সববাংলায়

কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরালা মামলা

ভারতের সংবিধান বিশ্বের মধ্যে অন্যতম বৃহৎ সংবিধান হিসেবে পরিচিত। তবে এই সংবিধান কখনই স্থির, অটল ছিল না, তাতে প্রায়ই পরিস্থিতি অনুসারে, ঘটনা অনুসারে সংশোধনী এসেছে। যোগ হয়েছে নতুন নতুন ধারা। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘সমাজতান্ত্রিক’ কথা দুটি সংবিধান প্রণয়নের একেবারে আদিপর্বে উপস্থিত ছিল না। সত্তরের দশকে সংবিধানের প্রস্তাবনায় এই শব্দ দুটি যুক্ত হয়। একইভাবে ভারতীয় সংবিধানের সংশোধনীর ইতিহাসে তথা ভারতীয় গণতন্ত্রের সুরক্ষার প্রসঙ্গে ‘মূল কাঠামো’-র এক ধারণার জন্ম হয়েছিল কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরালা মামলা সংক্রান্ত বিচারপর্ব থেকে। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে এই মামলার মধ্য দিয়েই প্রথম ভারতবাসী জানতে পারে যে সংবিধানের মূল কাঠামো বা মূলচরিত্র সংশোধনের অধিকার কোনও জনপ্রতিনিধির নেই, তা অচল এবং অলঙ্ঘ্য। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে যে সংবিধান সংশোধন করার রীতি রয়েছে তার বিপ্রতীপে এই মামলাটি একটি সতর্কবার্তা জারি রেখেছিল।

১৯৭০ সালের ২১ মার্চ কেশবানন্দ ভারতী ভারতের ভূমি সংস্কার আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে এই মামলা দায়ের করেছিলেন। মামলার বিচারের জন্য ১৩ জন বিচারপতির একটি ডিভিশন বেঞ্চ তৈরি হয় যাদের মধ্যে ছিলেন মুখ্য বিচারপতি এস এম সিক্রি, জে এম শেলাত, কে এস হেজ, এ এন গ্রোভার, বি জগনমোহন রেড্ডি, ডি জে পালেকর, এইচ আর খান্না, এ কে মুখার্জী, ওয়াই ভি চন্দ্রচূড়, এ এন রায়, কে কে ম্যাথিউ, এম এইচ বেগ এবং এস এন দ্বিবেদী। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর মামলা শুরু হয় এবং দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে মামলা চলার পরে চূড়ান্ত রায় শুনানি হয় ১৯৭৩ সালের ২৩ মার্চ। এই মামলায় কেশবানন্দ ভারতীর হয়ে মামলা লড়েছিলেন আইনজীবি নানাভাই পালখিভালা।

আরও পড়ুন:  এম সি মেহতা বনাম ভারত মামলা

১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কেরালার কাসারাগড় জেলার এডনির হিন্দু মঠের প্রধান তথা প্রবীণ সদস্য কেশবানন্দ ভারতী কেরালার ভূমি সংস্কার আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেন। এর এক বছর আগে ১৯৬৯ সালে এই আইনের আওতায় ভারতীয় এডনির মঠের সব সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা তৈরী হয় । এদিকে এডনির আশ্রমের একমাত্র আয়ের উৎস ছিল এই মঠ। ফলে সেটা হাতছাড়া হয়ে গেলে অত্যন্ত সমস্যার মুখে পড়তে হত তাঁদের। কেশবানন্দ ভারতীর বক্তব্য ছিল কেরালার ভূমি সংস্কার আইন তাঁর তিনটি মৌলিক অধিকারকে খর্ব করছে। প্রথমত, ভারতীয় সংবিধানের ২৫ নং ধারা অনুসারে প্রতিটি নাগরিকের নিজ নিজ ধর্মপালনের অধিকার রয়েছে। দ্বিতীয়ত, সংবিধানের ২৬ নং ধারা অনুসারে কোনও নাগরিক তাঁর নিজের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও সেই প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এক্ষেত্রে সংবিধানে বলা আছে সরকার এই নিয়ন্ত্রণের উপর কোনও হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। সবশেষে ৩১ নং ধারা অনুসারে সম্পত্তির অধিকার ছিল মানুষের মৌলিক অধিকার। এই মামলায় কেশবানন্দ ভারতীর হয়ে মামলা লড়েন সেকালের অন্যতম বিখ্যাত আইনজীবি নানাভাই পালখিওয়ালা। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে সুপ্রিম কোর্টে এই মামলা শুরু হয়। দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে মামলা চলার পরে ১৯৭৩ সালের ২৩ মার্চ মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। এই মামলার গুরুত্ব অনুধাবন করে সুপ্রিম কোর্ট ১৩ জন বিচারপতির একটি বেঞ্চ তৈরি করেছিল।

