বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম একজন ধনকুবের এবং উদ্যোগপতি এলন মাস্ক (Elon Musk)। ‘টেসলা’, ‘স্পেস এক্স’, ‘দ্য বরিং কোম্পানি’ এবং ‘নিউরালিঙ্ক’ ইত্যাদি বিখ্যাত সব সংস্থার কার্যনির্বাহী সম্পাদক ও প্রতিষ্ঠাতা তিনিই। ফোর্বস পত্রিকার বিচারে ২০২২ সালের এপ্রিল মাস থেকে তিনিই পৃথিবীর সর্বাধিক ধনী ব্যক্তিত্ব। অনলাইন টাকা লেনদেনের সবথেকে বড় মাধ্যম ‘পে-প্যাল’তাঁরই প্রতিষ্ঠিত। ২০০২ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করার ঠিক পরের বছরই ২০০৩ সালে তিনি ‘টেসলা মোটরস’ নামের একটি গাড়ি নির্মাণ কোম্পানি তৈরি করেন। বিদ্যুৎচালিত টেসলা গাড়ি বিশ্বের অন্যতম বিলাসবহুল গাড়িগুলির মধ্যে অন্যতম। ২০১২ সালে প্রথম তাঁর কোম্পানি ‘স্পেস এক্স’ অর্থের বিনিময়ে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে যাত্রী প্রেরণ করা শুরু করে যা আন্তর্জাতিক স্তরে খবরের শিরোনামে চলে আসে। তাঁর পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট উৎপাদনের ভাবনা বিজ্ঞানচর্চার অভিমুখটাই বদলে দিয়েছে যদিও এই ভাবনার বাস্তুবায়ন হয়নি এখনো।
১৯৭১ সালের ২৮ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়াতে এলন মাস্কের জন্ম হয়। তাঁর প্রকৃত নাম এলন রীভ মাস্ক। তাঁর মা মায়ে মাস্ক একজন মডেল এবং ডায়েটিশিয়ান। অন্যদিকে তাঁর বাবা এরোল মাস্ক ছিলেন পেশায় একজন বিমানচালক এবং নাবিক। টাঙ্গানিকা হ্রদের ধারে জাম্বিয়ান খনিটির অর্ধেক মালিকানা ছিল তাঁরই। এলন মাস্কের ছোট ভাইয়ের নাম কিম্বাল এবং বোনের নাম টস্কা। ১৯৮০ সালে এলনের বাবা ও মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে। ১০ বছর বয়স থেকেই কম্পিউটিং এবং ভিডিও গেমসের প্রতি এলনের আগ্রহ তৈরী হতে শুরু করে। মাত্র বারো বছর বয়সে ম্যানুয়াল দেখে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখে নেন তিনি। তাঁর তৈরি ‘ব্লাস্টার’ নামের একটি বেসিক-নির্ভর ভিডিও গেম ৫০০ ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করেন এলন মাস্ক। তাঁর সমগ্র শৈশবে বারবারই অন্য ছাত্রদের দ্বারা অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হয়েছিলেন এলন। স্বভাবত অন্তর্মুখী চরিত্রের এলন মাস্ককে তাঁর বন্ধুরা একবার সিঁড়ি থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল আর সেই জন্য তাঁকে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছিল। পরবর্তীকালে মোট দুই বার বিবাহ করেন এলন মাস্ক। ২০০০ সালে প্রথম কানাডিয়ান লেখিকা জাস্টিন উইলসনের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই বিচ্ছেদ ঘটে তাঁদের। এরপরে ২০১০ সালে ব্রিটিশ অভিনেত্রী টালুলাহ রেইলির সঙ্গে বিবাহ হয় এলনের। কিন্তু এই বিবাহও স্থায়ী হয়নি। এলন এবং তাঁর স্ত্রী জাস্টিন উইলসনের মোট ছয়টি পুত্রসন্তান আছে ।
এলন মাস্কের প্রথাগত শিক্ষা শুরু হয় অ্যাংলিকান সানডে স্কুলে ভর্তির মধ্য দিয়ে। এরপর ওয়াটারক্লুফ হাউজ প্রিপারেটরি স্কুলে ভর্তি হন এলন মাস্ক এবং এর পরে তিনি ভর্তি হন ব্র্যানস্টন হাই স্কুলে। তাঁর মায়ের সূত্র ধরে এলন কানাডিয়ান পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য। এই সময় কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অন্তর্বর্তী সময়ে এলন যাতে দক্ষিণ আফ্রিকার সেনাদলে যোগ না দেয় তাই বাধ্যতামূলকভাবে প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয় এলন মাস্ককে। ১৯৯০ সালে উচ্চতর শিক্ষার জন্য অন্টারিওর কিংস্টনে কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। এর দুই