্বাভাস অপেক্ষা ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকলেও ক্রমে ক্রমে তিনি সাহায্য ছাড়া হাঁটাচলা এবং স্পষ্ট ভাবে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। এর মধ্যেও চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে এবং শিক্ষক স্কিয়াম-এর সহযোগিতায় পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি। ১৯৬৪ সালের জুন মাসে হকিং বিজ্ঞানী ফ্রেড হোয়েল এবং তাঁর ছাত্র জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকারের কাজকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ জানান।
হকিং যখন ডক্টরেট পড়া শুরু করেন, তখন মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রচলিত তত্ত্ব: বিগ ব্যাং তত্ত্ব এবং স্টেডি স্টেট তত্ত্ব নিয়ে পদার্থবিদদের মধ্যে অনেক বিতর্ক ছিল। বিজ্ঞানী রজার পেনরোজের কৃষ্ণগহ্বর সংক্রান্ত তত্ত্ব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে হকিং হকিং এই বিষয়েই ১৯৬৫ সালে তাঁর গবেষণাপত্র লেখেন। এটি অনুমোদন পায় ১৯৬৬ সালে। এরপর তিনি কেমব্রিজের ‘গনভিল অ্যান্ড কাইয়াস কলেজ’ (Gonville and Caius College)-এ গবেষণা করার জন্য ফেলোশিপ লাভ করেন এবং তিনি ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং মহাজাগতিক বিজ্ঞানে প্রয়োগকৃত গণিত এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
হকিং তাঁর কাজে এবং রজার পেনরোজের সঙ্গে একত্রে তাঁর ডক্টরাল থিসিসের সিঙ্গুলারিটি তত্ত্বের ধারণাগুলি প্রসারিত করেছিলেন। ১৯৬৮ সালের ‘গ্র্যাভিটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিযোগিতায় এই থিসিসটি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। ১৯৬৯ সালে হকিং যাতে কাইয়াসে থাকতে পারেই সেই জন্য বিজ্ঞানে বিশেষ ভাবে তৈরি করা ফেলোশিপ পেয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে হকিং নির্ধারণ করেছিলেন যে একটি কৃষ্ণ গহ্বরের ইভেন্ট হরাইজন (event horizon) কখনো ছোট হতে পারে না, যেটি কৃষ্ণগহ্বর গতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র বলে পরিচিত। বিজ্ঞানী জেমস.এম.বার্ডিন এবং ব্র্যান্ডন কার্টনার-এর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে হকিং কৃষ্ণগহ্বরের ক্রিয়াকলাপ সংক্রান্ত চারটি সূত্র গঠন করেন।
১৯৭৩ সালের প্রথম থেকে তিনি কোয়ান্টাম মেকানিকস ও কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে তাঁর ফলাফলে তিনি দেখিয়েছিলেন কৃষ্ণগহ্বর বিকিরণ নির্গত করে, যা বর্তমানে পরিচিত ‘হকিং বিকিরণ’ (Hawking Radiation) নামে। এই বছরেই তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হন। এছাড়াও হকিং ১৯৭৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (ক্যালটেক) শেরম্যান ফেয়ারচাইল্ড বিশিষ্ট ভিজিটিং প্রফেসরশিপে নিযুক্ত হন।
১৯৭৫ সালে তিনি মহাকর্ষীয় পদার্থবিদ্যার পাঠক হিসেবে আবার কেমব্রিজে ফিরে আসেন। এই সময় থেকেই কৃষ্ণগহ্বর ও মহাকাশ নিয়ে জনসাধারণের আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। অনেক পত্রিকা ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের জন্য নিয়মিত হকিংয়ের সাক্ষাৎকার নেওয়া হতে থাকে। ১৯৭৭ সালে তিনি এই বিভাগের অধ্যাপক রূপে নিযুক্ত হন। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের লুকাসিয়ান অধ্যাপক নির্বাচিত হন ১৯৭৯ সালে। এই পদে থেকেই তিনি তাঁর বিভিন্ন বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণা চালিয়ে গেছেন।