এই মামলার আগে গোলোকনাথ বনাম পাঞ্জাব রাজ্য মামলার শুনানির সময় সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের ২৪, ২৫, ২৬ ও ২৯তম সংশোধনী ধারার বৈধতা স্বীকার করেছিল। তাছাড়া সেই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে সংবিধানের কোনও মৌলিক অধিকার সংসদ পরিবর্তন করতে পারবে না। এমনকি এই রায়কে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ১৯৭১ সালে ২৪তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদ আবার সংবিধানের মৌলিক অধিকার সংশোধন করার পূর্ণ ক্ষমতা অর্জন করে। অন্যদিকে সংবিধানের ১৩ নং ধারায় বলা রয়েছে যে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে এমন কোনও আইন সংসদ পাস করতে পারবে না। কিন্তু আবার ভারতীয় সংবিধানেরই ৩৬৮ নং ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে সংসদ স্বাধীনভাবে সংবিধান সংশোধন করতে পারে। ফলে এই বিষয়টি নিয়ে জটিলতার অবকাশ ছিল। ১৩ জনের বেঞ্চ থেকে মোট এগারোটি পৃথক রায় আসে যাদের মধ্যে অনেকেই কিছু বিষয়ে একমত ছিলেন এবং বাকিরা ছিলেন সেই মতের বিরোধী। এই মামলায় নানাভাই পালখিওয়ালাকে সহায়তা করেছিলেন ফলি নারিমান এবং সোলি সোরাবজী। সংবিধানের ২৪তম সংশোধনীর বৈধতা অনুসারে ১৩ নং এবং ৩৬৮ নং ধারার ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট সংসদের সংবিধানে সংশোধনী আনাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরালা মামলা পূর্বতন বৈধতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলে যার ফলে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে কোনও অবস্থাতেই ভারতীয় সংবিধানের মূল কাঠামো সংসদ পরিবর্তন করতে পারবে না, তা অপরিবর্তনীয় এবং অলঙ্ঘ্য। ১৩ জন বিচারপতির বেঞ্চে নয়জন এই মামলার শুনানির পক্ষে স্বাক্ষর করেছিলেন যাঁদের মধ্যে ছিলেন মুখ্য বিচারপতি এস এম সিক্রি, জে এম শেলাত, কে এস হেজ, এ এন গ্রোভার, বি জগনমোহন রেড্ডি, ডি জে পালেকর, এইচ আর খান্না, এ কে মুখার্জী এবং ওয়াই ভি চন্দ্রচূড়। কিন্তু অন্যদিকে এ এন রায়, কে কে ম্যাথিউ, এম এইচ বেগ এবং এস এন দ্বিবেদী প্রমুখরা এতে স্বাক্ষর করেননি।

আরও পড়ুন:  বাঁদুরিদের রথযাত্রা

মুখ্য বিচারপতি এস এম সিক্রি বলেন যে ভারতে প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতার মৌলিক গুরুত্বকে সর্বদা সংরক্ষণ করতে হবে এবং অযৌক্তিকভাবে এই সংবিধানে কোনও রকম সংশোধনী আনা যাবে না। তিনি আরও বলেন যে ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় অংশ দ্বারা প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলি কখনই বাতিল করা যাবে না। সর্বোপরি তিনি বলেন যে ৩৬৮ নং ধারার মূল বক্তব্য হল আসলে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে যে কোনও রকম সংশোধনী আনা যাবে। একইভাবে বিচারপতি শেলাত এবং গ্রোভারও বলেন যে ৩৬৮ নং ধারায় সংবিধানের সংশোধনের কথা বলা হলেও তার উপরেও একটি মাত্রা রয়েছে। সংসদ কখনই সংবিধানের মূল কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না। বরং সংসদের সংশোধনীর উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সংবিধান বর্ণিত মৌলিক অধিকার ও মৌলিক কর্তব্যের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে চেষ্টা করা। তবে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার সংসদীয় ক্ষমতার উপর এই নিয়ন্ত্রণকে খুব একটা ভাল চোখে দেখেনি। ১৯৭৩ সালের ২৬ এপ্রিল সরকারের বদান্যতায় এই মামলার রায়ে যেহেতু বিচারপতি এ এন রায় স্বাক্ষর করেননি, তাই পূর্বতন প্রবীণ বিচারপতি শেলাত, গ্রোভার এবং হেজকে অপসারিত করে বহাল করা হয় এ এন রায়কে। এই ঘটনা ভারতীয় আইনি ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। ১৯৮০ সালে ইন্দিরা গান্ধী বনাম রাজ নারাইন মামলায় ৩৯তম সংশোধনীকে বাতিল করার জন্য মৌলিক কাঠামোকে ব্যবহার করা হয়েছিল। কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরালা মামলা এভাবেই বলা যায় ভারতের সংবিধানের মূল কাঠামোকে রক্ষা করেছিল। তবে আদালত মূল কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেনি সেই সময়।

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

চৈতন্যদেবের অসামান্য জীবনী দেখুন

চৈতন্য জীবনী

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন