১৯৭৬ সালের মন্ট্রিল অলিম্পিকে একেবারে নিখুঁত ১০.০ স্কোর করে সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন চোদ্দ বছর বয়সী রোমান কিশোরী জিমন্যাস্ট নাদিয়া কোমানেচি (Nadia Comăneci)। অলিম্পিকে মোট পাঁচটি স্বর্ণপদকের পাশাপাশি তিনটি রৌপ্য পদক এবং একটি ব্রোঞ্জ পদক পেয়ে কৈশোরেই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন নাদিয়া। পরবর্তীকালে রোমানিয়া জিমন্যাস্ট ফেডারেশন এবং রোমানিয়া অলিম্পিক কমিটির সম্মানীয় সভাপতি পদে আসীন হয়েছিলেন তিনি।
১৯৬১ সালের ১২ নভেম্বর রোমের বাকাউ প্রদেশের কার্পাথিয়ান পার্বত্য অঞ্চলের কাছাকাছি একটি ছোট্ট শহর ওনেস্টিতে নাদিয়া কোমানোচির জন্ম হয়। তাঁর জন্মস্থানটি আসলে রোমের ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত পশ্চিম মোডালভিয়ার অন্তর্গত। নাদিয়ার পুরো নাম নাদিয়া এলিনা কোমানোচি কোনার। তাঁর বাবার নাম জর্জ কোমানোচি এবং মায়ের নাম স্টেফানিয়া কোমানোচি। ১৯৭০ সাল নাগাদ তাঁর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটলে রোমানিয়ান অর্থোডক্স গির্জায় ভাই আড্রিয়ানের সঙ্গে বড়ো হতে থাকেন নাদিয়া। পরবর্তীকালে তাঁর মায়ের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে বাল্যকালে তাঁর অতি-সক্রিয়তার কারণে তাঁর মা নাদিয়াকে জিমন্যাস্টিকে ভর্তি করেছিলেন।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে বুখারেস্টের পলিটেনিকা ইউনিভার্সিটি থেকে স্পোর্টস এডুকেশন বিষয়ে স্নাতক স্তরের পড়া শেষ হয় নাদিয়া কোমানেচি -র। এই ডিগ্রি অর্জনের ফলে তিনি জিমন্যাস্টদের প্রশিক্ষণ দেবার যোগ্যতা লাভ করেন।
মূলত তাঁর কর্মজীবনের অধিকাংশই গড়ে উঠেছে তাঁর জিমন্যাস্টিকসকে কেন্দ্র করে। স্থানীয় দল ‘ফ্ল্যাকারা (দ্য ফ্লেম)’তে প্রশিক্ষক ডানকান এবং মান্টেনুর অধীনে কিণ্ডারগার্টেনে পড়াকালীনই জিমন্যাস্টিকে অংশগ্রহণ করেন নাদিয়া। স্কুলের মাঠে কার্টহুইল করার সময় তিনি বেলা ক্যারোল্লির নজরে আসেন এবং মাত্র ছয় বছর বয়সে তাঁকে পরীক্ষামূলক জিমন্যাস্টিক শেখাতে শুরু করেন বেলা। ওনেস্টিতে বেলার প্রতিষ্ঠিত প্রথম জিমন্যাস্টিকস স্কুলের প্রথম ছাত্রী ছিলেন নাদিয়া। ১৯৭০ সাল থেকে নিজের এলাকার দলের হয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে থাকেন নাদিয়া কোমানেচি এবং অভাবিতভাবে মাত্র নয় বছর বয়সে রোমানিয়া জাতীয় প্রতিযোগিতায় সর্বকনিষ্ঠ জিমন্যাস্টের মর্যাদা লাভ করেন তিনি। ১৯৭১ সালে রোমানিয়া আর যুগোস্লোভিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি প্রতিযোগিতায় নাদিয়া প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগী হিসেবে যোগদান করেন এবং নিজ দক্ষতায় দলের পক্ষ থেকে স্বর্ণপদক জয় করে ‘অল-অ্যারাউণ্ড’ জিমন্যাস্টের সম্মান পান। এর পরবর্তী কয়েক বছর ধরে রোমানিয়ার বিভিন্ন জাতীয় প্রতিযোগিতায় এবং হাঙ্গেরি, ইতালি, পোল্যাণ্ডের সঙ্গে নানা সময় আয়োজিত দ্বৈত প্রতিযোগিতায় নাদিয়া যোগ দেন কনিষ্ঠ জিমন্যাস্ট হিসেবে। ১৯৭৩ সালে এগারো বছর বয়সে ‘জুনিয়র ফ্রেণ্ডশিপ টুর্নামেন্ট’ নামে কিশোর-কিশোরীদের জন্য অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে একদিকে অল-অ্যারাউণ্ড স্বর্ণপদক এবং একইসঙ্গে ভল্ট ও আনইভেন বারস টাইটেলে ভূষিত হন নাদিয়া। ১৯৭৫ সালে তেরো বছর বয়সে নাদিয়া যোগ দেন তাঁর জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা ‘ইউরোপিয়ান ওমেন্স আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিক্স চ্যাম্পিয়নশিপ’-এ যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল নরওয়ের স্কিয়েনে। একমাত্র ফ্লোর এক্সারসাইজ ব্যতিরেকে সমস্ত ক্ষেত্রেই তিনি স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন এই প্রতিযোগিতায়। তারপর চলে আসে রোমানিয়ান ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ যেখানে ভল্ট, বিম আর বার প্রতিযোগিতায় নাদিয়া প্রথম স্থান অধিকার করেন। মন্ট্রিলের অলিম্পিক-পূর্ব নির্বাচনীতে নাদিয়ার সবথেকে বড়ো প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে সোভিয়েত জিমন্যাস্ট নেলি কিম।
১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে ম্যানহাটনের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত আমেরিকান কাপ প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী প্রতিযোগিতায় নাদিয়া কোমানোচি একেবারে নিখুঁত দশ পয়েন্ট স্কোর করে রেকর্ড গড়েন। এই বছরই মন্ট্রিলে আয়োজিত গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে আনইভেন বারের খেলায় চারটি দশ পয়েন্ট স্কোর করেন এবং বীমের ক্ষেত্রে তিনটি দশ পয়েন্ট স্কোর করেন নাদিয়া। মন্ট্রিলের অলিম্পিকে ১৮ জুলাই ইতিহাস তৈরি করে ফেলেন নাদিয়া কোমানোচি। আনইভেন বারে নৈমিত্তিক দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য প্রথম নিখুঁত দশ নম্বর প্রাপক অলিম্পিক জিমন্যাস্টের সম্মান লাভ করেন তিনি। এখানে একটা মজার ঘটনা আছে। যেহেতু অলিম্পিকের অফিসিয়াল সময়-পরিমাপক হিসেবে ওমেগা ঘড়ির নির্মাতারা ভেবেছিলেন কখনোই কোনো প্রতিযোগী নিখুঁত দশ পয়েন্ট পেতে পারেন না, তাই স্কোরবোর্ডে দশ পয়েন্ট দেখানোর প্রক্রিয়া চালু ছিল না। নাদিয়া প্রথম এই রেকর্ড গড়লে স্কোরবোর্ডে ১.০০ পয়েন্ট দেখায় যাকে বিচারকেরা দশ পয়েন্ট বলে স্বীকৃতি দেন। বাকি খেলাগুলিতে আরো ছয়টি নিখুঁত দশ পয়েন্ট অর্জন করেছিলেন নাদিয়া। এছাড়াও ফ্লোর এক্সারসাইজের জন্য তিনি ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিলেন। নাদিয়া কোমানোচিই ছিলেন প্রথম রোমানিয়ার জিমন্যাস্ট যিনি অলিম্পিকে অল-অ্যারাউণ্ড শিরোপা পেয়েছেন। তিনি যে সময় অলিম্পিকে যোগ দেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র চোদ্দো বছর, কিন্তু বর্তমানে সেই নিয়ম বদলে বয়সসীমা বৃদ্ধি করে সর্বনিম্ন ষোলো বছর করা হয়েছে। ১৯৭৬ সালে ‘বিবিসি ওভারসীজ স্পোর্টস পার্সোনালিটি অফ দ্য ইয়ার’ এবং অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের পক্ষ থেকে ‘ফিমেল অ্যাথলিট অফ দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হন নাদিয়া। রোমানিয়া সরকার তাঁর দক্ষতা ও শ্রেষ্ঠত্বের জন্য সিক্ল অ্যাণ্ড হ্যামার স্বর্ণপদকে ভূষিত করেন নাদিয়াকে এবং তাঁকে হিরো অফ সোশ্যালিস্ট লেবার নামে ডাকা হতে থাকে। স্ট্রাসবার্গে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে ১৯৭৮ সালে নাদিয়া ব্যালান্স বীমের ক্ষেত্রে স্বর্ণপদক লাভ করেন এবং ঠিক এর পরের বছরই ১৯৭৯ সালে ফোর্ট ওয়ার্থে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম ইউরোপিয়ান অল-অ্যারাউণ্ড জিমন্যাস্টের সম্মান পান তিনি। একইসঙ্গে ১৯৭৯ সালেই নাদিয়া প্রথম রোমানিয়ার দলকে স্বর্ণপদক এনে দিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর হাতের মেটাল রিস্ট বাক্ল-এ হাত কেটে গিয়ে সেখান থেকে ব্লাড পয়জনিং