১৯৮৫ সালে হকিং নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন। এরপর থেকেই তাঁর বাকশক্তি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। কিছু সময় তিনি ইংরেজি শব্দ যুক্ত বোর্ডের মাধ্যমে চোখের ইশারায় ভাব প্রকাশ করতেন। তারপর তিনি স্পীচ জেনারেটিং ডিভাইস যুক্ত স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার ব্যবহার করতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শুধু একটি গালের পেশি ছাড়া আর কিছুই নাড়াতে পারতেন না তিনি। এর সাহায্যেই তিনি চালিয়ে গেছেন তাঁর কাজ। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি একবার শ্বাসরোধ করে আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ সফল হননি।
বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মূল্যবান অবদান ছিল স্টিফেন হকিং-এর। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং বোর হাইজেনবার্গের কোয়ান্টাম তত্ত্বকে মিলিয়ে দেওয়া। গবেষণার পাশাপাশি রচনা করেছেন বিজ্ঞানভিত্তিক অসংখ্য জনপ্রিয় বই। তাঁর লেখা ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ বইটি তাঁকে জনপ্রিয়তার শিখরে নিয়ে যায়। ক্রমাগত ২৩৭ সপ্তাহ ধরে ‘বেস্ট সেলার’-এর তালিকায় থাকা বইটি ‘গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড’-এ জায়গা করে নেয়। এখানে সৃষ্টি তত্ত্ব ও মহাকাশ নিয়ে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন হকিং। তাঁর রচিত আরো কয়েকটি সুবিখ্যাত বই হল, ‘ব্রিফ আনসারস টু দ্য বিগ কোয়েশ্চেনস’, ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’, ‘দ্য থিয়োরী অফ এভরিথিং’, ‘দ্য ব্রিফার হিস্ট্রি অফ টাইম’, ‘দ্য ইউনিভার্স ইন এ নাটশেল’, ‘আনলকিং দ্য ইউনিভার্স’ প্রভৃতি। ছোটদের জন্যও তিনি অনেক বই লিখেছেন। এরকম কয়েকটি বই হল, ‘জর্জ’স সিক্রেট কি টু দ্য ইউনিভার্স’, ‘জর্জ’স কসমিক ট্রেজার হান্ট’, ‘জর্জ অ্যান্ড দ্য বিগ ব্যাং’, ‘জর্জ অ্যান্ড দ্য আনব্রেকেবল কোড’, ‘জর্জ অ্যান্ড দ্য ব্লু মুন’ প্রভৃতি।
হকিং এর জীবনকাহিনী ও তাঁর রচিত বই নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক সিনেমা ও টিভি শো। যেমন, ‘হকিং’, ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’, ‘স্টিফেন হকিং’স ইউনিভার্স’, ‘দ্য ইলেভেনথ ট্যুর’, ‘জিনিয়াস অফ ব্রিটেন’, ‘এলিয়েন প্ল্যানেট’, ‘দ্য আনবিলিভার্স’ প্রভৃতি।সারাজীবনে নিজের কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন হকিং। সৃষ্টিতত্ব সংক্রান্ত গবেষণার জন্য পেয়েছিলেন ‘বি.বি.ভি.এ ফাউন্ডেশন ফ্রন্টিয়ার অফ নলেজ’ পুরস্কার। বিজ্ঞান ও ব্রিটিশ সংস্কৃতিতে সারাজীবনের অবদানের জন্য পেয়েছিলেন ‘প্রাইড অফ ব্রিটেন’ পুরস্কার এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে প্রদত্ত পুরস্কার। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজের জন্য পেয়েছেন অ্যাডামস পুরস্কার, এডিংটন পদক, হিউ পদক, ম্যাক্সওয়েল মেডেল, অ্যালবার্ট আইন্সটাইন পুরস্কার, উলফ পুরস্কার, প্রিন্স অফ অস্ট্রিয়ানস পুরস্কার, আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম পদক, ফান্ডামেন্টাল অফ ফিজিক্স পুরস্কার ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এতো পুরস্কার পেয়েও তাঁর জীবনে একটি অভাব থেকেই গেছে, আর সেটি হল বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার নোবেল পুরস্কারের। অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করা সত্ত্বেও স্টিফেন হকিং পাননি নোবেল পুরস্কার। এই বিষয় নিয়ে অনেক বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছে।
২০১৮ সালের ১৪ই মার্চ ৭৬ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ শহরে স্টিফেন হকিং-এর মৃত্যু হয়।
3 comments