আথিরাপল্লি

আথিরাপল্লি জলপ্রপাত ভ্রমণ

গ্রীষ্মকালে আথিরাপল্লি জলপ্রপাত।
গ্রীষ্মকালে আথিরাপল্লি জলপ্রপাত। ছবি সববাংলায়

বাহুবলীর শিবার সেই জলপর্বতের কথা মনে আছে? মনে আছে তার গ্রামের কথা? তারপরে তার বিখ্যাত সেই “ধিভারা” গানটির দৃশ্যায়ন একবারে যেন স্বর্গীয়, অপার্থিব। তাই না? মনে আছে মনি রত্নম পরিচালিত  হিন্দি সিনেমা “রাবণ”-এর “বেহেনে দে” গানটির দৃশ্যায়ন?  অথবা দিল সে সিনেমার “জিয়া জলে” গানটি? এরকম প্রচুর সিনেমার প্রচুর গান থেকে শুরু করে ছবির বিভিন্ন অংশের শুটিং এর জন্য পরিচালকদের অন্যতম পছন্দ আর সিনেমাটোগ্রাফারদের স্বর্গরাজ্য কেরালার আথিরাপল্লি জলপ্রপাত। হিন্দি, তামিল, তেলেগু, মালয়ালাম, ইংরাজি ছাড়াও আরও প্রচুর সিনেমার শুটিং হয়েছে এই জায়গায়। হবে নাই বা কেন, এত সুন্দর জলপ্রপ্রাত কমই আছে। এর এই সৌন্দর্যের জন্যই তো আথিরাপল্লিকে কেরলের অনেকেই ভারতের নায়াগ্রা বলে থাকে। সেই সৌন্দর্যের টানে প্রতি বছর এখানে প্রায় ৭০ লক্ষ পর্যটকেরা ভিড় জমায়।

চালাকুড়ি নদী কেরালার পঞ্চম দীর্ঘতম নদী। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার আনাইমালাই রেঞ্জ থেকে উৎপন্ন হয়ে এই নদী পালাক্কাদ , থ্রিসুর এবং এর্নাকুলাম জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। থ্রিসুর জেলার চালাকুড়ি তালুকে চালাকুড়ি নদী বেশ খরস্রোতা হয়ে বিখ্যাত আথিরাপল্লি জলপ্রপাতটি তৈরি করেছে। এটি প্রায় ৮০ ফুট উঁচু এবং কেরলের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত।

নদীর পাড়ে গা ভেজাচ্ছে একটি হাতি।
নদীর পাড়ে গা ভেজাচ্ছে একটি হাতি। ছবি সববাংলায়

সারা বছর ধরেই এই জলপ্রপাতের রূপের মোহে মানুষ চারিদিক থেকে ছুটে আসে। গ্রীষ্মকালে এর রূপ সেইভাবে বোঝা না গেলেও এর আসল রূপ কিন্তু দেখা যায় বর্ষাকালে, যখন নদী জলে ভরে থাকে। সেই সময়ে আথিরাপল্লিকে দেখলে নায়াগ্রার কথা মনে পড়ে যাবে। তাই তো সেখানের আঞ্চলিক অনেকের মতেই এর নাম রাখা হয়েছে ভারতের নায়াগ্রা। তবে ২০১৮ এর কেরালার বন্যার সময় এখানে মাত্রাতিরিক্ত জলস্ফীতি হয়েছিল। প্রচণ্ড সেই জলের স্রোতে দূর দূর অবধি কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। পর্যটকদের জন্য বন্ধ ছিল এই জলপ্রপাতটি। সেই দৃশ্য বেশ ভয়ঙ্কর। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আপনি চাইলে ইন্টারনেটে খুঁজে দেখতেই পারেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

তবে এখানে শুধু  এই জলপ্রপাতটিই না, আরও যে কারণে জায়গাটি গুরুত্বপূর্ণ, তা হল এখানকার জীববৈচিত্র্য।  আথিরাপল্লি রেইনফরেস্ট  বহু বিপন্ন ও স্থানীয় প্রজাতির আবাসস্থল। বন্যপ্রাণী বলতে  হাতি, বাঘ, চিতাবাঘ, বাইসন, সাম্বার হরিণ, লায়ন টেইল্ড ম্যাকক বাঁদর ইত্যাদি আছে। কেরালা রাজ্যের পাখি হর্ণবিলদের স্বর্গরাজ্য এই বন।

