দিলীপ কুমার

দিলীপ কুমার

দিলীপ কুমার (Dilip Kumar) একজন বিখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র অভিনেতা তথা চলচ্চিত্র প্রযোজক। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে পেশোয়ারের উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবক থেকে আপামর ভারতীয় দর্শকের চোখে জনপ্রিয় ‘ট্র্যাজেডি কিং’ হয়ে উঠেছিলেন দিলীপ কুমার। বম্বে টকিজ’-এর ‘জোয়ার-ভাটা’ ছবিতে প্রথম সুযোগ পেয়েই দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছিলেন তিনি। সমগ্র অভিনয়জীবনে মাত্র তেষট্টিটি চলচ্চিত্রে কাজ করলেও অসাধারণ অভিনয়-প্রতিভা, কণ্ঠের জাদু আর ব্যক্তিত্বের জনপ্রিয়তাই তাঁকে অমর করেছে। শুধুমাত্র চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে সেতার বাজানো শিখেছিলেন তিনি যা প্রমাণ করে অভিনয়ের প্রতি গভীর এক টান ছিল দিলীপ কুমারের। একইসঙ্গে হিন্দি, উর্দূ, ইংরেজি, পাঞ্জাবি আর পশতু ভাষা জানা এই অসামান্য অভিনেতা দিলীপ কুমারকে ১৯৯১ সালে পদ্মভূষণ এবং ২০১৬ সালে পদ্মবিভূষণ পুরস্কারে সম্মানিত করে ভারত সরকার। এমনকি পাকিস্তানের সর্বোচ্চ খেতাব নিশা-ই-ইমতিয়াজও পেয়েছেন তিনি।

১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের পেশোয়ারে কিস্‌সা কাহানি বাজার এলাকায় এক আওয়ান পরিবারে দিলীপ কুমারের জন্ম হয়। বর্তমানে তাঁর জন্মস্থান পাকিস্তানের পাখতুনখোয়া প্রদেশে অবস্থিত। তাঁর আসল নাম মহম্মদ ইউসুফ খান। তাঁর বাবা লালা গুলাম সারোয়ার খান ছিলেন একজন ফলবিক্রেতা এবং তাঁর মা আয়েশা বেগম ছিলেন গৃহবধূ। পেশোয়ারে তাঁর বাবার বেশ বড়োসড়ো ফলের বাগান ছিল। শৈশবে দিদা, কাকা ওমরের বাৎসল্যে খুবই স্নেহে-যত্নে বড়ো হয়েছিলেন দিলীপ কুমার। শীতকালের ভোরে পেশোয়ার শহরের আজান তাঁর বড় প্রিয় ছিল। পরে ১৯৩০ সাল নাগাদ তাঁর বাবা সপরিবারে বম্বেতে চলে আসেন।

বম্বের কাছেই নাসিকের দেওলালিতে বার্ণেস স্কুলে দিলীপ কুমারের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়। তাঁর স্কুলজীবনের সহপাঠী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রাজ কাপুর, পরে উভয়েই একেকজন বিখ্যাত অভিনেতা হবেন।


