দক্ষিণ দিনাজপুরের এক অন্যতম ইতিহাসঘেরা জায়গা বাণগড় । মৌর্য, তুর্কি, গুপ্ত, সেন, বর্মণ প্রভৃতি বংশের রাজাদের শাসনকালের চিহ্ন বুকে নিয়ে পুরাতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের আকর হয়ে উঠেছে এই বাণগড় । সম্প্রতি পুরাতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে বাণগড়ের স্থানমাহাত্ম্য বেড়ে গেছে বহুলাংশে। তাই দূর্গনগরী বলে পরিচিত এই বাণগড়ে এসে বাংলার সুপ্রাচীন ইতিহাসকে খানিক ঘেঁটে দেখতে ইচ্ছে হলে চলে আসাই যায় সপ্তাহান্তের এক-দুদিনের ছুটিতে।
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুরের অন্তর্গত একটি অন্যতম প্রাচীন শহর এই বাণগড়ের ৪৫ কিমি দক্ষিণেই রয়েছে বালুরঘাট শহর। গঙ্গারামপুর সদর শহর থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে পুনর্ভবা নদীর পাশে গঙ্গারামপুর থানার অধীনেই এই বাণগড় অবস্থিত।
প্রাচীন শহর হিসেবে এই বাণগড় একসময় কোটিবর্ষ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং বৃহত্তর ক্ষেত্রে পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির অন্তর্গত ছিল। চন্দ্র, বর্মন ও সেন রাজবংশের রাজত্বকালে বাণগড়ের রাজধানী ছিল মহাস্থানগড়। রাজা লক্ষ্মণ সেন বখতিয়ার খিলজির কাছে পরাজিত হওয়ার পরে এই সমগ্র অঞ্চলের রাজধানী স্থাপিত হয় দেবকোটে। এই দেবকোটেই মৃত্যু হয় বখতিয়ার খিলজির। বায়ু পুরাণ এবং বৃহৎ সংহিতায় প্রথম কোটিবর্ষ শহরের কথা জানা যায়। অভিধান সংকলক হেমচন্দ্র এবং পুরুষোত্তম এই অঞ্চলের একাধিক নামের উল্লেখ করেছেন। উমাবাণা, বাণপুরা, শোণিতাপুরা ইত্যাদি নামেও বাণগড়কে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে তাঁদের অনুমান। পাল যুগের লেখক সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর লেখা রামচরিত-এ এই প্রাচীন শহরের দীঘি ও মন্দিরগুলির বর্ণনা দিয়েছিলেন। অনেকে আবার এই অঞ্চলথেকেব কে পাল রাজা রামপালের রাজধানী রামাবতী বলে চিহ্নিত করেছেন। এটিকে আদপে পুণ্ড্রবর্ধন বা রাঢ় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত বলেই একটা সময় মনে করা হত। দেবীকোটে আদিকালে ব্রাহ্মণদের বসবাস ছিল বেশি। ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজির শাসনকালের মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসন শুরু হয় এবং এই অঞ্চল তখন লক্ষ্ণাবতী বা লক্ষ্ণৌটি নামে পরিচিত ছিল। স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস যে এই অঞ্চলে অসুররাজ বাণের একটি দূর্গ ছিল এবং পুরাণে বলা আছে এই বাণরাজা তাঁর সহস্র বাহু এবং শিবের বরের জোরে অজেয় হয়ে উঠেছিলেন। দ্বাপর যুগে কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ বাণ রাজার কন্যা উষার প্রেমে পড়ে বাণের প্রাসাদ থেকে উষাকে নিয়ে পালিয়ে যান। রাজা বাণ তাঁদের দুজনকেই পথের মধ্যে বন্দি করেন। এদিকে এই সংবাদে দ্বারকা থেকে কৃষ্ণ, বলরাম ও প্রদ্যুম্ন ছুটে আসেন অকুস্থলে। বাণকে শিব রক্ষা করতে এলে কৃষ্ণের সঙ্গে শিবের ভয়ানক যুদ্ধ হয় এবং সেই যুদ্ধ শুরু হলে বাণরাজা পরাস্ত হন এবং তাঁর ৯৯৮টি হাত কাটা যায়। পুরাণে এই যুদ্ধকে অনেকক্ষেত্রে ‘হরি-হর যুদ্ধ’ বলা হয়েছে। ব্রহ্মা নিজে এই যুদ্ধ থামাতে বাধ্য হয়েছিলেন। আবার লোককথায় পাওয়া যায় যে এই অঞ্চল ছিল অসুররাজ বলির রাজধানী এবং বলির ছেলে ছিলেন বাণ। এই সুপ্রাচীন জনশ্রুতি সমৃদ্ধ অঞ্চলের পিছনে ঐতিহাসিক মাহাত্ম্যও লুকিয়ে রয়েছে। এই অঞ্চলের একটি রাস্তার নামও ‘উষাহরণ রোড’, ফলে বোঝাই যায় যে লোককথা ও পৌরাণিক কাহিনী এখানকার বাতাসে মিশে আছে।
