পঙ্কজ রায়

পঙ্কজ রায়

ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সুনীল গাভাস্কারের আগে অন্যতম জনপ্রিয় ক্রিকেট-তারকা ছিলেন পঙ্কজ রায় (Pankaj Roy)। প্রথম বাঙালি ক্রিকেটার হিসেবে শতরান করে ইতিহাসে নজির গড়ে তোলেন তিনি। চেন্নাইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বিনু মাঁকড়ের সঙ্গে ৪১৩ রানের বিশ্ব রেকর্ড ওপেনিং যুগলবন্দী তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে। ২০০০ সালে পঙ্কজ রায় ‘কলকাতার শেরিফ’ নির্বাচিত হন। সমগ্র ক্রীড়াজীবনে ৪৩টি টেস্ট খেলে মোট ২৪৪২ রানের মধ্য দিয়ে রেকর্ড গড়েছিলেন পঙ্কজ যার মধ্যে শতরানের সংখ্যা ছিল পাঁচটি। ১৯৫৯ সালে লর্ডসের মাঠে ভারতের হয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টস করতে নেমেছিলেন পঙ্কজ রায়। সেই সফরে বরোদার দত্তাজিরাও গায়কোয়াড়কে অধিনায়ক করা হলেও, তার অসুস্থতার কারণে সহ-অধিনায়ক হিসেবে মাঠে নেমেছিলেন পঙ্কজ রায়। পঞ্চাশের দশক জুড়ে তিনিই ছিলেন প্রথম বাঙালি তথা ভারতীয় ওপেনিং ব্যাটসম্যান।  

১৯২৮ সালের ৩১ মে উত্তর কলকাতার কুমোরটুলিতে এক ধনী, অভিজাত পরিবারে পঙ্কজ রায়ের জন্ম হয়। তাঁর পূর্বপুরুষরা ঢাকা বিক্রমপুরের ভাগ্যকুল গ্রামের জমিদার ছিলেন। তাঁরা এতটাই ধনী ছিলেন যে শোনা যায় একসময় পঙ্কজ রায়ের ঠাকুরদাদা প্রমথনাথ রায় নাকি নিজে ভারতীয় ব্যাঙ্ককে মোটা অঙ্কের টাকা ধার দিয়েছিলেন। ছোটবেলায় তিনি ক্রিকেটফুটবল দুই খেলাতেই সমানভাবে দক্ষ ছিলেন। বিখ্যাত বাঙালি ফুটবলার চুনী গোস্বামীর মতে পঙ্কজ রায় ক্রিকেটের বদলে যদি ফুটবলকেও বেছে নিতেন, তাহলে সেখানেও তিনি চূড়ান্ত সাফল্য পেতে পারতেন।

১৯৪৬-৪৭ সালে রঞ্জি ট্রফির ম্যাচের মধ্য দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট জগতে অভিষেক হয় পঙ্কজ রায়ের। ইডেন গার্ডেন্সে যুক্ত প্রদেশের বিপক্ষে প্রথম খেলতে নেমেছিলেন তিনি। সেই ম্যাচে বাংলার তখন ৮৪ রানে ৫ উইকেট পড়ে গেছে। কিন্তু পঙ্কজ রায় ১১২ রানে তখনও অপ্রতিরোধ্য। তাঁর দক্ষতার কারণেই সেই ম্যাচে বাংলার দল ১৪৫ রানে জিতে যায়। অভিষেকের পরে পরেই তিনি শতরানের রেকর্ড করেন এবং পরবর্তীকালে বেশ কিছু আন্তঃ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট ম্যাচে দক্ষতার পরিচয় রাখেন পঙ্কজ রায়। বাংলার ক্রিকেট দলের হয়ে প্রথমে ভারতীয় ডোমেস্টিক ক্রিকেটের জগতে তাঁর হাতেখড়ি হয় এবং ফার্স্ট-ক্লাস ক্রিকেট ম্যাচে অভিষেকের পর তিনি মোট ৩৩টি শতরান করেন। ভারতে স্বাধীনতার আশেপাশের সময়ে তখনও ডোমেস্টিক ক্রিকেটের প্রচলন ছিল বেশি। তাই ১৯৪৬-৪৭ সময়পর্বে মাত্র দুটি ফার্স্ট-ক্লাস ক্রিকেটে অংশ নিতে পেরেছিলেন পঙ্কজ রায়। এর পরের বছর কলকাতায় হোলকারের বিরুদ্ধে আরেকটি ম্যাচ খেলেন তিনি। ১৯৪৮-৪৯ সালে সেকালের অত্যন্ত শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য শতরান করার জন্য তিনি আজও সমানভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। বেঙ্গল গভর্নরস ইলেভেন দলের হয়ে সেই বছর খেলতে নামেন পঙ্কজ রায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২৫৫ রান ছিল, বাংলার দল তখন ৮ উইকেট হারিয়ে মাত্র ১৪৪ রান করেছে। সেই সময় সুরযুরাম গিরিধারীর সঙ্গে নবম উইকেটে খেলতে নেমে একত্রে ১৭৩ রান করতে সক্ষম হন পঙ্কজ রায় এবং তিনি নিজে ১০১ রানে অপ্রতিরোধ্য থাকেন। প্রায়োর জোন্স, জন গোডার্ড এবং ডেনিস অ্যাটকিনসন প্রমুখ বিখ্যাত বোলারদের প্রতিহত করেছিলেন পঙ্কজ রায়। তারপর কলকাতায় হোলকারের বিরুদ্ধে আবার একটি ম্যাচে ১৬৩ রান করে রেকর্ড গড়ায় বম্বে সফরে আসা এমসিসি (MCC)-র বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির হয়ে খেলতে নামার সুযোগ পান পঙ্কজ রায়।