আথিরাপল্লি যাবার রাস্তা।
আথিরাপল্লি যাবার রাস্তা। ছবি সববাংলায়

কোচি থেকে আথিরাপল্লি জলপ্রপাত প্রায় ৭০ কিলোমিটার। অনায়াসেই কোচি থেকে আথিরাপল্লিতে একদিনের ঘোরার প্ল্যান করা যায়। নিজের গাড়ি বা ভাড়ার গাড়ি করে সোজা আথিরাপল্লি চলে আসুন। উপভোগ করুন এখানকার সৌন্দর্য, কাছেপিঠে আরও দুটো জলপ্রপাত আছে। সে দুটোও ঘুরে দেখতে পারেন, তারপর গাড়ি ধরে আবার কোচি। এয়ারপোর্ট থেকে আথিরাপল্লি ৩৫ কিলোমিটার দূরে। ট্রেনলাইনে আসতে চাইলে কাছাকাছি স্টেশন হল থ্রিসুর। এয়ারপোর্ট বা স্টেশন দু জায়গা থেকেই আথিরাপল্লি আসার গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। যদি আথিরাপল্লিতে থাকার হোটেল ভাড়া করেন, তাহলে তাদের থেকেও গাড়ি বুক করে নিতে পারেন। যেহেতু জায়গাটি শহর থেকে বাইরে, সবকটা ক্ষেত্রেই প্রায় আপনাকে একই ভাড়া দিতে হবে। তবে রাস্তাটার দুইপাশের শোভা দেখতে দেখতে যখন এগিয়ে যাবেন, তখন কিন্তু ভাড়া পুষিয়ে যাবে।  দুইপাশে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ঘুরে ঘুরে পাহাড়ের ওপর গাড়ি উঠতে থাকে। একপাশে নিচে বয়ে চলেছে চালাকুড়ি নদী। নদীর শোভা দেখতে দেখতে এই যাত্রাপথটাও সমানভাবে উপভোগ্য।

আথিরাপল্লির হোটেল

রাস্তার অবস্থা খুবই ভালো। তবে আরও একটা রাস্তা আছে। যার দুইপাশে পাম গাছ, নারকেল গাছের এক অপরূপ শোভা। কিন্তু রাস্তা ততধিক খারাপ। প্রথম রাস্তাটিই ধরতে পারেন, রোমাঞ্চ কিছু কম হবে না। বরং ভাগ্য ভালো থাকলে বন্য প্রাণীর দেখা পাওয়া যেতে পারে। মাঝে মধ্যেই রাস্তার মাঝে কিছু বন্য প্রাণী এসে পড়ে, গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে। আবার ভাগ্য খুব খারাপ থাকলে ধস নামাও দেখতে পারেন। তবে সম্ভাবনা খুব কম এবং কাম্যও নয়। তার থেকে বন্যপ্রাণী বেশ রোমাঞ্চকর। তবে নিশ্চিত ভাবে বন্যপ্রাণী দেখতে হলে আরও ওপরে যেতে হবে। স্থানীয় লোকেরা এই রাস্তার পাশের জঙ্গলকে বলে ছোট বন আর আরও ওপরে আথিরাপল্লি জলপ্রপাত পেরিয়ে ঘন যে জঙ্গল তাকে বলে বড় বন। সেখানে নাকি প্রচুর প্রাণীর দেখা মেলে।

হোটেল বা রিসোর্ট এখানে প্রচুর আছে। কিছু রিসোর্ট থেকে জলপ্রপাত সরাসরি দেখা যায়। সেই দৃশ্য যেমন অসাধারণ তেমনই এইসব রিসোর্টের দাম তুলনামূলক ভাবে বেশি। আবার কিছু রিসোর্ট আছে নদীর পাশে। সকালবেলা ঘুরে এসে সন্ধ্যাবেলা রিসোর্টের ব্যালকনি থেকে যখন দূরে আথিরাপল্লির সাদা ফেনার স্রোতের ওপর সূর্যের লাল আভা দেখবেন, তখন মনে হবে যেন রূপোলী পর্দার কোন দৃশ্য। বুঝতে পারবেন কেন সিনেমা পরিচালকেরা বারবার ছুটে আসে এখানে, কখনও এই দৃশ্য পুরনো হয়ে যায় না। বিভিন্ন সিনেমাতে বিভিন্ন ভাবে আমরা দেখি আথিরাপল্লিকে। যদি নদীর পাশের রিসোর্টে থাকেন, তাহলে পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী আপনার মন সতেজ করে দেবে। যদি অন্য রিসোর্টেও থাকেন, তাহলে রাতের বেলায় পাহাড়ের শান্ত প্রকৃতি আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আপনার মনকে অপার্থিব করে তুলবেই।

