লণ্ডনের বিখ্যাত মাদাম তুসোর মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা এবং একজন অসামান্য শিল্পী হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন মেরি তুসো (Marie Tussaud)। প্রায় দুশো বছরেররও বেশি প্রাচীন এই মিউজিয়ামে রাখা বিখ্যাত সব মানুষদের অনবদ্য মোমের মূর্তিগুলি আজও পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে রয়েছে। ফরাসি বিপ্লব চলাকালীন তিনি মোমের সাহায্যে মূর্তি নির্মাণের কৌশল শেখেন এবং প্রথম দিকে মোমের সাহায্যে ফ্রান্সে গিলোটিনে নিহত ব্যক্তিদের ধড়হীন মাথার প্রতিকৃতি নির্মাণ করতেন। পরে ১৭৭৭ সালে বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক ও লেখক ভলতেয়ারের মোমের মূর্তি নির্মাণ করার ফলে তাঁর খ্যাতি ক্রমে বাড়তে থাকে। যদিও তার আগে আরেক ফরাসি দার্শনিক রুশোর মূর্তিও তৈরি করেছিলেন তিনি। ১৭৮০ সালে রাজা ষোড়শ লুইয়ের বোন তাঁকে নিজের শিল্প-শিক্ষকের পদে নিযুক্ত করেন। ১৮৩৫ সালে লণ্ডনের বেকার স্ট্রিটে তিনি প্রথম একটি স্থায়ী প্রদর্শনীক্ষেত্র তৈরি করেন তাঁর এই মোমের মূর্তিগুলি সাধারণ মানুষকে দেখানোর জন্য। তাঁর তৈরি এই সব মোমের মূর্তিগুলিই বর্তমানে মাদাম তুসোর মিউজিয়ামকে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছে।
১৭৬১ সালের ১ ডিসেম্বর ফ্রান্সের স্ট্রাওসবার্গে মেরি তুসোর জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম ছিল মেরি গ্রসহলৎজ। তাঁর বাবা জোসেফ গ্রসহলৎজ ছিলেন একজন সৈনিক যিনি মেরির জন্মের দুই মাস আগেই সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল অ্যানে-মেরি ওয়েল্ডার। ছয় বছর বয়সে মেরি তুসোকে নিয়ে তাঁর মা সুইজারল্যাণ্ডের বার্ন শহরে চলে আসেন। এই শহরেই স্থানীয় এক ডাক্তার ফিলিপ কুর্টিয়াসের বাড়িতে ঘর-দোর দেখাশোনা করার কাজে নিযুক্ত হন মেরির মা এবং সেই ডাক্তারের বাড়িতেই দুজনে মিলে থাকতেন। এই ডাক্তার কুর্টিয়াসকে মেরি তুসো কাকা বলে সম্বোধন করতেন যিনি ডাক্তারির পাশাপাশি খুব ভালো মোমের মূর্তি বানাতে পারতেন। কুর্টিয়াসও মেরিকে নিজের মেয়ের মতোই দেখাশোনা করতেন ও ভালোবাসতেন। ১৭৯৫ সালে ফ্রান্সিস তুসোর সঙ্গে বিবাহ হয় মেরি তুসোর। তাঁদের এক কন্যা জন্মের পরেই মারা যায়। জোসেফ ও ফ্রান্সিস নামে তাঁদের আরো দুই পুত্রসন্তান ছিল।
ক্রমে মেরি তুসো সুইজারল্যাণ্ডের নাগরিকত্ব অর্জন করেন এবং কুর্টিয়াসের থেকে এই মূর্তি তৈরির কৌশল শিখে নেন। ডাক্তার কুর্টিয়াস তাঁর এই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে প্রথমদিকে মানবশরীরের প্রতিকৃতি তৈরি করতেন এবং পরে তিনি বিশেষ বিশেষ মানুষের মোমের পোর্ট্রেট করা শুরু করেন। সেকালে এই মোমের মূর্তি তৈরি করা এক জনপ্রিয় ব্যাপার ছিল। বহু চার্চে তাঁদের বিখ্যাত সব সন্তদের মোমের মূর্তি করে রাখা