২০০৮-০৯ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে খনকার্য শুরু হলে মৌর্য ও সুলতানি যুগের বেশ কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন আবিষ্কার করা হয়। এখানে পাওয়া রূপোর মুদ্রা, হাতির দাঁতের ছুরি, পাথরের মূর্তি ইত্যাদি দেখে গবেষকরা মনে করেন যে বাণগড়ে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে ছিল এক সমৃদ্ধ নগর। পাল সম্রাট প্রথম মহীপালের শাসনকালে দেবীকোটের অংশ ছিল বাণগড়, এই তথ্যও পাওয়া গেছে। আর এই পুরাতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে এই অঞ্চলের মাহাত্ম্যও ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। মানুষ আর ইতিহাস এখানে একসাথে বাস করে। কাছেই এক আদিবাসী গ্রামে চারটি প্রাচীন গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভ রয়েছে, মনে করা হয় এগুলি কোনো প্রাচীন বিষ্ণুমন্দিরের অংশবিশেষ। স্থানীয় আদিবাসীরা একে ‘পাথরের কলাগাছ’ বলে থাকে। একের পর এক ঢিপি খনন করে পাওয়া গেছে বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন। চারদিকে দূর্গের পরিখার অস্পষ্ট উপস্থিতির কারণে একে অনেকে দূর্গনগরী বলেও চিহ্নিত করে থাকেন। মনে করা হয় এখানকার মাটি খুঁড়ে পাওয়া পঞ্চরথ নাকি ওড়িশার লিঙ্গরাজ মন্দিরের থেকেও প্রাচীন। ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন ঢিপি, পরিখা, পোড়ামাটির ইটের জ্যামিতিক কাঠামো সব মিলিয়ে টাইম মেশিনে চেপে প্রাচীন ইতিহাসের বুকে ঝাঁপ মেরে আসা যায় সহজেই।
রেলপথে বাণগড়ে আসতে হলে দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট স্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে সোজা গাড়ি করে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় বাণগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে। এছাড়া গাড়িতে আসতে হলে বুনিয়াদপুর থেকে বালুরঘাটের দিকে ৫১২ নং জাতীয় সড়ক ধরে যেতে যেতে যে রাস্তাটা গঙ্গারামপুর থেকে শিববাটির দিকে বেঁকে গেছে উত্তরে, সেই রাস্তা বরাবর গেলেই পথের উপর দেখা যাবে দূর্গনগরী বাণগড়। মালদা কিংবা রায়গঞ্জ থেকেও সড়কপথে এখানে গাড়ি করে আসা যায়। বিমানের ক্ষেত্রে নিকটবর্তী বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে ২৫২ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে গাড়িতে বা বাসে চেপে আসতে হবে বাণগড়ে। তবে যেহেতু এই অঞ্চল চেনা ছকের রাস্তায় পড়ে না, তাই এখানে সরাসরি গাড়ি নিয়ে আসাই ভালো। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী শিলিগুড়ি থেকে ট্রেনে করে বালুরঘাট আসার একটি ট্রেনই খুব জনপ্রিয়, সেটি হল শিলিগুড়ি-বালুরঘাট ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস (১৫৪৬৪) যা সকাল ৮টায় শিলিগুড়ি থেকে রওনা দিয়ে দুপুর ৩টে ৪৫ মিনিটে বালুরঘাটে পৌঁছায়।
এখানে থাকার জায়গার মধ্যে গঙ্গারামপুরের বাণগড় লজটিই একমাত্র মূল সাইটের খুব কাছে অবস্থিত। এছাড়া অন্য আরও হোটেল বা হোম-স্টে রয়েছে দিনাজপুরের ঐ অঞ্চলে। তবে হোটেল নির্বাচনের আগে ভাড়া ও সুযোগ-সুবিধে সম্পর্কে বিশদে জেনে নেওয়া দরকার।