বছর পরে পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত হন এলন। ১৯৯৫ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক উত্তীর্ণ হন এলন মাস্ক। অর্থনীতিতে বিএসসি ডিগ্রি এবং পদার্থবিদ্যায় বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ১৯৯৪ সালে গ্রীষ্মকালে সিলিকন ভ্যালিতে দুটি ইন্টার্নশিপ করেন তিনি। জ্বালানি পদার্থবিদ্যায় গবেষণা করার জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এলন মাস্ক। কিন্তু ঠিক এই সময়েই পৃথিবী জুড়ে শুরু হওয়া আন্তর্জাল বিপ্লবে অংশগ্রহণ করতে পিএইচডি আর শেষ করা হয়নি এলনের। এই সময়েই নিজের উদ্যোগে একটি অনলাইন সিটি গাইড সফটওয়্যার নির্মাণ করেন এলন মাস্ক যার নাম ছিল ‘জিপ টু’। নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং শিকাগো ট্রিবিউন-এর মতো প্রকাশনার কাছে ‘জিপ টু’ সফটওয়্যারটি তথ্য বিক্রি করতে শুরু করে। ১৯৯৯ সালে কমপ্যাক কম্পিউটার্সের কাছে ৩ কোটি ডলারের বিনিময়ে ‘জিপ টু’ সফটওয়্যারটি বিক্রি করে দেন এলন মাস্ক। এর পাশাপাশি ৩ কোটি ৪০ লক্ষ ডলার মূল্যের শেয়ারও পান এলন মাস্ক। ঐ বছরই নিজের ভাইয়ের সঙ্গে একত্রে ‘এক্স ডট কম’ নামে একটি অনলাইন অর্থ লেনদেনের সাইট প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এই ‘এক্স ডট কম’ই ক্রমে বিবর্তিত হয়ে আজকের ‘পে-প্যাল’ কোম্পানিতে পরিণত হয়। ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে ‘ই-বে’ কোম্পানির কাছে ‘পে-পাল’ সংস্থা বিক্রি করে দেন এলন মাস্ক দেড়শো কোটি ডলারের বিনিময়ে। সেই সময় ‘পে-পাল’-এর প্রায় ১১ শতাংশ শেয়ারই ছিল এলন মাস্কের কাছে, ফলে সেই সংস্থা বিক্রি করে অচিরেই তিনি কোটিপতি হয়ে যান। এরপরে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক স্বার্থে ভ্রমণার্থীদের মহাকাশে পাঠানোর বন্দোবস্ত করার লক্ষ্যে ২০০২ সালে ‘স্পেস এক্স’ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ২০০৮ সালের মধ্যেই ‘স্পেস এক্স’ বিশ্বের অন্যতম মহাকাশযান নির্মাণকারী সংস্থায় পরিণত হয়। এমনকি বিশেষভাবে নির্মিত ‘স্পেস এক্স’ যানে করেই মহাকাশচারীদের যাতায়াতের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় নাসার সঙ্গে। ২০১২ সালে এলন মাস্কের উদ্যোগে একটি ক্যাপসুলসহ রকেট উৎক্ষেপিত হয় যার নাম ‘ফ্যালকন ৯’। কোনো বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে নির্মিত মহাকাশযান এই প্রথমবার আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে পাড়ি দেয়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘ফ্যালকন ৯’ রকেটের মাধ্যমে মহাকাশে একটি স্যাটেলাইট সফলভাবে স্থাপন করা হয়। এই স্যাটেলাইটটির উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর মহাকাশ কেন্দ্র এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর সূর্যের উচ্চমাত্রার তাপীয় বিকিরণের প্রভাব লক্ষ্য করা। ২০১৭ সালে প্রথমবার একটি ব্যবহৃত রকেটের যন্ত্রাংশ নিয়ে ‘ফ্যালকন ৯’ রকেটটি মহাকাশে পাড়ি দেয়। এই অভাবিত উদ্যোগের ফলে ভবিষ্যতে মহাকাশ ভ্রমণের খরচ অনেক কমে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয় যা মহাকাশ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক বিরাট উদ্যোগ। এলন মাস্কের সবথেকে বড়ো উদ্যোগ হল পৃথিবী বিখ্যাত ‘টেসলা’ গাড়ি-নির্মাণ কোম্পানি স্থাপন। টেসলার পক্ষ থেকে এলন ‘রোডস্টার’ নামের একটি স্পোর্টস গাড়ি বাজারে নিয়ে আসেন যার সাহায্যে ৩.