ধান্যকুড়িয়া রাজবাড়ি ভ্রমণ

ধান্যকুড়িয়া রাজবাড়ি দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে শিয়ালদা হাসনাবাদ লাইনের ‘কাঁকড়া মির্জানগর’ স্টেশনে। অনেক ছোট ষ্টেশনের মতো এরও কোনও বিশেষত্ব নেই। দু’ধারে দিগন্ত পর্যন্ত ধানক্ষেত, প্ল্যাটফর্মে জনাকয়েক লোক, বাতাসে গ্রাম্য সুগন্ধ। এই লোকালয়টির নাম মির্জানগর। দুটো ব্যাঙ্ক আছে, সেগুলো মির্জানগর শাখা নামেই পরিচিত। এখানে রাজবাড়ি কিন্তু একটা নেই, আছে তিনটি, গায়েনদের, বল্লভদের ও সাউদের। প্রধানত লোকে গায়েনদের রাজবাড়িটি ই দেখতে আসে দূর দূরান্ত থেকে।

পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় অবস্থিত ধান্যকুড়িয়া রাজবাড়িকে  লোকে ধান্যকুড়িয়ার ক্যাসল বলে চেনে। এটি আসলে বিদেশী দূর্গের আদলে তৈরী একটা বাগানবাড়ি। বিদেশী দূর্গের আদলে তৈরী কলকাতায় একটিই বাড়ি ছিল। সেটি হল পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে অবস্থিত ট্যাগোর ক্যাসল। বর্তমানে তার খোল নলচে পাল্টে দেওয়ার তাকে চেনা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধান্যকুড়িয়ার বাড়িটি ধুঁকছে, কিন্তু এখনও সে তার আভিজাত্য বজায় রেখে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রোমোটারের হাতুড়ির ঘা এখনো তার শরীরে পড়েনি। ওই ক্যাসেল ছাড়া ধান্যকুড়িয়াতে আরও অনেক সুদৃশ্য জমিদার বাড়ি রয়েছে, যেগুলো দেখতে অনেকেই আসেন। বাড়িগুলোর অবস্থা বেশ ভালোই। কয়েকটাতে লোক বসবাস করে, অন্যগুলোতে পুজো পার্বণে বাড়ির মালিকরা বেড়াতে আসেন ।

ধান্যকুড়িয়া একসময় সুন্দরবন অঞ্চলের অন্তর্গত ছিল। ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে জগন্নাথ দাস তার পরিবারের সাথে এখানে বসবাস করতে আসেন।এরপর একে একে এখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এখানে এসে বসবাস শুরু করেন। এঁদের উপাধি ছিল মুখ্যত: মন্ডল, সাউ, গায়েন এবং বল্লভ। এঁদের আসার পর ধীরে ধীরে ধান্যকুড়িয়া লোকজনের বাস করার মত উপযুক্ত বসতিতে রূপান্তরিত হয় । বর্তমানে ধান্যকুড়িয়া উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার অন্তর্গত একটি জনবসতি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

শিয়ালদা থেকে ট্রেনে উঠে হাসনাবাদ লাইনের ‘কাঁকড়া মির্জানগর’ স্টেশনে নেমে টোটো বা অটোতে চড়ে চলে আসতে পারেন গায়েনদের রাজবাড়িতে। এই জায়গাটি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় অবস্থিত। প্রধানত লোকে এই গায়েনদের রাজবাড়িটি ই দেখতে আসে দূর দূরান্ত থেকে। মির্জানগরে বেশ কিছু প্রাইভেট হোটেল আছে থাকার জন্য।

গায়েনদের বাগানবাড়ির গেট

গায়েনদের বাগানবাড়ির গেটটি দেখবার মতো। গেটের দুপাশে মধ্যযুগের ইউরোপীয় স্থাপত্যকলার অনুপ্রেরণায় তৈরী দুটো সুবিশাল টাওয়ার রয়েছে। গেটের মাথায় সিংহের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত দুটি ইউরোপিয়ান মূর্তি চোখে পড়ে।