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

কৈশোরে পুনেতে ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য একটি ক্যান্টিনে কর্মজীবন শুরু হয় দিলীপ কুমারের। এরপর বম্বেতে তিনি বাবার ফলের ব্যবসায় যোগ দেন। এই কাজ করতে করতেই একবার ১৯৪৩ সালে ‘বম্বে টকিজ’-এ চাকরির সন্ধানে যান ইউসুফ খান ওরফে দিলীপ কুমার আর সেখানেই তাঁর সঙ্গে অভাবিতভাবে সাক্ষাৎ ঘটে যায় সেকালের ‘ফিল্ম-ডিভা’ দেবিকা রাণীর। তিনি ইউসুফকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী ইউসুফ রাজি হয়ে যান। দেবিকা রাণীর পরামর্শেই মহম্মদ ইউনুস খান থেকে তিনি হয়ে উঠলেন ভারতীয় সিনেমার নবদিগন্তের সূচনাকারী দিলীপ কুমার। জানা যায় যে, দেবিকা রাণীর নির্দেশে প্রখ্যাত হিন্দি কবি নরেন্দ্র শর্মা তিনটি নাম প্রস্তাব করেছিলেন ইউসুফ খানকে জাহাঙ্গীর, বাসুদেব ও দিলীপ কুমার যার মধ্যে ইউসুফ খান বেছে নেন তৃতীয় নামটি। তবে রক্ষণশীল বাবার কাছে নিজের পেশা বা এই চলচ্চিত্রের বিষয় গোপন করার জন্যেও নাম পরিবর্তন করতে তিনি বেশ উৎসাহী ছিলেন।

১৯৪৪ সালে ‘বম্বে টকিজ’-এর চলচ্চিত্র ‘জোয়ার-ভাটা’-ই দিলীপ কুমারের অভিনীত প্রথম ছবি, যদিও দর্শক আনুকূল্যের অভাবে ছবিটি চলেনি এবং আশানুরূপ জনপ্রিয়তা পাননি দিলীপ কুমার। তারপরে ১৯৪৫ সালে ‘প্রতিমা’ এবং ১৯৪৭ সালে ‘নৌকাডুবি’ নামে আরো দুটি ছবিতে দিলীপ কুমার অভিনয় করলেও, এই দুটি ছবিও দর্শকমহলে জনপ্রিয়তা পায়নি। ১৯৪৭ সালে তাঁর অভিনীত ‘জুগনু’ ছবিটি আশাতীতভাবে বক্স অফিসে সাফল্য এনে দেয় এবং এর পরপরেই ১৯৪৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘শহীদ’ রাতারাতি ভারতীয় চলচ্চিত্র-জগতে দিলীপ কুমারকে একজন তারকায় পরিণত করে।

কিন্তু তাঁর জীবন সরলরেখায় চলেনি কোনোদিন। এরপরেই তাঁর অভিনীত ‘ঘর কি ইজ্জত’ ছবিটি ১৯৪৮ সালে মুক্তি পেলে তা বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। সেই সময় কামিনী-কৌশলের প্রেমে পড়েন দিলীপ কুমার এবং বড় পর্দায় তাঁদের জুটির রোমান্স একের পর এক সাফল্য এনে দিয়েছে। ১৯৪৮-এ ‘শহীদ’, ‘নদীয়া কে পার’, ১৯৪৯-এ ‘শবনম্‌’ এবং এর পরের বছর ১৯৫০-এ মুক্তি পায় ‘আরজু’ – পরপর এই ছবিগুলিতে দিলীপ কুমার আর কামিনী-কৌশলের জুটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৪৯ সালে তিনি সেকালের উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিচালক ও অভিনেতা রাজ কাপুরের সঙ্গে রোমান্টিক মেলোড্রামা ‘আন্দাজ’-এ অভিনয় করতে সম্মত হন। দিলীপ কুমারের বাল্যবন্ধু রাজ কাপুর তখনো পরিচালক হিসেবে একটি বক্স অফিসে অসফল ছবির নির্মাতা এবং তাঁর অভিনীত ১১টি ছবিও বক্স অফিসে ব্যর্থ বলে প্রমাণিত। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে রাজ কাপুর আর দিলীপ কুমারের জুটিতে ‘আন্দাজ’ আশাতীত সাফল্য অর্জন করে। সমগ্র ১৯৫০-এর দশক জুড়ে বলিউডের জগতে রাজ কাপুর, দেব আনন্দের পাশাপাশি দিলীপ কুমার ছিলেন অন্যতম তারকা। বিয়োগান্তক রোমান্টিক চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠলেও তাঁর অভিনীত কিছু সেরা ছবি সেকালে বক্স অফিসের নিরিখে চরম ব্যর্থ ছিল। সেগুলির মধ্যে উল্লেখ্য – ‘অমর’, ‘দেবদাস’, ‘দিল দিয়া দিল লিয়া’, ‘আদমি’ ইত্যাদি। তবে ‘জোগান’, ‘বাবুল’, ‘দিদার’, ‘তারানা’, ‘দাগ’, ‘শিকাস্ত’ ইত্যাদি ছবিতে রোমান্টিক ট্র্যাজিক নায়ক হিসেবে অভিনয়ের জন্য দিলীপ কুমারকে বলিউডে ‘ট্র্যাজেডি কিং’ বলা হয়। এই ছবিগুলির মধ্যে বাবুল, দিদার, জোগান-এ তাঁর বিপরীতে নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন সেকালের অসামান্যা রূপসী অভিনেত্রী নার্গিস। জানা যায়, নার্গিসের সঙ্গে জুটিতে অভিনীত ‘আনোখা প্যায়ার’ এবং ‘হালচাল’ ছবিতে অভিনয় করলেও ছবি দুটি তেমন চলেনি। পরবর্তীকালে মধুবালার সঙ্গে জুটি বেঁধে কাজ করেন। ১৯৫১ সালে দিলীপ কুমার আর মধুবালার অভিনীত ‘তারানা’ ছবিটি বক্স অফিসে জনপ্রিয় হয়। মধুবালার সঙ্গে ১৯৬০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতের ঐতিহ্যশালী ধ্রুপদি ছবি ‘মুঘল-এ-আজম্‌’-এ দিলীপ কুমার অভিনয় করেছিলেন, কিন্তু ততদিনে উভয়ের পরিণয় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এই ছবিতে আকবরের পুত্র শাজাহানের চরিত্রে অভিনয় করেন দিলীপ কুমার।