বাণগড়ের বিশেষ দ্রষ্টব্য এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি। ৮ কিমি. পরিধি জুড়ে থাকা এই অঞ্চলে দেখা যাবে স্তম্ভ, বখতিয়ার খিলজির সমাধি, পাথরের কলাগাছ ইত্যাদি। এছাড়া এখানকার সাইটসিইং-এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ধলদীঘি, কালদীঘি, মহীপাল দীঘি, হাতিডোবা দীঘি, আলতা দীঘি ইত্যাদি সব ঐতিহাসিক জলাশয়, বল্লা কালী মন্দির, খনপুর, পাতিরাম ঠাকুর এস্টেট ইত্যাদি। বাণগড়ের ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখার সময় নিদর্শনগুলির গায়ে বেশি হাত না দেওয়াই ভালো। কোনোভাবে যাতে সেগুলির ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। মোটামুটিভাবে দু’দিনের মধ্যেই ভালোমতো ঘুরে আসা যায় বাণগড় এবং তার আশেপাশের জায়গাগুলি। তবে বর্তমানে এই নিদর্শনগুলি বাণগড়ের অস্থায়ী সংগ্রহশালায় সুরক্ষিত আছে এবং এই এলাকাটি সংরক্ষিত এলাকা হলেও সকল পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত।
সারাবছরই এখানে যাওয়া যায়। সময়ের সেভাবে কোন বিধিনিষেধ নেই। তবে এখানে ঘোরার সময় কোনো বিধিনিষেধ থাকলে তা মানা উচিত।
ট্রিপ টিপস
• কীভাবে যাবেন – ট্রেনে আসতে গেলে শিলিগুড়ি থেকে বালুরঘাট স্টেশনে আসতে হবে শিলিগুড়ি-বালুরঘাট ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ধরে। তাছাড়া বালুরঘাট কিংবা দক্ষিণ দিনাজপুর সদর শহর থেকে সোজা গাড়ি করেও সড়কপথে বাণগড়ে পৌঁছান যায়। বিমানের ক্ষেত্রে নিকটবর্তী বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে ২৫২ কিমি পথ বাসে বা গাড়ি ভাড়া করে আসতে হবে বাণগড়ে।
• কোথায় থাকবেন- বাণগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গার একেবারে কাছেই রয়েছে গঙ্গারামপুরের বাণগড় লজ। তাছাড়া দক্ষিণ দিনাজপুরের আরো অনেক হোটেল ও হোম-স্টে আছে।
• কী দেখবেন – বাণগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক পুরাকীর্তিগুলি, পাথরের কলাগাছ, পরিখা ইত্যাদি সবই বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যে পড়ে। আর সাইটসিইং-এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ দিনাজপুরের বিখ্যাত ধলদীঘি, কাল দীঘি, মহীপাল দীঘি, হাতিডোবা দীঘি, আলতা দীঘি ইত্যাদি সব ঐতিহাসিক জলাশয় এবং বল্লা কালী মন্দির, খনপুর, পাতিরাম ঠাকুর এস্টেট ইত্যাদি।
• কখন যাবেন – বছরের যে কোনো সময়েই বাণগড়ে আসা যায়। সময়ের বিশেষ কোনো বিধিনিষেধ নেই।
• সতর্কতা – প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখার সময় হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখা থেকে বিরত থাকতে হবে, সেগুলির যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। এলাকা নোংরা করা যাবে না কোনোভাবেই। হোটেল ভাড়ার ব্যাপারে আগেভাগে নিশ্চিত হয়ে তবেই বুক করা উচিত।
• বিশেষ পরামর্শ – গাড়ি করে এখানে এলেই ভালো হয়। তবে ঐতিহাসিক নিদর্শন ছাড়া এখানে আর বিশেষ কিছু আকর্ষণীয় না থাকায় অনুৎসাহী পর্যটক বিরক্ত বোধ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে ঐ দিনই দিনাজপুরের অন্যান্য সাইটগুলি দেখে এলে একঘেয়েমি কেটে যাবে।
বাণগড় টিকা