বিমলা

সতীপীঠ বিমলা

বিমলা মন্দির ভারতের ওড়িশা রাজ্যের পুরীতে অবস্থিত। এটি একান্ন সতীপীঠের অন্যতম এবং চার আদি শক্তিপীঠের একটি। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে দেবীর নাভি পড়েছিল। মতান্তরে বলা হয় এখানে সতীর পা পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী বিমলা এবং ভৈরব হলেন জগন্নাথ। এখানে বিষ্ণুর রূপ জগন্নাথকেই বিমলার ভৈরব মনে করা হয়।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন।  সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। সেই অনুযায়ী বিমলা মন্দিরে বলা হয় সতীর নাভি পড়েছিল। তবে অন্যমতে বলা হয় এখানে সতীর পদভাগ পড়েছিল।

“শিবপুরাণ” ও “কালিকাপুরাণ” গ্রন্থে তন্ত্র সাধনার যে চারটি প্রধান পীঠের উল্লেখ আছে তার মধ্যে পশ্চিমদিকের পীঠটি হল উড়িষ্যা অঞ্চলের বিমলাদেবী। “দেবীপুরাণ” মতে এই পীঠে সতীর পদভাগ পড়েছিল। অন্যমতে এখানে সতীর নাভি পড়েছিল। এই নিয়ে নানা মতভেদ আছে। এটি একটি সতীপীঠ ও মহাতীর্থ স্থান। তান্ত্রিকদের কাছে এই মন্দিরের গুরুত্ব জগন্নাথ মন্দিরের থেকেও অনেক বেশি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

এই মন্দিরে বিমলাদেবীর জন্য আলাদা করে ভোগ রান্না করা হয় না। জগন্নাথকে নিবেদন করা ভোগই বিমলা দেবীকে নিবেদন করা হয়। তারপরই সেটা মহাপ্রসাদের মর্যাদা পায়। ভোগে নারকেল বাটা, পনির, মাখন দিয়ে শুকনো ভাত নিবেদন করা হয়। জগন্নাথের উচ্ছিষ্ট বিমলাদেবীকে দেওয়ার পিছনে একটি পৌরাণিক কাহিনী আছে। শিব একসময় বৈকুণ্ঠে বিষ্ণুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেই সময় বিষ্ণু খাচ্ছিলেন। তার খাবারের কিছু অংশ মাটিতে পড়ে গেলে শিব তা কুড়িয়ে নিজে খান। সেই খাবার শিবের মুখের বাইরে লেগে ছিল। শিব কৈলাশে ফিরলে নারদ শিবের সাথে দেখা করতে আসেন, আর শিবের মুখে বিষ্ণুর উচ্ছিষ্ট লেগে আছে দেখে বিষ্ণুভক্ত নারদ তা খেয়ে নেন। এই বিষয়টি পার্বতীর চোখে পড়লে তিনি বিষ্ণুকে নালিশ করে বলেন ,তিনি বিষ্ণুর প্রসাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তখন বিষ্ণু পার্বতীকে শান্ত করে বলেছিলেন কলিযুগে তিনি বিমলারূপে নিত্য তার প্রসাদ পাবেন।

মন্দিরটির অবস্থান পুরীর জগন্নাথ মন্দির চত্বরের ঠিক দক্ষিণ -পশ্চিম কোণে। এই মন্দির প্রধান মন্দির জগন্নাথ দেবের মন্দিরের থেকেও পুরনো বলে মনে করা হয়। এর পাশে রয়েছে “রোহিণী কুন্ড” নামে পবিত্র একটি জলাধার। মন্দিরের চারটি অংশ রয়েছে। প্রথমটি বিমান অর্থাৎ গর্ভগৃহ সম্বলিত অংশ। দ্বিতীয়টি জগমোহন অর্থাৎ সভাকক্ষ। তৃতীয়টি নাট মণ্ডপ অর্থাৎ উৎসব কক্ষ। এবং চতুর্থটি হল ভোগ মণ্ডপ অর্থাৎ ভোগ নিবেদনের কক্ষ। মন্দিরটি ২০০৫ সালে সংস্কার করা হয়েছে এবং বর্তমানে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ভুবনেশ্বর শাখা এই বিমলাদেবী মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষন করে থাকে।

দেবী বিমলার মূর্তি কেন্দ্রীয় গর্ভগৃহে রাখা আছে। মূর্তির উচ্চতা ৪ ফুটের কিছু বেশি এবং দেবীমূর্তিটি চতুর্ভূজা।

প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকে। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। শাক্তদের বিশ্বাস অনুযায়ী বিমলাদেবী হলেন পুরীর শক্তিপীঠের প্রধান দেবী এবং জগন্নাথের তান্ত্রিকা পত্নী ও মন্দির চত্বরের রক্ষয়িত্রী। এখানে জগন্নাথকে বিমলার ভৈরব বলে মনে করা হয়। ভৈরব শিবের রূপ হলেও এখানে সেই নিয়মের ব্যতিক্রম। জগন্নাথ মন্দিরে বিষ্ণু ও শিবকে এক ও অভিন্ন মনে করা হয়। তান্ত্রিক মতে, জগন্নাথকে বিষ্ণুর রূপ মনে করা হয় না। এই মতে তিনি শিব-ভৈরব।

বিমলা মন্দিরের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা । আশ্বিন মাসে এখানে ষোলো দিন ধরে মায়ের পুজো করা হয়ে থাকে। দুর্গাপুজোতে মাকে আমিষ ভোগ দেওয়া হয়ে থাকে। দুর্গাপুজোয় খুব ভোরে গোপনে  পাঁঠাবলি দেওয়া হয় এবং স্থানীয় মন্দিরের পুকুর থেকে মাছ ধরে সেটা  মা বিমলাকে নিবেদন করা হয়। এইসব অনুষ্ঠান ভোরে জগন্নাথ মন্দিরের দরজা খোলার আগে সম্পন্ন করা হয়। এই পাঁঠাবলি ও আমিষ ভোগ দেওয়া নিয়ে বৈষ্ণব ভক্তরা একাধিক বার প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

5 comments

আপনার মতামত জানান