নায়ক হিসেবে তাঁর অভিনয় জীবনের সবথেকে শীর্ষ সময় ছিল ১৯৫২ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত। এ সময় তাঁর অভিনীত প্রতিটি ছবিই একাধারে ‘হিট’ হয়েছে। ‘দাগ’(১৯৫২), ‘আন’(১৯৫৩), ‘ফুটপাথ’(১৯৫৩), ‘উড়ন খাটোলা’(১৯৫৫), ‘আজাদ’(১৯৫৫), ‘ইনসানিয়ত’(১৯৫৫), ‘নয়া দৌড়’(১৯৫৭), ‘মুসাফির’ (১৯৫৭), ‘জহুরি’(১৯৫৮), ‘কোহিনুর’(১৯৬০), ‘গঙ্গা যমুনা’(১৯৬০), ইত্যাদি বিখ্যাত সব ছবিতে তিনি এই সময়পর্বের মধ্যেই অভিনয় করেছেন। ১৯৬২ সালে ব্রিটিশ চিত্র পরিচালক ডেভিড লিন তাঁর ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’ ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য প্রস্তাব দেন দিলীপ কুমারকে। বলাই বাহুল্য হলিউডের এই আহ্বান একজন অভিনেতার জীবনে আশীর্বাদের মতো। কিন্তু হলিউড সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ দিলীপ কুমার নানা অছিলায় সেই প্রস্তাব খারিজ করে দেন। ধীরে ধীরে ব্যর্থ ছবির সংখ্যা বাড়তে থাকে তাঁর। ১৯৬৭ সালে যমজ ভাইয়ের ভূমিকায় দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করে তিনি পুনরায় দর্শকের মন জয় করেন ‘রাম অর শ্যাম’ ছবিতে। ১৯৬৯ সাল থেকে বলিউডের জগতে নতুন ঘরানার নায়ক হিসেবে রাজেশ খান্নার আবির্ভাব দিলীপ কুমারের জনপ্রিয়তাকে ক্রমেই গ্রাস করতে থাকে।

