মধ্যযুগ থেকে চলে আসা বাঙালি পোশাকরীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয় ঔপনিবেশিক আমলে, উনিশ শতকের শেষভাগে – বিশেষ করে সিপাহী বিদ্রোহের পর পর। বর্তমানে বাঙালি যে পোশাক পরে সেই হিসেবে বাঙালি পোশাকে ঔপনিবেশিক প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাঙালি পোশাকে মুসলিম প্রভাব যেমন ধীরে ধীরে পড়েছিল ঠিক তেমনই বাঙালি পোশাকে ঔপনিবেশিক প্রভাব আস্তে আস্তে পড়েছিল।
শহরের বাঙালি পুরুষরা ধুতির ওপর সাদা শার্ট পরা শুরু করেন। পায়ে থাকত চামড়ার বুট। ধীরে ধীরে শুরু হল ফুলপ্যান্ট (প্যান্টালুন), আঁট শার্ট, কোট, হ্যাট পরার অভ্যাস। মলয় রায় লিখেছেন, ‘উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালির পোশাকে হিন্দু, মোগল ও বিলেতি রীতির সংমিশ্রণ ঘটেছিল।’ এই শতকের শেষ নাগাদ বাঙলার সাধারণ মুসলিম পুরুষদের পোশাক হয়েছিল — পাজামা, শেরওয়ানি, টুপি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, চোস্ত। আর সাধারণ হিন্দু পুরুষদের পোশাক হল — ধুতি, চায়না কোট, পিরান, চাদর, পাম সু বা হাঁটু পর্যন্ত মোজাসহ বুট জুতা; না হলে ধুতি, পাঞ্জাবি, উড়ুনি বা চাদর ও পাম সু।
বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ে পোশাকের ভেদ থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা ঘুচেও গিয়েছিল। শাড়ি তো বাঙালি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আপন করে নিয়েছিলেন।
ইংরেজরা বাংলায় আসার পর তাঁদের পোশাকের ছাপ পড়তে শুরু করে এ দেশের মানুষের পোশাকে। ধীরে ধীরে প্রথমে অভিজাত এবং পরে সাধারণ মানুষদের মাঝে ইংরেজদের অনুকরণে পোশাক পরার প্রচলন শুরু হয়। মোঘলদের পতনের পরেও অনেকদিন পর্যন্ত এদেশের হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মাবলম্বীরাই মোঘলদের পোশাক পরিধান করতেন। সমাচার দর্পণ পত্রিকায় ১৮৩৫ সালেও উল্লেখ করা হয় যে, বাবু, জমিদার, সেরেস্তাদার ও উকিল ইত্যাদি মহাশয়রা জামা, নিমা, কাবা, কোর্তা ইত্যাদি পোশাক পরতেন। রাজা রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুরদের ছবিতেও তাঁদেরকে এ ধরনের পোশাক পরতেই দেখা যায়। এসব পোশাকই ছিল অভিজাতদের পোশাক। রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দসহ সেকালের সব বিখ্যাত এবং অভিজাত ব্যক্তি তখনও মাথায় পাগড়ি পরতেন।
নবাবী আমলের পোশাক ইংরেজ আমলে এসে অক্ষুণ্ণ থাকলেও নতুন করে যুক্ত হয় চেইন আর ঘড়ি। প্যালানাথ বাবু তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় পূজা দেখতে যাওয়া মানুষের পোশাকের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা হলো: কোঁচানো ধুতি, ধোপদুরুস্ত কামিজ, শান্তিপুরী উড়ুনি বা ক্রেপ এবং নেটের চাদর। কামিজ, রামজামা বা লম্বা জামা থেকেই সম্ভবত পরবর্তীতে পাঞ্জাবীর উদ্ভব। এ সময়ে কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু কলেজসহ বিভিন্ন জায়গায় ইংরেজদের মতো পোশাক পরার প্রচলন দেখা যায়। এদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি পুরোদস্তুর ইংরেজদের মতো পোশাক পরতেন। বাঙালিদের মধ্যে শার্ট খুব জনপ্রিয় হলেও বিশ শতকের আগে বাঙালি শার্ট পরতো না। এমনকি বিশ শতকেরও অর্ধেক সময় জুড়ে বাঙালিদের মধ্যে খুব একটা শার্ট পরার চল ছিল না।
অভিজাতদের পোশাকে যতটা প্রবলভাবে ব্রিটিশদের ছোঁয়া লেগেছিল, সাধারণ মানুষদের মধ্যে কিন্তু ততটা প্রবলভাবে লাগেনি। সাধারণ মানুষেরা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তখনও ধুতি, পাঞ্জাবি, চাদর, লুঙ্গি ইত্যাদি পোশাক পরতেন। তবে সময়ের সাথে সাথে শার্ট, প্যান্ট ইত্যাদি পাশ্চাত্যের পোশাক ব্যাপকভাবে জায়গা করে নেয়।
তথ্যসূত্র
- বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ডক্টর এমএ রহিম, বাংলা একাডেমি।
- প্রাচীন বাংলা সামাজিক ইতিহাস: সেন যুগ, এসএম রফিকুল ইসলাম, বাংলা একাডেমি।
- সাজমহল: ঔপনিবেশিক বাংলায় মেয়েদের সাজগোজ, জয়িতা দাস, গাঙচিল।
- বাঙালির বেশবাস: বিবর্তনের রূপরেখা, মলয় রায়, মনফকিরা।
- মধ্যযুগের বাঙ্গালা, কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং।
- বাঙালির ইতিহাস: আদি পর্ব, নীহাররঞ্জন রায়।
- বঙ্গবাসীর অঙ্গবাস। পূর্ণেন্দু পত্রী। প্রতিক্ষণ পাবলিকেশনস লিমিটেড। বইমেলা জানুয়ারি ১৯৯৪।
