আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ে (Ernest Hemingway) ছিলেন একজন আমেরিকান সাংবাদিক যিনি ইংরেজি সাহিত্যে খ্যাতিলাভ করেছিলেন সাহিত্যিক হিসেবে৷ তাঁর আবিষ্কৃত লেখনী কৌশল ‘হিমশৈল তত্ত্ব’ (iceberg theory) বিংশ শতকের সাহিত্যে ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পান তিনি।
১৮৯৯ সালের ২১ জুলাই শিকাগোর ইলিনয়ের ওক পার্কে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবা ক্লেরেন্স এডমন্ডস হেমিংওয়ে পেশায় একজন চিকিৎসক ছিলেন এবং তাঁর মা গ্রেস হল হেমিংওয়ে ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ । তাঁদের পরিবার ওক পার্কে যথেষ্ট সম্মানিত ছিল৷
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় ১৯১৩ সালে ওক পার্ক এন্ড রিভার ফরেস্ট হাই স্কুল (Oak Park and River Forest High School) থেকে৷ ১৯১৭ সাল পর্যন্ত তিনি এই স্কুলে পড়েছিলেন৷ তিনি খেলাধূলাতে খুব ভালো ছিলেন৷ পড়াশোনা করার পাশাপাশি বক্সিং, ট্র্যাক এবং ফিল্ড, ওয়াটার পোলো এবং ফুটবলের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন৷ হেমিংওয়ে তাঁর স্কুলের অর্কেস্ট্রাতেও অভিনয়ও করেছিলেন৷ হাই স্কুলে তাঁর পড়াশোনা চলাকালীন শেষ দু’বছর তিনি বিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র ট্র্যাপিজ এবং বর্ষপুস্তক টাবুলা সম্পাদনা করেন এবং এখানে তিনি ক্রীড়াজগতের ভাষা অনুকরণ করেন। তিনি রিং লার্ডনার জুনিয়র ছদ্মনামে লিখতেন সেই সময়ে। হেমিংওয়ের মা গ্রামের একজন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ছিলেন৷ সেই কারণে তিনি তাঁর মাকে পছন্দ করতেন না৷ হেমিংওয়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর মা তাঁকে সেলো ( cello) বাজাতে শিখিয়েছিলেন; যদিও পরবর্তী জীবনে তিনি সংগীত বিষয়ক রচনা লেখার সময় স্বীকার করেছিলেন যে তাঁর মা জোর করে সঙ্গীত না শেখালে তিনি এতটা ভালো লিখতে পারতেন না৷
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রাথমিক কর্মজীবন শুরু হয় কাব প্রতিবেদক(cub reporter) হিসেবে৷ হাই স্কুল শেষ হয়ে যাওয়ার পরে তিনি একজন কাব প্রতিবেদক হিসাবে কানসাস সিটি স্টারের হয়ে কাজ করা শুরু করেন যদিও তিনি সেখানে মাত্র ছয় মাস কাজ করেন। ১৯১৭ সালে রেডক্রসের দ্বারা তিনি ইতালিতে অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে যোগ দেন৷ প্রথমে তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে চেয়েছিলেন কিন্তু দৃষ্টিশক্তি কম থাকার কারণে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হন৷ তাঁর কর্মজীবন বহুমাত্রিক ছিল৷ ১৯১৮ সালের মে মাসে প্যারিসে জার্মানরা যখন কামান ও বোমা হামলা চালাচ্ছে সেই সময়ে তিনি নিউইয়র্ক থেকে যাত্রা শুরু করে প্যারিসে গিয়ে পৌঁছান। এরপর জুন মাসে তিনি এসে পৌঁছন ইতালীয় ফ্রন্টে। মিলানে আসার প্রথম দিনই তাঁকে এক শ্রমিক কারখানায় পাঠানো হয়, যেখানে বোমা বিস্ফোরণে নিহত মহিলা কর্মীদের টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া দেহ উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে তিনি যোগ দেন। পরবর্তীকালে এই ঘটনাটির উল্লেখ তিনি তাঁর বই ‘Death in the Afternoon’-এ বর্ণনা করেন৷
এরপর ৮ জুলাই তিনি ক্যান্টিন থেকে ফ্রন্টলাইনের কর্মীদের জন্য যখন চকোলেট এবং সিগারেট আনতে যাচ্ছিলেন, সেই সময় মর্টার হানায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন তিনি৷ আহত হওয়া সত্ত্বেও হেমিংওয়ে ইতালীয় সৈন্যদের রক্ষা করেছিলেন যার জন্য তাঁকে Italian Silver Medal of Bravery পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়। এই সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র আঠারো বছর৷ তিনি হাসপাতালে ছয় মাস ভর্তি ছিলেন৷ হাসপাতালে থাকাকালীন সেখানে তিনি দেখা করেছিলেন ‘চিংক’ ডোরম্যান-স্মিথের সাথে। পরবর্তীকালে তাঁদের মধ্যে একটি দৃঢ় বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল যা কয়েক দশক ধরে স্থায়ী ছিল।
১৯১৯ সালের গোড়ার দিকে হেমিংওয়ে দেশে ফিরে আসেন৷ মাত্র ২০ বছর বয়সেই তিনি অভিজ্ঞতায় অনেক বড়ো হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন চাকরিহীন অবস্থায় ঘরে বসে তিনি হতাশায় ডুবে যাচ্ছেন এবং তাঁর এই অবসাদ থেকে শীঘ্রই বের হয়ে আসা উচিত। তিনি অবসাদগ্রস্ত ভাব কাটানোর জন্য সেপ্টেম্বরে তাঁর হাই স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে মিশিগানের উর্ধ্বস্থ উপদ্বীপে মাছ ধরা ও ক্যাম্পিং সফরে যান। এই আনন্দের সফর তাঁর ‘Big Two-Hearted River’ ছোটগল্পের অনুপ্রেরণা জুগিয়ে ছিল। এই গল্প যেন তাঁরই অর্ধেক-আত্মজীবনী বলে দেয়৷ এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র নিক অ্যাডামস যুদ্ধ থেকে ফিরে স্বস্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে বেড়াতে যায় ৷