জলপ্রপাতের আগের নদী। গ্রীষ্মকালে একটু জল কম।
জলপ্রপাতের আগের নদী। গ্রীষ্মকালে একটু জল কম। ছবি সববাংলায়

সকাল সকাল আথিরাপল্লি জলপ্রপাত ঘুরে আসাই ভালো। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা অবধি খোলা। হোটেল বা রিসোর্ট থেকেই গাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। সঙ্গে অবশ্যই নিজের সরকারি পরিচয়পত্র রাখবেন। জলপ্রপাত অঞ্চলে এসে টিকিট কাটতে হবে। নিজেদের জন্য, গাড়ির জন্য এবং যদি সঙ্গে ক্যামেরা থাকে তারজন্য। একই টিকিটে কিছুদূরের ভাজাচল জলপ্রপাতও ঘুরে আসা যায়। টিকিট কেটে চলে আসুন মেন গেটে।

সুন্দর করে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা এর সদর দরজা বা মেন গেট। সিকিউরিটিকে টিকিট দেখিয়ে ঢোকার পর কিছুক্ষণের রাস্তা। হাতে খাবারের প্যাকেট যদি থাকে তাহলে চারপাশের গাছ থেকে আপনাকে স্বাগত জানাবে আসবে বাঁদরের দল। অতএব মোবাইল, ব্যাগ সামলে রাখুন।  সামনে এগিয়ে আসার পর বিস্তর সেই প্রান্ত পাবেন, যার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। বর্ষায় এলে বেশ ভরা পাবেন, গ্রীষ্মকালে নদীর জল অনেকটাই কম। সেসময় গিয়ে পা ভেজাতে পারেন নদীর জলে, কিন্তু অবশ্যই গভীরতা দেখে। জীববৈচিত্র্যে ভরা আথিরাপল্লির ওপরে নদীর ওপাড় থেকে কোন না কোন প্রাণী বেরিয়ে এসে জল খায়, তো স্নান করে। হাতি তো হামেশাই আসে। অপূর্ব লাগে দেখতে।

আরেকটি ভিউপয়েন্ট।
আরেকটি ভিউপয়েন্ট। ছবি সববাংলায়

নদীর পাশ দিয়েই জলপ্রপাতের নিচে যাওয়ার রাস্তা। অর্থাৎ আরেকটি ভিউপয়েন্ট। জঙ্গলের সরু রাস্তা দিয়ে নামতে নামতে বেশ রোমাঞ্চ লাগবে, কখন কোন জন্তু বেরিয়ে পড়ে এই ভেবে। এখানে  জলপ্রপাত দেখা যায় সামনে থেকে। তার শব্দে বসে থাকতে ইচ্ছে করে অনেকক্ষণ। তবে খুব বেশিক্ষণ না বসে বেরিয়ে পড়তে পারেন কিছুটা দূরেই রাস্তার পাশে চারপা জলপ্রপাতের দিকে। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ থেকে চলে আসুন ভাজাচাল জলপ্রপাতে। একদিনেই এই তিনটে জলপ্রপাত দেখে নেওয়া যায়। তবে সন্ধ্যের মধ্যে রিসোর্টে ফিরে আসাই কাম্য। যদি আথিরাপল্লিতেই থাকার প্ল্যান করেন তাহলে এখান থেকে ঘুরে আসতে পারেন মালাক্কাপারা, ভাল্পারাই, শোলায়ার ড্যাম এইসব জায়গায়।

বর্ষাকালে আথিরাপল্লি নবযৌবন পায়, সেই সময় তাকে সুন্দর লাগে সবচেয়ে বেশি। তবে একই সাথে ভয়ঙ্করও বটে, তাই বর্ষাকাল বাদ দেওয়াই যুক্তিসঙ্গত। আবার গ্রীষ্মকালে এর রূপ ঠিক বোঝা যায় না, জল থাকে অনেক কম।  যাবার দারুণ সময় হল সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস।


