সববাংলায়

বশরী শাহ মসজিদ

কলকাতা যেহেতু অনেক প্রাচীন একটি শহর, সেই কারণে কলকাতার বুকে অবস্থিত বহু প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন চোখে পড়ে আজও। প্রচুর পুরাতন মন্দির যেমন রয়েছে এখানে তেমনই রয়েছে বহু প্রাচীন মসজিদও। তবে কলকাতার প্রাচীনতম মসজিদগুলির কথা বললে প্রথমেই বলতে হয় বশরী শাহ মসজিদের (Basri Shah Mosque) কথা। বশরী শাহ মসজিদ কলকাতার চিৎপুর-কাশীপুর এলাকায় পঞ্চানন মুখার্জি রোড এবং শেঠ পুকুর রোডের সংযোগস্থলে অবস্থিত। চিৎপুর এবং ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের সংযোগকারী নতুন সেতুটি থেকে এই আয়তাকার মসজিদটি চোখে পড়ে। এই মসজিদের নেপথ্যে যে ইতিহাস লুকিয়ে আছে তা আলোচনা করতে গেলে পলাশীর যুদ্ধ, সিরাজউদৌল্লা ইত্যাদি প্রসঙ্গের অবতারণা করতে হয়। এই মসজিদ প্রাক্-মুঘল যুগের স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত হয়েছে দেখে এর প্রাচীনত্ব সম্পর্কে ধারণা করা যায়। এই মসজিদে প্রার্থনার পাশাপাশি ইমাম সাহেব মাদ্রাসার মতো ছোট একটি বিদ্যালয়ও চালান।

কলকাতা শহরের জন্মের প্রাথমিক পর্যায়ে এই গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলটি মূলত তিনটি বিক্ষিপ্ত জনবহুল গ্রাম—সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা নিয়ে গঠিত ছিল। এগুলি ছিল সাম্রাজ্যিক জায়গীর বা মুঘল সম্রাটের নিজস্ব সম্পত্তির অংশ। এর জায়গিরদারির অধিকার ছিল বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের হাতে। ১৭০০-এর দশকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই গ্রামগুলির অধিকার অর্জন করে এবং ১৬৯৮ সালে এই রায়চৌধুরী পরিবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে কলকাতার ওপর তাদের অধিকার হস্তান্তর করতে বাধ্য হয় এবং ব্রিটিশদের হাতে শহরটি নতুন রূপ নিতে থাকে৷ সারা বাংলা থেকে গ্রামবাসীরা জীবিকার সন্ধানে এখানে পাড়ি দিতে থাকে। মুসলিম বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তাঁরা নিজেদের উপাসনার জন্য মসজিদ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিল। তবে গ্রাম থেকে এই শহরে চলে আসার প্রক্রিয়াটি সবচেয়ে বেশিমাত্রায় শুরু হয়েছিল উনিশ শতকে, সেই কারণে কলকাতার অধিকাংশ মসজিদ সেই সময়ে নির্মিত হয়েছিল।

আরও পড়ুন:  মহরম

এই বশরী শাহ মসজিদটিতে একটি প্রস্তরফলক ছিল যা হারিয়ে গেছে বা চুরি গেছে, সেখানে নাকি এই মসজিদ নির্মাণের বৃত্তান্ত উল্লেখ করা ছিল। অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজের সহযোগী পরিচালক ও শিল্প-ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক জেনিস লিওশকো তাঁর ‘ক্যালকাটা থ্রু ৩০০ ইয়ারস’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, যে, এই মসজিদটি জাফর আলী নামের একজনের দ্বারা ১২১৯ হিজরি অর্থাৎ ১৮০৪ সালে একটি পুরোনো মসজিদের ধ্বংসাবশেষের ওপরে নির্মিত হয়েছিল৷ অনেক ঐতিহাসিক অনুমান করেন যে, ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদৌল্লার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাকারী মীরজাফরই নাকি এই জাফর আলী। ব্রিটিশদের দ্বারা সাময়িকভাবে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ১৭৬০ সালে অল্প সময়ের জন্য তিনি কলকাতায় বাস করেছিলেন। তবে এই অনুমানের কোন ভিত্তি নেই কারণ জাফর আলী কর্তৃক মসজিদ  নির্মাণের ৩৯ বছর আগেই অর্থাৎ ১৭৬৫ সালে মীরজাফরের মৃত্যু হয়েছিল।

আরেকটি মত অনুসারে এই মসজিদ নির্মাণের নেপথ্যে ছিলেন রেজা আলী খান নামে একজন ব্যক্তি। তিনি পারস্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং সেই সৈয়দ মহম্মদ রেজা খান বাংলার নবাবদের মুর্শিদাবাদের দরবারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকার ডেপুটি গভর্নরও হয়েছিলেন। এই রেজা খান দীর্ঘদিন কলকাতায় বসবাস করেছিলেন। তবে মসজিদ নির্মাণের পিছনে রেজা খান থাকতে পারেন, ঐতিহাসিক প্রমাণের অভাবেই এমন দাবি করা যায় না।

