চুনী গোস্বামী(Chuni Goswami) ভারতীয় ফুটবল জগতের এক কিংবদন্তী ফুটবলার যিনি ক্রিকেটার হিসেবেও একজন দক্ষ অলরাউন্ডার ছিলেন। চুনী গোস্বামী ভারতীয় ফুটবল দলের স্বর্ণযুগের একজন অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন।
১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি অবিভক্ত বাংলার কিশোরগঞ্জে চুনী গোস্বামীর জন্ম হয়। তাঁর প্রকৃত নাম সুবিমল গোস্বামী হলেও ‘চুনী গোস্বামী’ নামেই তিনি বেশী জনপ্রিয়। মাত্র নয় বছর বয়সে গুরু বলাই দাস চ্যাটার্জির হাত ধরে মোহনবাগান জুনিয়র টিমে প্রবেশ তাঁর। তারপর আজীবন মোহনবাগানের হয়েই খেলে গেছেন তিনি। তাঁর ফুটবল জীবন শুরু হয় ইনসাইড-লেফ্ট হিসেবে। জনশ্রুতি যে তাঁর মোহনবাগানের হয়ে প্রথম মাঠে নামাটাই ছিল ভাগ্যের জোরে। দু’জন খেলোয়াড় অনুপস্থিত থাকায় তিনি মাঠে নামার সুযোগ পেয়ে যান।। ১৯৫৪ সালে সিনিয়র টিমের হয়ে দিনচলা শুরু হয় তাঁর ।
বল পায়ে তাঁর ভেল্কি অবাক করে দিত বিপক্ষদলকে। ময়দানে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘ড্রিবলিংয়ে রাজা’ হিসেবে। শোনা যায় জে সি গুহ তাঁকে ইস্টবেঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ফিয়াট গাড়ি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও টলানো যায়নি তাঁকে। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ক্লাব টটেনহ্যাম হটসপার থেকে তাঁর ডাক এলেও, মোহনবাগান ক্লাবের একজন বিশ্বস্ত ফুটবলার হয়েই ১৯৫৪-১৯৬৮ সাল অবধি এক টানা খেলে যান তিনি। মোহনবাগান টানা তিন বার ডুরান্ড কাপ জেতে তাঁর নেতৃত্বে। মোহনবাগানের এই সময়কাল ছিল ক্লাবের সোনার সময়। চুনী মোহনবাগানের হয়ে ২০০ গোল করেছেন, এনেছেন ৩১টা ট্রফি।
ফুটবলার হিসেবে তাঁর আর্ন্তজাতিক জীবনের শুরু ১৯৫৬ সালে চীনের অলিম্পিক টিমের বিরুদ্ধে।১৯৬২ সালে চুনী গোস্বামীর নেতৃত্বেই জাকার্তা এশিয়াডে সোনা জয়ী হয় ভারত। ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে এটি একটি উজ্বল দিন। তাঁর অধিনায়কত্বেই ১৯৬৪ সালে এশিয়া কাপে আর মারডেকা কাপে রুপো জেতে ভারত। চুনী গোস্বামী ৩০ টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল করেছেন ৯টি। বার্মা, হংকং, ইরান, থাইল্যান্ড, দক্ষিন ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে গোল করেন তিনি। মাত্র ২৭ বছর বয়সে তাঁর এই বর্ণময় ফুটবল জীবনে ইতি টেনে ফুটবল জগত থেকে অবসর নেন তিনি।
ফুটবল জীবন থেকে অবসর নিয়ে তিনি মন দেন ক্রিকেট জীবনে। ১৯৬২-১৯৬৩ সালে চুনী গোস্বামীর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট জীবনের সূচনা হয়। তিনি ছিলেন একজন ডান হাতি ব্যাটসমান এবং একজন ডান হাতি মিডিয়াম পেসার । যদিও তাঁর ক্রিকেট জীবনের শুরু তার ফুটবল জীবনের অবসরের পর, তবু তাঁর এই দ্বিতীয় জীবন তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দেয়। ৪৬ টা প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলে তিনি ৪৭ টি উইকেট সহ ১৫৯২ রান করেন ১টি শতক আর ৭টি অর্ধ শতকের সাথে। তাঁর অধিনায়কত্বে বাংলা দল রঞ্জী ট্রফির ফাইনালে পৌঁছে ব্রেবোর্ণ স্টেডিয়ামে বোম্বের কাছে শেষ পর্যন্ত হেরে যায়। প্রাক্তন ওয়েষ্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটার স্যার গ্যারি সোবার্স তাঁর খেলা দেখে তাঁর সম্বন্ধে জানতে চেয়ে তাঁর ফুটবলার পরিচয় পেয়ে খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে বিশ্বসেরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে মধ্যাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে খেলা ক্রিকেটারদের নিয়ে যৌথ একাদশে চুনী গোস্বামী ছিলেন। চুনীর করা বল খেলতে গিয়ে রোহন কানহাই পর্যন্ত বলেছিলেন ‘‘কী ভয়ঙ্কর সুইং করছে রে বাবা। খেলাই তো যাচ্ছে না।’’ এমনকি আম্পায়ারের কাছে নতুন করে গার্ডও চান কানহাই। সেই ম্যাচে ৪৭ রানে পাঁচ উইকেট নেন চুনী।
তাঁর কর্ম জীবনে চুনী গোস্বামী জেতেন অসংখ্য পুরস্কার। খেলাধুলোর জীবন থেকে অবসরের পরেও তাঁর ঝুলি ভরে ওঠে পুরস্কারে। ১৯৬২ সালে তিনি জেতেন ‘বেস্ট স্ট্রাইকার অব্ এশিয়া’ পুরস্কার। ১৯৬৩ সালে চুনী গোস্বামী পান অর্জুন পুরস্কার। ২০০৫ সালে পান মোহনবাগান রত্ন। এই উল্লেখযোগ্য পুরস্কার গুলো ছাড়াও অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
৩০ এপ্রিল ২০২০ সালে চুনী গোস্বামীর মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র
- বর্তমান পত্রিকা, ১মে ২০২০, ১৮ ই বৈশাখ ১৪২৭
- The Telegraph, 1st may 2020
- https://en.m.wikipedia.org/
- https://www.google.com/
- https://www.anandabazar.com/
One comment