ভিতরে ঢুকে সোজা হাঁটলেই একটা পুকুর চোখে পড়ে। এই পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে জল সমেত বাড়িটার একটা সুন্দর ফোটো তোলা যায়। বাড়িটি দক্ষিণমুখী। এর পিছনেও একটা পুকুর রয়েছে। বাগানবাড়ির পুবদিকে একটা দোতলা বাড়ি রয়েছে । এটি আগে একটি অনাথ আশ্রম ছিল যেটা এখন বন্ধ রয়েছে । বাড়িটার ডিজাইন ইউরোপীয় মধ্যযুগের দুর্গ থেকে অনুপ্রাণিত। খাঁজকাটা দেওয়াল ঘেরা ছাদ যার পুবদিকে একটা টারেট বা ক্ষুদ্রাকৃতি গম্বুজ এখনও বর্তমান। ছাদের পশ্চিমদিকে মনে হয় কোনওকালে ঘড়ি ছিল। দেওয়ালে দুটো ফাঁকা গোলাকার আকৃতি চোখে পড়ে। একটি দক্ষিনমুখী , অন্যটি পশ্চিম দিকে রয়েছে। দুটি আকৃতির নিচে একটি করে গায়েন বংশের পরিচায়ক চিহ্ন দেওয়ালে খোদাই করা আছে। সে সময়ের জমিদারেরা ব্রিটিশদের অনুকরণে নিজেদের পরিচায়ক চিহ্ন তৈরী করতেন।

গায়েন বংশের পরিচায়ক চিহ্ন

বাড়িটির পুব দিকের দিকের দেওয়ালেও এইরকম চিহ্ন রয়েছে। পুব দিকের দেওয়ালের চিহ্নটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় কারণ তার উপরে একটা মুকুট দেখতে পাওয়া যায়। দোতলায় একটা টানা বারান্দা দেখা যায়। তার বাইরের দিকে সুন্দর পাঁচটি খিলান রয়েছে। খিলানের মাঝখানের লোহার গ্রিলগুলো পরে বসানো হয়েছে। খিলানের শৈলী ইতালিয়ান স্থাপত্য থেকে প্রভাবিত। খিলানগুলির নিচের দিকে একটি করে মধ্যযুগের ইউরোপিয়ান ভাঁড় এর মুখ বসানো রয়েছে। তিনটি মুখ পরিষ্কার দেখা যায়, চতুর্থটি গাছ পালায় ঢাকা পড়ে রয়েছে । একতলায় সামনের দেওয়ালের পশ্চিম দিকে একটি স্থাপত্য রয়েছে। এতে পাতার শিরমাল্য এর মাঝে ঈগলের মূর্তি আছে যা কিনা রোমান স্থাপত্য থেকে অনুপ্রাণিত। বাড়িটা প্রদক্ষিন করলে দেখতে পাবেন যে পিছনে আরো বেশি গাছ পালা গজিয়ে জঙ্গল হয়ে রয়েছে। বাড়ির পিছনে গেলে দেখা যায় যে দুপাশে দুটো কোনাকৃতি গম্বুজ রয়েছে যেটা সামনে থেকে দেখা যায়না। এগুলো সামনের টারেটের থেকে উচ্চতায় ছোট। বাড়ির পশ্চিম দিকে গেলে আরও দুটো আকর্ষণীয় জিনিস চোখে পড়ে। এক, সেদিকে পোর্টিকো সহ আরো একটা প্রবেশপথ আছে।

পোর্টিকো

দুই, সেদিকে আরো একটা টারেট রয়েছে যদিও সেটা উচ্চতায় অনেক ছোট । এ বাড়িতে মনে হয় বহু যুগ ধরে কেউ ঢোকেনা।সামনের সিঁড়ির রেলিঙের একটা মূর্তি ভেঙে পড়ে আছে।

গায়েনদের বাগানবাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তার পাশে ধান্যকুড়িয়া স্কুল ও মন্ডলবাড়ি পড়বে। স্কুলটা দেখতে বেশ সুন্দর। মণ্ডলরা পুরোনো বাসিন্দা, তবে বাড়িটা তুলনামূলক ভাবে অতটা সুন্দর নয়। এগুলো কোনোটাই রাজবাড়ি নয়, জমিদার বাড়ি বলা চলে। মিনিটখানেক হেটে এলেই গায়েনদের রাজবাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হবেন।