৭ সেকেণ্ডের মধ্যেই ৬০ কিলোমিটার গতিবেগ বৃদ্ধি করা সম্ভব। এই গাড়িতে কোনো রকম জ্বালানি গ্যাস কিংবা তেল ছাড়াই শুধুমাত্র লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির সাহায্যে প্রায় ২৫০ মাইল পথ অতিক্রম করা সম্ভব। ২০১০ সালে বাজারে টেসলার শেয়ার ছাড়া হয় এবং এই শেয়ারের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ২২ কোটি মার্কিন ডলার। ‘টেসলা’ কোম্পানির বৈদ্যুতিন ‘মডেল এস’ গাড়িকে ‘মোটর ট্রেণ্ড’ পত্রিকা ‘২০১৩ সালের সবথেকে সেরা গাড়ি’র মর্যাদা দেয়। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে বৈদ্যুতিন গাড়ি প্রস্তুত কোম্পানি ‘টেসলা’র সঙ্গে সৌরশক্তি উৎপাদনকারী কয়েকটি সংস্থার একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ‘টেসলা মোটরস’ কোম্পানি ক্রমে সোলার সিটি কর্পোরেশনের সমস্ত স্টক কিনে নেয়।
২০১৩ সালে হাইপারলুপ পদ্ধতির মাধ্যমে বড় বড় শহরের মধ্যে অনেক কম সময়ে যাতায়াতের পদ্ধতি বর্ণনা করেন এলন মাস্ক। পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিতে চালিত এই হাইপারলুপ যে কোনো রকম আবহাওয়ায় চলতে সক্ষম। একটি নিম্নচাপ সম্পন্ন টিউবের নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার গতিতে ভ্রমণ করতে পারে এই যানটি। যদিও এই প্রস্তাব বাস্তুবায়ন হতে দশ-বারো বছর সময় লাগবে বলে ধারণা করা যায়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নির্মাতা সংস্থা ‘ওপেন এ আই’-এর চেয়ারম্যান ছিলেন এলন মাস্ক। ২০১৭ সালে ‘নিউরালিঙ্ক’ নামে একটি চিপ তৈরির কাজে সহায়তা করতে শুরু করেন এলন যা কিনা মানুষের মস্তিষ্কে স্থাপন করে সফটওয়্যারের সঙ্গে সমন্বয় ঘটাতে পারবে। ঐ বছরই ‘দি বোরিং কোম্পানি’ নামে একটি খননকারী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। এই কোম্পানি দুই মাইল দীর্ঘ একটি গভীর টানেল নির্মাণের প্রকল্প শুরু করেছে মার্কিন প্রদেশে। সম্প্রতি মহাকাশে নতুন নতুন সম্ভাবনার খোঁজ করতে এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির আরো নানাবিধ উৎস খুঁজে বের করার জন্য এলন মাস্ক তৈরি করেছেন ‘মাস্ক ফাউণ্ডেশন’ নামে একটি অবাণিজ্যিক সংস্থা।
সম্প্রতি ২০২১ সালে এলন মাস্ক তাঁর ‘স্পেস-এক্স’ সংস্থার অধীনে ‘স্টারলিঙ্ক’ (Starlink) নামের একটি বৈশ্বিক ইন্টারনেট পরিষেবা দেওয়ার জন্য ১ হাজারটিরও বেশি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠাতে সমর্থ হয়েছেন। যদিও তার অনেক আগে থেকেই স্যাটেলাইট পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ২০২১ সালে এলন মাস্ক ঘোষণা করেছেন যে, প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি ভোক্তাকে স্টারলিঙ্ক পরিষেবা দিতে শুরু করেছে এবং তা পৃথিবীর ৩২টি দেশের জন্য সহজেই উপলভ্য। উচ্চ গতিসম্পন্ন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা দিতেই এই ‘স্টারলিঙ্ক’-এর প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিলেন এলন মাস্ক যা কিনা পৃথিবীর এমন জায়গাতেও পরিষেবা দিতে পারবে যেখানে সাধারণ ইন্টারনেট পরিষেবা একেবারেই অচল। ২০১৮ সালে স্টারলিঙ্কের প্রথম স্যাটেলাইটটি মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল। এলন মাস্কের স্টারলিঙ্কই বিশ্বে প্রথম ব্যক্তিগত মালিকানার স্যাটেলাইট পরিচালিত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এছাড়াও ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার খরচ করে এলন মাস্ক কিনে নেন ‘ট্যুইটার’ (Twitter)। আধুনিক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে নতুনভাবে তিনি ট্যুইটারকে গড়ে তুলতে চান বলেই জানিয়েছেন।
বর্তমানে এলন মাস্কের বয়স ৫১ বছর।