কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI ) এবং ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং এর দুনিয়ায় কম্পিউটার ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের অগ্রগতি বিগত বছরগুলিতে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে। ওপেন এআই নামক একটি সংস্থা দ্বারা তৈরি সেরকমই একটি ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল হল চ্যাটজিপিটি (ChatGPT)। এই ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলটি কথোপকথনমূলক পদ্ধতিতে মানুষের মতো উত্তর দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলগুলির মধ্যে অন্যতম একটি হয়ে উঠেছে।
চ্যাটজিপিটি কী ?
চ্যাটজিপিটি -এর সম্পূর্ণ নাম হল Chat Generative Pretrend Transformer. ওপেনএআই সংস্থার তৈরি এটি একটি অত্যন্ত উন্নত ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল, যা বিপুল পরিমাণ তথ্যভান্ডার (dataset) দ্বারা আগে থেকেই সমৃদ্ধ। এটি মূলত ট্রান্সফরমার আর্কিটেকচারের মাধ্যমে কাজ করে। আরও সহজ করে বলতে গেলে এটি এমন একধরণের চ্যাটবট (চ্যাটিং করার মাধ্যম) যেখানে যেকোন প্রশ্নের উত্তরে মানুষ যেভাবে উত্তর দেয় সেভাবেই বিস্তারিত উত্তর পাওয়া যায় এক নিমেষে। সার্চ ইঞ্জিনের সঙ্গে এর মূল পার্থক্য হল সার্চ ইঞ্জিন কোন প্রশ্নের উত্তরে সেই উত্তর সম্পর্কিত প্রচুর প্রাসঙ্গিক ওয়েবসাইট দেখায় কিন্তু চ্যাট জিপিটি প্রশ্নের উত্তরে সরাসরি কেবল উত্তরটিই দেখায়। ফলত এই চ্যাটবটটি ব্যবহার করে খুব সহজেই প্রবন্ধ, কবিতা, কন্টেন্ট রাইটিং, ভিডিও স্ক্রিপ্ট, আবেদন পত্র লেখা যায়।
চ্যাটজিপিটি কীভাবে কাজ করে ?
চ্যাটজিপিটি ট্রান্সফরমার আর্কিটেকচার ব্যবহারের মাধ্যমে কাজ করে যেটির উল্লেখ আশিষ ভাসওয়ানি সহ আরও বেশ কয়েকজন গবেষক তাঁদের গবেষণাপত্র “Attention Is All You Need” শিরোনামে বিশদে ব্যাখ্যা করেন। এককথায় বলতে গেলে ট্রান্সফরমার আর্কিটেকচার হল একটি গভীর নিউরাল নেটওয়ার্ক আর্কিটেকচার যা বিশেষভাবে ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং কাজের জন্য বানানো হয়েছে।
ট্রান্সফরমার আর্কিটেকচারের পিছনে মূল ধারণাটি হল এই মডেলটি ইনপুট হিসাবে ক্রমানুসারে কতকগুলি টোকেনকে গ্রহণ করে এবং আউটপুট হিসাবেও বেশ কিছু টোকেনের একটি ক্রম তৈরি করে। ট্রান্সফরমার আর্কিটেকচারে মডেলটি ইনপুট সিকোয়েন্সে প্রতিটি টোকেনের গুরুত্ব নির্ধারণ করতে মনোযোগের প্রক্রিয়া (attention mechanisms) ব্যবহার করে এবং এই প্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করেই আউটপুট ক্রম তৈরি করে। ট্রান্সফরমার আর্কিটেকচারে মনোযোগের প্রক্রিয়াগুলি মডেলটিকে টোকেনগুলির মধ্যে দীর্ঘ সময়ের নির্ভরতা শেখার লক্ষ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে, যা ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চ্যাটজিপিটি মডেলটি মানুষের মতো প্রতিক্রিয়া দেওয়ার কথা ভেবেই অত্যন্ত সূক্ষ্ম স্তরে তৈরি করা হয়েছে। এই সূক্ষ্ম স্তরে মডেলটি বানানোর সময় অল্প সংখ্যক তথ্য নিয়ে তৈরী একেকটি সেট বানানো হয় যার ওপর ভিত্তি করে মানুষের মত উত্তর দেওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় মডেলটিকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যদি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য মডেলটি সূক্ষ্মভাবে তৈরি করা হয়, তাহলে প্রশিক্ষণ ডেটাসেটে প্রশ্ন এবং তাদের সংশ্লিষ্ট উত্তর থাকবে।
চ্যাটজিপিটির ব্যবহার
চ্যাটজিপিটি মডেলটির বহুবিধ প্রয়োগ দেখা যায় যেগুলি নিয়ে নিচে আলোচনা করা হল –
১. চ্যাটবট: চ্যাটজিপিটি-এর জনপ্রিয়তার মূল কারণটিই হল চ্যাটবট আকারে এর কাজ করার ক্ষমতা। এই মডেলটি এতটাই সূক্ষ্ম স্তরে বানানো হয়েছে যে এটি প্রশ্নের উত্তর দিতে, সুপারিশ প্রদান করতে এবং এমনকি মজার মজার জোক তৈরি করতে পারে। এই চ্যাটবটগুলি গ্রাহক সহায়তা প্রদান, অনলাইন কেনাকাটায় সহায়তা এবং আরও অনেক কিছুর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