ধান্যকুড়িয়ার জমিদার বাড়িদের মধ্য এটি সবচাইতে সুবৃহত্‍ আকারের বাড়ি। বড় আয়নিক থাম (গ্রিক স্থাপত্য রীতি), লম্বা করিডর , ইউরোপিয়ান স্থাপত্য শৈলীর গম্বুজ, সব মিলিয়ে বাড়িটা দেখলে বেশ সম্ভ্রম জাগে।

গায়েনদের রাজবাড়ী

এই বাড়িতে এখন মনজিত্‍ গায়েন তাঁর পরিবারের সাথে বসবাস করেন। মনজিত্‍ পেশায় শিক্ষক ।বাড়ির পাশেই শ্যামসুন্দর জিউর মন্দির। বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে একটি সুদূশ্য তিনতলা মিনার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এর নাম নজর মিনার। এটির স্থাপত্য শৈলী মিশ্র প্রকৃতির। প্রথম দুটি তলা দিব্যি কোরিন্থিয়ান থাম (গ্রিক স্থাপত্য রীতি) সমেত ইউরোপিয়ান স্থাপত্য দৃষ্টান্ত, কিন্তু তিন তলাটা ইসলামীয় ধাঁচে নির্মিত । এমনকি গম্বুজটাও পুরোপুরি ইসলামীয় স্থাপত্যের উদাহরণ। গায়েন বাড়ি এবং বাগানবাড়ি দুয়ের বয়স প্রায় দুশোর কাছাকাছি।
যদিও এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গোপীনাথ গায়েন, এই সুবিশাল প্রাসাদ আর দুর্গের মতো বাগানবাড়ি বানিয়েছিলেন তাঁর সুযোগ্য সন্তান মহেন্দ্রনাথ গায়েন। একসময় গায়েনদের পাটের ব্যবসা বেশ রমরমিয়ে চলত। ইংরেজদের সাথে ওঠা বসা ছিল।তার জন্যই মনে হয় বাড়ির স্থাপত্যে ইউরোপিয়ান স্টাইলের প্রভাব রয়েছে । এই গায়েনরাই ধান্যকুড়িয়াতে প্ৰথম রাইস মিল শুরু করেন । এবাড়িতে দুর্গাপুজো মহেন্দ্রনাথ গায়েন শুরু করেন, যা এখনো প্রতি বছর সব প্রথা মেনে হয়ে আসছে।

গায়েনদের রাজবাড়ীর ঠাকুরদালান

এই বাড়িতে সাহেব, বিবি , গোলাম সিনেমার শুটিং হয়েছিল।এছাড়া ঋতুপর্ণ তার ব্যোমকেশ সিনেমার এর শুটিংও করেছিলেন এই রাজবাড়িতে। গায়েন বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা মিনিট দুয়েক হাঁটলেই ডান দিকে আরেকটা বাড়ি চোখে পড়ে।

সাদা রংয়ের এই বাড়ির বাইরেটা গায়েন বাড়ির মত ঝাঁ চকচকে না হলেও এর জানালার উপর স্টাকোর কাজ বেশ আকর্ষণীয় । জানালাগুলোও বেশ বাহারি । সবকটাতেই সাবেক আমলের খড়খড়ি আছে। এ বাড়িও প্রায় দুশো বছরের পুরোনো। এটি হলো সাউ বাড়ি।

সাউদের বসতবাড়ির ঠাকুরদালান

এই বংশের পতিত পাবন সাউ এ বাড়ি তৈরি করেন। এখন এ বাড়িতে সাউ পরিবারের কেউ থাকেন না । বর্তমান প্রজন্মের অশোক সাউ কলকাতায় থাকেন।

সাউদের বসতবাড়ি

সাউ বাড়ি দেখাশোনা করেন একজন কেয়ারটেকার। অনুরোধ করলে চাবি খুলে ঠাকুর দালানে ঢুকতে দেন। গায়েন বাড়ির ঠাকুরদালান এর থেকে অনেক বড়, কিন্তু এটাতে দারুণ স্টাকোর কাজ রয়েছে দেখছি। ঠাকুর দালানের থামগুলো গায়েন বাড়ির ঠাকুরদালান এর তুলনায় অনেক বেশি কারুকার্যপূর্ণ ও দৃষ্টিনন্দন।