হওয়ায় বহুদিন চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে থাকতে হয় নাদিয়াকে, হাতে অনেকগুলি সার্জারি হয় তাঁর। সুস্থ হওয়ার পরে তাঁর পাখির চোখ হয়ে ওঠে ১৯৮০ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক যেখানে ব্যালান্স বীম আর ফ্লোর এক্সারসাইজে দুটি স্বর্ণপদক পান নাদিয়া। তাছাড়াও টিম অল-অ্যারাউণ্ড এবং ইণ্ডিভিজুয়াল অল- অ্যারাউণ্ডের শিরোপায় রৌপ্য পদক পান তিনি। ১৯৮৪ সালে লস অ্যাঞ্জেলসে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে যোগ দিয়েছিলেন নাদিয়া। এ প্রসঙ্গে আশ্চর্যজনক তথ্য হল, সোভিয়েতের আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৮০ সালের অলিম্পিক বয়কট করেছিল যার দরুন সকল কমিউনিস্ট দেশগুলিকেই কেবল অলিম্পিকে যোগ দিতে দেখা যায়। রাশিয়ার মস্কোয় আয়োজিত সেই অলিম্পিকের আবহাওয়া ছিল উত্তেজনাময়। এর জবাবে ১৯৮৪ সালের অলিম্পিকে বেশ কিছু কমিউনিস্ট দেশ অলিম্পিক বয়কট করে। কিন্তু দুই বারই রোমানিয়া সরকার বিনা দ্বন্দ্বে যোগ দিয়েছিল অলিম্পিকে।
ক্রমশ রোমানিয়া সরকার নাদিয়ার রোমানিয়ার বাইরে যাওয়া আটকাতে শুরু করে। প্রথমদিকে নাদিয়া মস্কো এবং কিউবার যেতে সফল হলেও পরে তার উপায়ও বন্ধ করে দেয় রোমানিয়া সরকার। ১৯৮৪ সালে বুখারেস্টে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর গ্রহণ করেন নাদিয়া কোমানোচি আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির চেয়্যারম্যানের উপস্থিতিতে। রোমানিয়ান অভ্যুত্থানের কিছুদিন আগে ১৯৮৯ সালের ২৭ নভেম্বর রাত্রে সেনাডের কাছাকাছি হাঙ্গেরি-রোমানিয়া সীমান্তে অন্যান্য রোমান অধিবাসীদের একটি দলের সঙ্গে নাদিয়া সারা রাত পায়ে হেঁটে হাঙ্গেরি, তারপর অস্ট্রিয়া হয়ে অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ১৯৯১ সাল থেকে ওকলাহোমায় স্বর্ণপদকজয়ী জিমন্যাস্ট বার্ট কোনারের সঙ্গে তাঁর জিমন্যাস্টিক স্কুলে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন নাদিয়া কোমানোচি। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন তিনি।
তবে শুধুই জিমন্যাস্টিক নয়, বহু ক্ষেত্রে নাদিয়া কোমানেচি বিশ্বখ্যাত মডেলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। রোমানিয়ান জিমন্যাস্টিক ফেডারেশন, রোমানিয়ান অলিম্পিক কমিটির সহ সভাপতি পদে আসীন হন নাদিয়া। ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিয়্যালিটি শো ‘দ্য সেলিব্রিটি অ্যাপ্রেন্টিস, সিজন সেভেন’-এ যোগ দেন নাদিয়া একটি জনকল্যাণমূলক কাজে অর্থ সংগ্রহের জন্য।
২০০৪ সালে তাঁর স্মৃতিকথা ‘লেটারস টু এ ইয়ং জিমন্যাস্ট’ প্রকাশ পায়। ইএসপিএন চ্যানেলের জন্য ‘ইটারনাল প্রিন্সেস’ নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন কেটি হোমস ২০১৫ সালে যার কাহিনীর কেন্দ্রে ছিলেন নাদিয়া কোমানোচি। ১৯৮৪ সালে তাঁর জীবন নিয়ে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ‘নাদিয়া’ নামে। ২০১২ সালে ‘দ্য লোরাক্স’ নামে একটি অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রে গ্র্যানি নোরমার চরিত্রে ডাবিংয়ের জন্য ইউনিভার্সাল পিকচারস নাদিয়াকে নির্বাচন করে।
বর্তমানে লরাস ওয়ার্ল্ড স্পোর্টস অ্যাকাডেমি এবং স্পেশাল অলিম্পিক্স ইন্টারন্যাশনালের সহ সভাপতি রূপে কাজ করছেন নাদিয়া কোমানোচি। একইসঙ্গে মাস্কুলার ডিস্ট্রফি অ্যাসোসিয়েশনের নানা কল্যাণমূলক কাজেও নিজেকে নিয়োজিত করেছেন তিনি।