এরপরেই ফার্স্ট-ক্লাস টেস্ট ক্রিকেটের জগতে পা রাখেন পঙ্কজ। সেই সময় মুশতাক আলী, বিজয় বণিক, লালা অমরনাথ প্রমুখ বিখ্যাত ক্রিকেটারদের জমানা শেষের পথে। এই কিংবদন্তী খেলোয়াড়দের প্রতিস্থাপন করা একপ্রকার অসম্ভব ছিল। ১৯৫১-৫২ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে ১৪০ রান করতে সক্ষম হন তিনি। এর আগে দিল্লি টেস্টের প্রথম দিনে তিনি মাঠে নামতে পারেননি, আবার দ্বিতীয় দিনে মাঠে নামলেও মাত্র ১২ রান করে আউট হয়ে গিয়েছিলেন পঙ্কজ। জর্জ ডার্কওয়ার্থ নামের এক প্রাক্তন ক্রিকেটারের সুপারিশে মুম্বাইয়ের দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে সুযোগ পান পঙ্কজ রায় আর সেই ম্যাচেই প্রথম বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে শতরান করে রেকর্ড করেন তিনি। মাদ্রাজে সিরিজের শেষ টেস্ট ম্যাচেও আবার একটি শতরান করে নজির করেন পঙ্কজ, মাদ্রাজের ম্যাচে তিনি ১১১ রান করেছিলেন। আর এর ফলেই ভারতীয় ক্রিকেট দল প্রথম ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে এবং প্রথম টেস্ট ক্রিকেটে জয়লাভের শিরোপা অর্জন করে। তারপর থেকেই পঙ্কজ রায়কে দ্বিতীয় বিজয় মার্চেন্ট হিসেবে অভিহিত করা হয়। সেই আত্মবিশ্বাসেই ১৯৫২ সালে ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই সফরে তিনি চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হন। সাতটি টেস্টের মধ্যে তিনি পাঁচটিতেই পরাজিত হন, তার মধ্যে চারটিতে একেবারে ক্রমান্বয়ে পরাজিত হয়েছিলেন পঙ্কজ রায়। পরে ১৯৫৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ম্যাচে আবার নিজের দক্ষতা প্রদর্শন করেন তিনি। কিংস্টনের চূড়ান্ত টেস্টে ১৫০ রান করেছিলেন পঙ্কজ। বিজয় মঞ্জরেকরের সঙ্গে যুগলে ২৩৭ রান করে পরবর্তী ২৬ বছর ধরে নজির রেখেছিলেন তিনি। ৪৩টি টেস্টে তিনি মোট ২৪৪২ রান করেছিলেন এবং তার মধ্যে ৫টি শতরানও ছিল। ১৯৫৬ সালে মাদ্রাজে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচে বিনু মাঁকড়ের সঙ্গে ৪১৩ রানের ওপেনিং করেছিলেন পঙ্কজ রায় এবং সেই ম্যাচে তিনি নিজে মোট ১৭৩ রানে অপ্রতিরোধ্য থাকেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে বিনু মাঁকড় সেই ম্যাচে দ্বিশত রান করেছিলেন। অনেকে বলে থাকেন সেই ম্যাচে পঙ্কজ রায়ের বেশি রান না করার পিছনে এক চক্রান্তই দায়ী ছিল। তবে এই ম্যাচের আগে থেকেই দৃষ্টিশক্তির কিছু সমস্যা অনুভব করছিলেন তিনি এবং তাতে ক্রিকেট খেলতেও বেশ সমস্যা হচ্ছিল তাঁর। সেই সব বাধা উপেক্ষা করে মাদ্রাজের সেই ম্যাচে তাঁর দক্ষতা প্রদর্শন এক যোগ্য জবাব ছিল। ১৯৫৮-৫৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাস্ট বোলিং-এর বিরুদ্ধে ৩৩৪ রান করতে সক্ষম হন পঙ্কজ। তাঁর ব্যাটিং কৌশল বা পদ্ধতি নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকলেও তাঁর রান বা ফলাফল সেই সব প্রশ্নের যোগ্য জবাব দিয়েছে। ১৯৫৯ সালে ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় সফরের টেস্ট ম্যাচ খেলে দেশে ফিরে এসে নয়া দিল্লিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলায় ভারতীয় দলের পরাজয় হলেও তাঁর বীরত্বপূর্ণ ৯৯ রান আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। কিন্তু সেই ম্যাচে অ্যালান ডেভিডসনের ফাস্ট সুইং বোলিং-এর বিরুদ্ধে তাঁর ত্রুটিপূর্ণ ব্যাটিং অনেকের দ্বারাই সমালোচিত হয়েছিল। তবে ১৯৫৯ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে লর্ডসের মাঠে ভারতের হয়ে টস করতে নেমেছিলেন পঙ্কজ রায়। কিন্তু সেই সফরে ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ছিলেন না তিনি। এই ম্যাচের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভয়ানক বোলিং-এর বিরুদ্ধে পঙ্কজ রায়ের ব্যাটিং দক্ষতা দেখে আপামর ভারতবাসী ভেবেছিলেন যে ইংল্যান্ড সফরে তাঁকেই অধিনায়ক করা হবে। কিন্তু ঐ সময় টাকার হিসেবে পাউন্ডের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের খরচ অনেকটাই বৃদ্ধি পায় আর এই বর্ধিত খরচের সিংহভাগ বহন করতে সম্মত হন বরোদার তৎকালীন মহারাজ। তবে তাঁর দুটি শর্ত ছিল – প্রথমত তিনিই হবেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের ম্যানেজার এবং দ্বিতীয়ত বরোদার ক্রিকেটার দত্তাজিরাও গায়কোয়াড়কেই দলের অধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত করতে হবে। মাত্র ছয়-সাতটি টেস্ট ম্যাচ খেলা গায়কোয়াড় অধিনায়ক নির্বাচিত হলেও লর্ডসের ম্যাচের কিছুদিন আগেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে মাঠেই আর নামা হয় না তাঁর। তার ফলেই অধিনায়কত্ব করার সুযোগ পান পঙ্কজ রায়।    