সাউ বাড়ি পিছনের দিকে একটা পুকুর আছে। সাউ বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েক পা হেটে তেমাথায় একটা খর্বাকৃতি নেতাজির মূর্তি রয়েছে। সেখান থেকে ডান দিকে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই বাঁ দিকে পড়বে বল্লভ বাড়ি।

বল্লভদের বসতবাড়ি

বাড়িটা সাদা আর সবুজ রং করা। প্রস্থের চেয়ে দৈর্ঘ্যে সুবৃহত্‍। কাস্ট আয়রনের গেট। দোতলা বাড়ির মাথায় কয়েকটা পুতুল, তার মধ্যে একটাকে দেখে রোমান জেনারেল গোছের মনে হয়। দোতলায় টানা বারান্দা। বড় ছোট মিলিয়ে অনেকগুলো কোরিন্থিয়ান পিলার চোখে পড়ে। বাড়ির সামনে গায়েন বাড়ির মত বাগান রয়েছে। বাগানের শেষ প্রান্তে একটা ভগ্ন দুর্গাদালান রয়েছে। এখানেও একটা মিনার রয়েছে , তবে সেটা বাড়ির বাইরে রাস্তার উপর নির্মিত।
এই বাড়ির বয়সও গায়েন বাড়ির সমসাময়িক। এ বংশের শ্যাম বল্লভ এ বাড়ি তৈরী করেছিলেন। এনাদের বাড়িতেও লক্ষীর সমাগম হয়েছে পাটের ব্যবসা থেকে। কলকাতায় আর। জি। কর হাসপাতালের কাছে আদি গঙ্গার পাড়ে বল্লভদের প্রাসাদোপম বাড়ি রয়েছে।সাম্প্রতিক কালে রং হয়েছে এই বাড়িটির।

বল্লভ বাড়ি থেকে আরও মিনিট দুয়েক হাঁটলেই রাস্তার ডানদিকে একটা সাদা রংয়ের সুবিশাল দোতলা নবরত্ন রাসমঞ্চ চোখে পড়বে।

নবরত্ন রাসমঞ্চ

রাসমঞ্চের চারিদিকে পাঁচ খিলানের প্রবেশ পথ রয়েছে। শুরুর দিকে এ অঞ্চলে বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব ছিল। কালের হাতছানি উপেক্ষা করে এটি এখনো দৃঢ় ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাসমঞ্চ থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে রয়েছে সাউদের বাগানবাড়ি। এই বাড়ির স্থাপত্যের ধাঁচটাও অনেকটাই সাউদের বসতবাড়ির মতো। তবে এটি আকারে অনেক ছোট।

ধান্যকুড়িয়ার জমিদার বাড়িগুলো দেখে নিতে ঘন্টা দুয়েকের বেশি সময় লাগে না। দুর্গাপুজোর সময় সব বাড়িতেই অবাধ প্রবেশ থাকে। কাছাকাছির মধ্যে বেড়াচাঁপায় একটা পুরাতাত্বিক সাইট আছে যার নাম খনা বরাহের ঢিপি। তাছাড়া ওখানে চন্দ্রকেতুগড় মিউজিয়াম খুলেছে , সেটাও দেখবার মতন।

ট্রিপ টিপস


  • কীভাবে যাবেনঃ শিয়ালদা হাসনাবাদ লাইনের ‘কাঁকড়া মির্জানগর’ স্টেশনে নেমে টোটো বা অটোতে করে ধান্যকুড়িয়া রাজবাড়ি চলে আসতে পারবেন।
  • কোথায় থাকবেনঃ মির্জানগরে বেশ কিছু প্রাইভেট হোটেল আছে।
  • কী দেখবেনঃ গায়েনদের, বল্লভদের ও সাউদের রাজবাড়ি, নবরত্ন রাসমঞ্চ, খনা বরাহের ঢিপি, চন্দ্রকেতুগড় মিউজিয়াম।
  • কখন যাবেনঃ বছরের যে কোনো সময়।
  • সতর্কতা: 
    • রাতে এখানে থাকবার কথা ভাবার দরকার নেই।

আপনার মতামত জানান