২. টেক্সট জেনারেশন: চ্যাটজিপিটি টেক্সট তৈরি করতেও ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন হেডলাইন, আর্টিকেল এবং কোন মূল পাঠ্যের সারাংশ তৈরী ইত্যাদি। নির্দিষ্ট ধরণের পাঠ্য যেমন সংবাদ নিবন্ধ, পণ্যের বিবরণ এবং আরও অনেক কিছু তৈরি করতে মডেলটি সূক্ষ্মভাবে তৈরি করা যেতে পারে।
৩. পাঠ্য অনুবাদ: চ্যাটজিপিটি এক ভাষা থেকে অন্য ভাষাতে পাঠ্য অনুবাদ করতেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪. প্রশ্নের উত্তর: চ্যাটজিপিটি-এর আরেকটি সাধারণ প্রয়োগ হল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা। কিভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় তা শিখতে প্রশ্ন ও উত্তরের ডেটাসেটের মাধ্যমে মডেলটি সূক্ষ্মভাবে তৈরি করা যেতে পারে।
৫. আবেগ বিশ্লেষণ: চ্যাটজিপিটি আবেগ বিশ্লেষণের জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে। কোন একটি নির্দিষ্ট পাঠ্যের আবেগ নির্ধারণ করা যেতে পারে এর মাধ্যমে। এটি বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনের জন্য উপযোগী হতে পারে, যেমন একটি ব্র্যান্ড, পণ্য বা ইভেন্টের প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া সেন্টিমেন্ট পর্যবেক্ষণ করা ইত্যাদি ।
চ্যাটজিপিটি ব্যবহারের সুবিধা
১. মানুষের মতো প্রতিক্রিয়া তৈরী : চ্যাটজিপিটি-এর অন্যতম প্রধান সুবিধা হল এটি মানুষের মতো প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে৷ মডেলটিকে লিখিত তথ্যের একটি বৃহৎ ভান্ডারের উপর প্রশিক্ষিত করা হয়, যা এটিকে মানুষের মত প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেয়।
২. কাস্টমাইজেশন: অ্যাপ্লিকেশনের নির্দিষ্ট চাহিদা মেটাতে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মডেলটিকে একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের জন্য সূক্ষ্মভাবে প্রশিক্ষিত করা যেতে পারে যেমন ফিনান্স বা স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রের জন্য।
৩. বড় শব্দভাণ্ডার: চ্যাটজিপিটি-এর একটি বিপুলাকার শব্দভাণ্ডার রয়েছে, যা এটিকে বিভিন্ন ধরণের ইনপুটগুলির জন্য প্রতিক্রিয়া দেওয়াতে সাহায্য করে। এই মডেলটি ভুল বানান চিহ্নিত করতে এবং আভিধানিক শব্দভান্ডারের বাইরের কোন শব্দকে চিহ্নিত করতে পারে সহজেই।
৪. গতি এবং দক্ষতা: চ্যাটজিপিটি দ্বারা ব্যবহৃত ট্রান্সফরমার আর্কিটেকচার দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে দেয়। এটি এমন অ্যাপ্লিকেশনগুলির জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ যেগুলির জন্য রিয়েল-টাইম প্রতিক্রিয়া তৈরির প্রয়োজন, যেমন চ্যাটবট৷
এককথায় বলতে গেলে বলা যায় চ্যাটজিপিটি একটি শক্তিশালী ভাষা মডেল যা ওপেন এআই কোম্পানি দ্বারা তৈরি করা হয়েছে কথোপকথনমূলক পদ্ধতিতে মানুষের মতো প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্য। এই মডেলটিতে চ্যাটবট, টেক্সট জেনারেশন, পাঠ্য অনুবাদ, প্রশ্নের উত্তর এবং আবেগ বিশ্লেষণ সহ বিভিন্ন ধরনের অ্যাপ্লিকেশন রয়েছে। চ্যাটজিপিটি-এর মূল সুবিধার মধ্যে রয়েছে এর মানুষের মতো প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ক্ষমতা, কাস্টমাইজেশন, বিপুল শব্দভাণ্ডার, এবং গতি এবং দক্ষতা। আশা করা যায় আগামী দিনে যেহেতু ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং ক্ষেত্রটি আরও উন্নত হতে চলেছে, সম্ভবত চ্যাটজিপিটি ডেভেলপার এবং গ্রাহকদের জন্য আরও বেশি মূল্যবান হাতিয়ার হয়ে উঠবে।
[এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য আপনিও চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে পারেন, সেক্ষেত্রে chat.openai.com ইউআরএল এ গিয়ে একাউন্ট বানাতে হবে। তারপর ChatGPT স্ক্রিনে নিউ চ্যাট এ ক্লিক করে চ্যাট শুরু করতে পারেন। আপনার প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর পাবেন সহজেই।]