তবুও ১৯৬০-৬১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে মাত্র ২৩ রান করার পরে তাঁকে ভারতীয় ক্রিকেট দল থেকে বাদ দেওয়া হয়। সেই সময় প্রায় ঠিকই হয়ে গিয়েছিল যে পঙ্কজ রায় হয়তো আর ক্রিকেটে ফিরে আসতে পারবেন না। সেটাই চূড়ান্ত পরিণতি হল। পাকিস্তানের সঙ্গে টেস্ট ম্যাচটাই তাঁর ক্রিকেট জীবনের অন্তিম খেলা ছিল।     

মূলত প্রতিরক্ষামূলক খেলার ধরনেই অভ্যস্ত ছিলেন পঙ্কজ রায়, তবে সময় বিশেষে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং-ও করেছেন তিনি। একাগ্রতা আর কঠোর সঙ্কল্প ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। তবে ক্রিকেট ছাড়াও আইএফএ (IFA) দলের হয়ে বর্মার বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন পঙ্কজ রায়। কলকাতায় প্রথম ডিভিশন ফুটবল খেলা থেকে শুরু করে রাইফেল শ্যুটিং-এ সর্বভারতীয় স্তরে তৃতীয় স্থান অর্জন করা এবং একজন ভাল সাঁতারু হিসেবেও তিনি ছিলেন সর্বজনবিদিত এক অলরাউন্ডার স্পোর্টসম্যান।

২০০১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ৭২ বছর বয়সে পঙ্কজ রায়ের মৃত্যু হয়।  

One comment

আপনার মতামত জানান