হেমিংওয়ের এক পারিবারিক বন্ধু তাঁকে টরন্টোতে চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব দিলে সেই প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করেন। সেই বছরের শেষ দিকে তিনি ‘টরন্টো স্টার’ সাপ্তাহিক পত্রিকার জন্য ফ্রিল্যান্সার এবং স্টাফ লেখক (staff writer) হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরের জুনে তিনি মিশিগানে থেকে ফেরেন এবং ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিকাগোতে চলে যান। সেখানে এক বন্ধুর সঙ্গে বসবাস শুরু করেন৷ শিকাগোতে থাকাকালীনও তিনি টরন্টো স্টারে গল্প পাঠিয়েছিলেন৷ শিকাগোয় তিনি মাসিক জার্নাল ‘কো-অপারেটিভ কমনওয়েলথের’ সহযোগী সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছিলেন।
হেমিংওয়ে প্যারিসে থাকাকালীন প্রথম কুড়ি মাসে টরন্টো স্টার পত্রিকার জন্য ৪৪ টি গল্প লিখেছিলেন। তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার ছাপ গল্পগুলিতে দেখা যায়৷ এই সময় তিনি বেশ কিছু ভ্রমণ কাহিনী লিখেছিলেন “Tuna Fishing in Spain” এবং “Trout Fishing All Across Europe: Spain Has the Best, Then Germany”। তাঁর লেখা গল্পে তিনি গ্রীক সেনাবাহিনীর পশ্চাদপসরণ সম্পর্কেও বর্ণনা করেছিলেন। ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের পাণ্ডুলিপিসহ একটি সুটকেস হারিয়ে যায়, যেটি তাঁর কাছে ভীষণ মর্মান্তিক ছিল।
১৯২৩ সালে তাঁর লেখা প্রথম বই প্রকাশিত হয় ‘ থ্রি স্টোরিস এন্ড টেন পোয়েমস’ (Three Stories and Ten Poems) নামে। এই বইয়ের প্রকাশক ছিলেন রবার্ট ম্যাকেলমন। হারিয়ে যাওয়া সুটকেসের পাণ্ডুলিপিতে থাকা দুটি গল্প এই বইয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তৃতীয় গল্পটি তিনি আগের বছর ইতালিতে থাকাকালীন লিখেছিলেন। এক মাসের মধ্যে বইটির দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। টরন্টোর জীবনযাত্রা তাঁর কাছে একঘেয়ে লাগতে শুরু করলে সাংবাদিকতা ছেড়ে তিনি লেখক জীবনে ফিরে আসেন।
১৯২৫ সালে ‘ইন আওয়ার টাইম ‘ নামে তাঁর গল্প সংকলনটি নিউ ইয়র্ক সিটিতে প্রকাশিত হয়েছিল; যদিও ১৯২৪ সালে এটি প্রথম প্যারিসে মুক্তি পায়৷ ১৯২৬ সালে তাঁর বই ‘দ্য সান আওয়ার রাইজস’ প্রকাশিত হয় । এই উপন্যাস যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল৷ ছোটোগল্প রচয়িতা হিসেবে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন ১৯২৭ সালে ‘মেন উইদআউট উইমেন ‘ প্রকাশিত হওয়ার পর৷ তাঁর সেরা গল্পগুলির মধ্যে রয়েছে “দ্য কিলারস”, “দ্য শর্ট হ্যাপি লাইফ অফ ফ্রান্সিস ম্যাকোমবার,” এবং “কিলিমঞ্জারোর স্নোস” এছাড়া তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস ‘অ্যা ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ (১৯২৯) যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়। স্পেনে থাকাকালীন তাঁর অভিজ্ঞতার ফসল হল “ফ্রম হুম দ্য বেল টোলস” (১৯৪০) উপন্যাসটি।
১৯৪৮ সালে তিনি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ইংল্যান্ড ঘুরতে যান। সেখানে থাকার সময় মাত্র আট সপ্তাহে তিনি ”দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি”-র খসড়া তৈরী করেন৷ এই উপন্যাসটির প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন “the best I can write ever for all of my life”। এই বইটি তাঁকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল৷ এই বইয়ের জন্য ১৯৫২ সালের মে মাসে তিনি পুলিৎজার পুরষ্কার পান৷ ১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসে তিনি নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন৷ লেখকের জীবন নিয়ে একটি বক্তৃতায় তিনি বলেন ”Writing, at its best, is a lonely life. Organizations for writers palliate the writer’s loneliness but I doubt if they improve his writing…।”
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের স্মৃতি বিজড়িত তিনটি বাড়ি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক স্থানের জাতীয় রেজিস্টারে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে৷ এছাড়া ইলিনয়ের ওক পার্কে তাঁর শৈশবের বাড়িটি হেমিংওয়ের প্রতি উৎসর্গীকৃত করে জাদুঘর ও সংরক্ষণাগার তৈরী করা হয়েছে । ২০১২ সালে শিকাগো লিটারেরি হল অফ ফেমে ( Chicago Literary Hall of Fame) তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
শিল্পকলা ও সংস্কৃতিতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁর নামে একাধিক পুরস্কার প্রবর্তিত হয় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, হেমিংওয়ে ফাউন্ডেশন, পেন পুরস্কার এবং হেমিংওয়ে পুরস্কার।
১৯৬১ সালের ২ জুলাই আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মৃত্যু হয়৷