চোয়খোর দুয়েচেন

চোয়খোর দুয়েচেন

তিব্বতী বৌদ্ধদের বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী তাদের চারটি প্রধান মরশুমি উৎসবের মধ্যে অন্যতম হল চোয়খোর দুয়েচেন (Choekhor Duchen)। লোসার (Loser), সাগা দাওয়া (Sada Dawa), চোয়খোর দুয়েচেন (Choekhor Duchen) এবং সবশেষে লাভাব দুয়েচেন (Lhabab Duchen) এই চারটি উৎসবের প্রতিটির সঙ্গেই গৌতম বুদ্ধের জীবন ও কর্মকাণ্ডের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত রয়েছে। তিব্বতীয় ভাষায় ‘চোয়খোর দুয়েচেন’ কথার অর্থ হল ‘ধর্মচক্রের প্রথম আবর্তন’। তিব্বতী বৌদ্ধরা মনে করেন এই বিশেষ দিনেই শাক্যমুনি বুদ্ধ প্রথম ভারতের সারনাথে চারটি আর্যসত্য সম্পর্কে শিষ্যদের অবগত করেন এবং ধর্মচক্র ঘোরান। সেই কারণে এই দিনটি অত্যন্ত পবিত্র এবং মাহাত্ম্যপূর্ণ।

প্রতি বছর তিব্বতী বর্ষপঞ্জীর ষষ্ঠ মাসের চতুর্থ দিনে পালিত হয় চোয়খোর দুয়েচেন। প্রচলিত ইংরেজি বর্ষপঞ্জীর সঙ্গে তিব্বতী বর্ষপঞ্জীর পার্থক্য থাকায় প্রতি বছরই এই দিনটি পরিবর্তিত হয় ইংরেজি বর্ষপঞ্জীতে।

‘চোয়খোর দুয়েচেন’ কথার মধ্যে তিব্বতী ভাষায় ‘চোয়’ কথার অর্থ ধর্ম, ‘খোর’ কথার অর্থ হল চক্র এবং ‘দুয়েচেন’ বলতে কোনও বিশেষ দিনকে বোঝানো হয়। একে আবার অনেকসময় ‘দ্রুকপা সে চি’ (drukpa tse shi) বলা হয় যার অর্থ হল তিব্বতী বর্ষপঞ্জীর ষষ্ঠ মাসের চতুর্থ দিন। ভগবান বুদ্ধ বোধিলাভের পর টানা সাত সপ্তাহ কোনও ধর্ম উপদেশ দেননি। তিনি তাঁর পাঁচ বন্ধুকে খুঁজতে থাকেন এই সময় যাদের সাথে তিনি মোক্ষলাভের জন্য বেরিয়ে ছিলেন।অবশেষে দেখা হয় তাদের সাথে এবং সারনাথে তিনি এদের উপদেশ দান করেন জীবনের আসল চারটি সত্য নিয়ে। এই উপদেশ-দানের পর্ব সারারাত ধরে চলে। ভোর হলে এই পাঁচজন তাঁর প্রথম শিষ্য হন যারা তিনটি রত্ন গ্রহণ করেন- বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ। জনশ্রুতি অনুসারে, গৌতম বুদ্ধ নিজেই নিশ্চিত ছিলেন না যে তিনি সিদ্ধিলাভের মাধ্যমে যা শিখেছেন তা অন্যদের কোনও কাজে আসবে কিনা। বলা হয় মহান দেবতা ইন্দ্র এবং ব্রহ্মা নাকি বিশ্বের সকল প্রাণীর হিতার্থে বুদ্ধকে তাঁর অর্জিত জ্ঞান থেকে উপদেশ দানের জন্য রাজি করান। সেই সময়েই পাঁচজন বন্ধুকে বুদ্ধ চারটি আর্যসত্য সম্পর্কে উপদেশ দেন। এই চারটি আর্যসত্য হল –

১. দুঃখ আছে।

২. দুঃখের কারণ আছে।

৩. দুঃখের নিবৃত্তি সম্ভব।

৪. দুঃখ নিরোধের পথও আছে।

গৌতম বুদ্ধ নির্বাণলাভের পরে মানুষের জীবনের দুঃখ-কষ্ট দূর করার জন্য কিছু পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর সমস্ত উপদেশের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এই চারটি আর্যসত্য। গৌতম বুদ্ধ বলেন যে জীবন দুঃখময়, জন্ম-ব্যাধি-জরা-শোক ও মৃত্যু নিয়েই মানুষের জীবন। সুখও যেমন ক্ষণস্থায়ী, তেমনি মানুষের জীবনে দুঃখও ক্ষণস্থায়ী। এই দুঃখের কারণ হিসেবে বারোটি উপাদানের কথা বলেছেন বুদ্ধ। বৌদ্ধ ধর্মদর্শনে একে ‘ভবচক্র’ বলা হয়। একইসঙ্গে তিনি এও বলেন যে এই বারোটি উপাদানের নিবৃত্তি ঘটলেই দুঃখ থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব। অন্যদিকে দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হিসেবে বুদ্ধ আরও আটটি পথের নির্দেশ দেন যাকে ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ’ বলা হয়। বৌদ্ধ ধর্মদর্শন অনুসারে মানুষের মন থেকে জাগতিক কামনা-বাসনা দূর করতে পারলেই তাঁর পক্ষে নির্বাণলাভ সম্ভব।

সারনাথে বুদ্ধের এই প্রথম ধর্মোপদেশ দান ও জীবনের প্রধান চারটি সত্য নিয়ে শিক্ষা দানকে সম্মান জানিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা যে উৎসব পালন করে তাকেই বলে চোয়খোর দুয়েচেন। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল বুদ্ধের এই প্রথম ধর্মোপদেশ দানকে ‘ধর্মচক্রের প্রথম আবর্তন’ বলে। এই দিনটি উপবাস, গরীবদের খাদ্য দান ও কোনওরকম দুষ্কর্ম থেকে বিরতির মাধ্যমে উদযাপিত হয়। এই বিশেষ দিনে বিভিন্ন তিব্বতী মঠ ও সঙ্ঘগুলিতে প্রার্থনাসভা আয়োজিত হয়। সাধারণ তিব্বতী মানুষেরা মঠগুলি পরিদর্শন করেন, সাধ্যমত দান-ধ্যান করেন, মাখন দিয়ে প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করেন এবং কোনও ভাল কাজ করেন এই দিনটিকে স্মরণে রেখে।

আপনার মতামত জানান