১৯৭৬ সালে ‘বৈরাগ’ নামে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার পরে তা চরমভাবে ব্যর্থ হয় এবং এর পর দীর্ঘ পাঁচ বছর তিনি কোনো ছবিতে অভিনয় করেননি। বলা যায় ঐ সময় অভিনয়জীবন থেকে অবসর নিয়েছিলেন দিলীপ কুমার। কিন্তু ১৯৮১ সালে ‘ক্রান্তি’ ছবির সাফল্যের মধ্য দিয়ে তিনি পুনরায় অভিনয় জীবনে ফিরে আসেন। এরপর নায়ক হিসেবে নয়, চরিত্রাভিনেতা হিসেবেই তিনি একের পর এক সফল ছবিতে অভিনয় করে গিয়েছেন। ‘শক্তি’, ‘কর্ম’, ‘বিধাতা’, ‘মজদুর’, ‘মশাল’, ‘দুনিয়া’, ‘কানুন আপনা আপনা’, ‘ধর্ম অধিকারী’, ‘সওদাগর’ ইত্যাদি ছবিগুলির বেশিরভাগই বক্স অফিসে সফল। ১৯৯১ সালে ‘সওদাগর’ ছবিতে তিনি আবার প্রায় তিন দশক পরে রাজ কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেন একত্রে। ১৯৯৮ সালে শেষবারের মতো ‘কিলা’ ছবিতে তিনি একটি খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য দিলীপ কুমারই প্রথম ভারতীয় অভিনেতা যিনি ১৯৫০ সালে প্রতি ছবির জন্য এক লক্ষ টাকা সাম্মানিক দাবী করেছিলেন।

অভিনয় ছাড়াও একটি ছবিতে পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন দিলীপ কুমার। রাজেশ খান্নাকে মুখ্য ভূমিকায় রেখে ১৯৯৬ সালে ‘কলিঙ্গ’ নামে একটি ছবি পরিচালনা করেন কিন্তু তা মুক্তি পায়নি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, দিলীপ কুমারের নিজস্ব উদ্যোগে প্রযোজিত ছবি ‘গঙ্গা যমুনা’য় তাঁর নিজের ভাই নাসির খান অভিনয় করেছিলেন। এমনকি একটি ছবির প্রয়োজনে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে সেতার শিখেছিলেন বলে জানা যায়। অভিনয়, পরিচালনা ইত্যাদি ছাড়াও জীবনের উপান্তে এসে তিনি একটি আত্মজীবনী লিখেছেন ‘দিলীপ কুমার / দ্য সাবস্ট্যান্স অ্যাণ্ড দ্য শ্যাডো / অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ নামে যা প্রকাশ পায় ২০১৪ সালে।

সারাজীবনে বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। ১৯৫৮ সালে ‘মধুমতী’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ফিল্ম-ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পান দিলীপ কুমার। ১৯৯১ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করে এবং পরে ২০১৬ সালে উল্লেখ্য পদ্মবিভূষণ পুরস্কার পান তিনি। ১৯৯২ সালে দিলীপ কুমার ফিল্মফেয়ার লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। ১৯৯৫ সালে চলচ্চিত্রে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন তিনি। এরপর পাকিস্তানের সর্বোচ্চ খেতাব ‘নিশা-ই-ইমতিয়াজ’ লাভ দিলীপ কুমারের মুকুটে নতুন পালক সংযোজন করে। এই পুরস্কার পাবার সময় ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা সঙ্গীণ ছিল এবং পুরস্কার নিতে সম্মত হওয়ায় বম্বের একটি বামপন্থী সংগঠনের পক্ষ থেকে হুমকি পেয়ে দিলীপ কুমার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর কাছে সহায়তা ও সুরক্ষা প্রার্থনা করেছিলেন তিনি।

২০২১ সালের ৭ জুলাই ৯৯ বছর বয়সে দিলীপ কুমারের মৃত্যু হয়।

4 comments

আপনার মতামত জানান