ট্রিপ টিপস

  • কিভাবে যাবেন – কোচি শহর থেকে আথিরাপল্লি জলপ্রপাত প্রায় ৭০ কিলোমিটার। নিজের গাড়ি বা ভাড়ার গাড়ি করে সোজা আথিরাপল্লি চলে আসুন। এয়ারপোর্ট থেকে আথিরাপল্লি ৩৫ কিলোমিটার দূরে। ট্রেনলাইনে আসতে চাইলে কাছাকাছি স্টেশন হল থ্রিসুর। এয়ারপোর্ট বা স্টেশন দু জায়গা থেকেই আথিরাপল্লি আসার গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়।
  • কোথায় থাকবেন – জলপ্রপাতের কাছাকাছি রিসোর্ট বুক করুন। অসাধারণ দৃশ্য পাবেন বিশেষ করে সূর্যাস্তের সময়। মনে হবে রূপোলী পর্দার কোন দৃশ্য।
  • কি দেখবেন – আথিরাপল্লি জলপ্রপাত, সেই একই টিকিটে দেখুন কিছুদূরের ভাজাচল জলপ্রপাত।
  • কখন যাবেন – বর্ষাকাল বাদ দিন। আবার গ্রীষ্মকালে কম জল থাকার দরুণ এর রূপ ঠিক বোঝা যায় না।  যাবার দারুণ সময় হল সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস।
  • সতর্কতা – 
    • সকাল সকাল আথিরাপল্লি জলপ্রপাত ঘুরে আসুন। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা অবধি খোলা। হোটেল বা রিসোর্ট থেকেই গাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। সঙ্গে অবশ্যই নিজের সরকারি পরিচয়পত্র রাখবেন।
    • বয়স্ক মানুষ বা যাদের শারীরিক দুর্বলতা বেশি তারা এখানে না যাওয়াই ভালো। যেহেতু জলপ্রপাতের প্রধান গেট থেকে জলপ্রপাতের ভিউপয়েন্ট অবধি অনেকটা রাস্তা। তাছাড়া নিচের ভিউপয়েন্টে যাবার জন্য যথেষ্ট শারীরিক ধকল যাবে।
    • জলপ্রপাতের ওপর থেকে নিচে অবধি অনেকটা রাস্তা। ক্লান্তির সম্ভাবনা প্রচণ্ড। তাই সঙ্গে গ্লুকোজ, জল, বিস্কুট বা চকোলেট রাখুন। খুব বেশি জিনিসপত্র নিয়ে পিঠ ভারী না করে আরামদায়ক পোশাক আর পাহাড়ে হাঁটার উপযোগী জুতো পড়ুন।
    • প্লাস্টিকের বোতল এদিক ওদিক ফেলবেন না।  এখানে প্রাণীদের ক্ষতি হতে পারে।
    • জলপ্রপাতের কাছে দোকানগুলো থেকে পানীয় কিনে সেখানেই খেয়ে নিন। না হলে জলপ্রপাত থেকে বাইরের রাস্তার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে স্থানীয় বাঁদরেরা এসে হাত থেকে ছিনিয়ে নেবে। না দিলে আপনার গায়ে উঠে আঁচড়েও দিতে পারে।
  • বিশেষ পরামর্শ – জলপ্রপাতের কাছে দোকানগুলো থেকে পানীয় কিনে থাকলে বোতলগুলো না ফেলে গেটে জমা দিন। সিকুরিটি আপনাকে এর জন্য বিনিময় মূল্য দেবে।

2 comments

  1. আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য ধন্যবাদ জানাই। আমরা আমাদের সম্পাদকীয় বিভাগকে বিষয়টি জানাব

  2. সুদীর্ঘ তেইশ বছর দক্ষিণে বাস করার ফলে দাক্ষিণাত্যের প্রতি আমার এক স্বাভাবিক টান গড়ে উঠেছে। তাই লেখাটি পড়ে বড় ভালো লাগলো।
    প্রসঙ্গত জানাই, দক্ষিণ ভারতের ভাষাসমূহে “থ”, “ধ”, “খ”, “ঠ” প্রভৃতির কোন অস্তিত্ব নেই। ফলে, ইংরেজি “th”-এর উচ্চারণ “ত” হয়, “থ” নয়। ফলতঃ, “আতিরাপল্লী”/”আদিরাপল্লী” হবে সঠিক উচ্চারণ, “আথিরাপল্লী” নয়।

আপনার মতামত জানান