মসজিদের নাম যে বশরী শাহ মসজিদ, তার নেপথ্যেও রয়েছে একজন বিশেষ ব্যক্তির কিংবদন্তি। পীযুষকান্তি রায়ের তত্ত্ব অনুসারে, ১৮ শতকের শেষের দিকে ১৭৬০ থেকে ১৭৯০ সালের মধ্যে কোনো এক সময়ে ইরাকের বসরা নামের এক বন্দর শহর থেকে একজন মুসলিম সাধক এসে বসবাস করেছিলেন কলকাতায়। কলকাতায় বসতি স্থাপনের পর স্থানীয় জনগণ তাঁকে ‘বশরিয়া শাহ’ বা ‘বশরী শাহ’ নামে সম্বোধন করতে থাকে। হিন্দু ও মুসলিম উভয়ের কাছেই তিনি সম্মানের পাত্র ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীরা হযরত হাসান বসরী শাহ রহমতুল্লাহ আলাই চিৎপুর দরগাহ-এর মাজার নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে এই মাজারের সম্পত্তির মধ্যেই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল বলে সেই সাধকের নামেই নাকি মসজিদের নামকরণ হয়েছিল বশরী শাহ মসজিদ।

আরও পড়ুন:  ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি ।। ঠনঠনে কালীবাড়ি

লিওশকোর মতে, কোন একটি মন্দির বা মসজিদের স্থাপত্যশৈলী দেখে তার সময় নির্ধারণ করা যেতে পারে। এই বশরী শাহ মসজিদটি হল কলকাতা শহরের একমাত্র মসজিদ যেটিতে প্রাক-মুঘল বাংলা স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন চোখে পড়ে। এই ধরনের স্থাপত্যশৈলী তৈরি হয়েছিল গৌড়ে, যখন তা বাংলার রাজধানী ছিল। এই স্থাপত্যশৈলীর বিশ্লেষণ করেই গবেষক লিওশকো এই বশরী শাহ মসজিদকে কলকাতার প্রাচীনতম মসজিদ বলে মনে করে থাকেন। মসজিদটি মুর্শিদাবাদী স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। এই মসজিদের কেন্দ্রে তিনটি গম্বুজ রয়েছে এবং পূর্ব ও পশ্চিমের গম্বুজের প্রতিটিতে চারটি করে মিনার লক্ষ করা যায়। সামনে আবার তিনটি তোরণ দেখা যায়। রাস্তা থেকে সরাসরি একটি সিঁড়ি পার হয়ে মসজিদের নীচের তলার উপাসনালয়ে পৌঁছনো যায়। সেখানকার দেওয়াল একসময় গোবরের ঘুঁটে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হত। ভিতরের দেওয়ালে সুন্দর সব ফুলের নকশা খোদাই করা আছে। ভিতরে যেমন তেমনই মসজিদের বাইরের দেয়ালেও সূক্ষ্ম স্টুকোর অলংকরণ করা আছে। ইটের জটিল ও সূক্ষ্ম জ্যামিতিক নকশা এবং লিনেন প্লাস্টারের স্তর মসজিদের নান্দনিকতাকে বৃদ্ধি করে।

১৮৫০-এর দশকে ব্রিটিশ ফোটোগ্রাফার ফ্রেডেরিক ফিবিগের তোলা এই মসজিদের একটি ছবিতে দেখা যায়, সেই সময় মসজিদের বাইরের দেয়ালের রঙ ছিল লাল এবং গম্বুজগুলি ছিল নীল৷ এছাড়াও মোটা মিনারের মধ্যে দুটি পাতলা মিনার স্থাপন করা হয়েছিল। সংস্কারের সময় আটটি প্রধান মিনার পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল। বর্তমানে মসজিদটিকে সবুজ রঙে রাঙানো হয়েছে।

বছরের বিভিন্ন সময়ে সাধারণত মুসলমানদের পরবের দিনগুলি বশরী শাহ মসজিদে উদযাপন করা হয়ে থাকে। মূলত ইদুল ফিতর, মহরম ইত্যাদি উৎসবের দিনগুলিতে মসজিদ চমৎকারভাবে আলোকমালায় সাজানো হয়, প্রচুর মানুষ একসঙ্গে প্রার্থনা জানান খোদাতালার কাছে। মসজিদের ইমাম এই মসজিদের ভিতরেই স্থানীয় কিছু বালক-বালিকেদের পড়ান, মসজিদটিকে মাদ্রাসার মতো ব্যবহার করেন।

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

চৈতন্যদেবের অসামান্য জীবনী দেখুন

চৈতন্য জীবনী

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন

জয় মঙ্গলবার ব্রত নিয়ে দেখুন এই ভিডিওতে



ছবিতে ক্লিক করুন