হত। ১৭৬৫ সালে ডাক্তার কুর্টিয়াসের সঙ্গে মেরি তুসো এবং তাঁর মা প্যারিসে চলে আসেন এবং সেখানেই মেরি গড়ে তোলেন ‘ক্যাবিনেট ডি পোর্ট্রেটস এন সিয়ার’ অর্থাৎ মোমের মূর্তি তৈরির একটি স্টুডিও। সেই বছরই রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের স্ত্রী মাদাম দু ব্যারির একটি মোমের মূর্তি নির্মাণ করেন মেরি তুসো। ক্রমে ১৭৭০ সাল নাগাদ তাঁর এই মূর্তি তৈরির ব্যবসা উন্নতি করতে শুরু করে। কুর্টিয়াসের সঙ্গে তাঁর তৈরি মূর্তিগুলিও মানুষকে আকৃষ্ট করতে থাকে। ১৭৭৬ সালে প্যালেইস রয়্যালে তাঁর এই প্রদর্শনীটি সরিয়ে নিয়ে যান মেরি এবং পরে ১৭৮২ সালে ডাক্তার কুর্টিয়াস আরেকটি নতুন প্রদর্শনী করেন ‘ক্যাভার্ন অফ দ্য গ্র্যাণ্ড থিভস’ নামে। ফরাসি রাজপরিবারের অধীনে ছিল সেই প্রদর্শনীক্ষেত্রটি। ক্রমেই ফরাসি রাজপরিবারের কাছেও মেরি তুসোর খ্যাতি পৌঁছে যায় এবং রাজসমাদর লাভ করেন মেরি। কুর্টিয়াস মেরিকে ভালোভাবেই এই মোমের মূর্তি তৈরি কৌশল শিখিয়ে দিয়েছিলেন। আর এই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে মেরি তুসো প্রথম নিজের চেষ্টায় ১৭৭৭ সালে তৈরি করেন ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের মোমের মূর্তি। ঠিক এর পরের বছরই ১৭৭৮ সালে তিনি তৈরি করেন আরেক ফরাসি দার্শনিক জাঁ জ্যাক রুশোর মূর্তি। এরপরে ১৭৮০ সাল থেকে ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্মুহূর্তে দীর্ঘ সময় ধরে অরাজক ও বিশৃঙ্খল অবস্থা চলে। আর এই সময়পর্বের মধ্যেই মেরি তুসো তাঁর সব বিখ্যাত মূর্তিগুলি তৈরি করেছিলেন যার মধ্যে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের মূর্তিটি ছিল অন্যতম সৃষ্টি। ১৭৮০ সালেই মেরি তুসো রাজা ষোড়শ লুইয়ের বোন এলিজাবেথের শিল্প-শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সেই সময় নয় বছর যাবৎ তিনি থাকতেন ভার্সেইয়ের রাজ-আদালতে। তবে এই তথ্যের কোনো পাথুরে প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
১৭৮৯ সালে মেরি তুসো আবার প্যারিসে ফিরে আসেন। ১৭৮৯ সালের ১২ জুলাই ডাক্তার কুর্টিয়াস তাঁর বানানো জ্যাকুইস নেকার ও ডিউক ডি অর্লিয়্যান্সের মাথার মোম প্রতিকৃতি নিয়ে একটি প্রতিবাদ সভায় হাজির হন। তার দুই দিন পরেই বাস্তিল দূর্গ আক্রমণ করেন বিপ্লবীরা। মেরি তুসো এই সময় ফ্রান্সে যথেচ্ছাচারে গিলোটিনে হত্যা করা বিপ্লবীদের মাথার অনুসরণে মোমের প্রতিকৃতি তৈরি করতে শুরু করেন এবং তাঁর নির্মিত সেই মাথাগুলির জন্য সন্ত্রাসের রাজত্বে তিনি গ্রেপ্তার হন। ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে গিলোটিনে হত্যা করার দাবি ওঠে। তাঁর মাথা মুড়িয়ে ফেলা হয় গিলোটিনে হত্যা করার প্রস্তুতি হিসেবে। মেরি তুসো পরে জানিয়েছেন এক সাক্ষাৎকারে যে, তাঁর কাজ ছিল সেই সময় ‘ডেথ মাস্ক’ তৈরি করা এবং বিপ্লবে শহীদ হওয়া মনীষীদের সমগ্র দেহের মোম-প্রতিকৃতি তৈরি করা। এই কাজে মেরি তুসো যে যে মূর্তিগুলি নির্মাণ করেছিলেন তার মধ্যে মেরি আঁতোয়ানেত, ষোড়শ লুই, প্রিন্সেস ডি ল্যাম্বেল, ম্যারাট ও রোবোস্পিয়ার ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৭৮৭ সাল নাগাদ ফ্রান্সের বেশ কিছু বুদ্ধিজীবিদের সঙ্গে মেরি তুসোকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে বন্দি করা হয় এবং ১৭৯৩ সালে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁকে। ১৭৯৪ সালে ডাক্তার কুর্টিয়াসের মৃত্যু হলে তাঁর বানানো সমস্ত মোমের মূর্তির স্বত্ব মেরি তুসোকে দিয়ে যান তিনি।
১৮০২ সালে তাঁর চার বছর বয়সী সন্তান জোসেফের সঙ্গে মেরি তুসো তাঁর পোর্ট্রেটগুলির প্রদর্শনীর জন্য লণ্ডনে যান। লিসিয়াম থিয়েটারে এই প্রদর্শনী করার জন্য তিনি আমন্ত্রণ পান পল ফিলিডরের থেকে। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে এই প্রদর্শনী করা হয়ে ওঠে না তাঁর এবং মেরি ১৮০৩ সালে এডিবরার দিকে রওনা দেন। ১৮২৫ সালের নভেম্বর মাসে উইসবেক জর্জিয়ান থিয়েটার ভ্রাম্যমান প্রদর্শনী করেন মেরি তুসো। তারপর এভাবেই ঘুরে ঘুরে একে একে ইয়ারমাউথ, নরউইক, কিংস লিন, বারি সেন্ট এডমাণ্ডস ইত্যাদি জায়গায় প্রদর্শনী করতে থাকেন মেরি তুসো। এরই মধ্যে প্রাশিয়ার রাজকন্যা ফেদেরিকা শার্লট মেরি তুসোকে অনুরোধ করেন একটি ছোট্ট ছেলের মোমের প্রতিকৃতি বানিয়ে দিতে। পরে মেরি জানতে পারেন যে ব্যক্তিগত জীবনে সেই রাজকন্যার স্বামী অন্য এক স্ত্রীয়ের কারণে তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন এবং রাজকন্যা ফেদেরিকা ও তাঁর স্বামীর আদপে কোনো সন্তান ছিল না। তাই সন্তানের কামনায় এই অনুরোধ করেছিলেন রাজকন্যা। ১৮৩৫ সালে তেত্রিশবছর ধরে ব্রিটেনের নানা স্থানে ঘোরার পরে বেকার স্ট্রিটে একটি স্থায়ী প্রদর্শনী গড়ে তোলেন মেরি তুসো। এই জায়গাটিই ধীরে ধীরে বর্তমানের মাদাম তুসোর মিউজিয়ামের রূপ নিয়েছে। ১৮৩৮ সালে নিজের আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিকথা লেখেন মেরি তুসো। ১৮৪২ সালে মেরি নিজের একটি অনবদ্য সুন্দর মোমের পোর্ট্রেট নির্মাণ করেন যা বর্তমানে মাদাম তুসোর মিউজিয়ামে ঢোকার মুখেই স্থাপিত রয়েছে।
লণ্ডনের বেকার স্ট্রিট থেকে আমস্টারডাম, বেজিং, সানফ্রান্সিস্কো, ইস্তানবুল, ব্যাঙ্কক, বার্লিন, সিডনি, হংকং, নিউ ইয়র্ক সিটি, টেক্সাস,সাঙ্ঘাই, ওয়াশিংটন ডিসি, সিঙ্গাপুর, টোকিও প্রভৃতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই মিউজিয়ামের শাখা স্থাপিত হয়েছে। সম্প্রতি ভারতের নতুন দিল্লিতেও এর শাখা স্থাপিত হয়েছে।
সুজান ওয়েনের লেখা অন্যতম বিখ্যাত বই ‘ফেসেস অফ দ্য ডেড’-এর অন্যতম মুখ্য চরিত্র হিসেবে দেখা যায় মেরি তুসোকে। তাঁর জীবন অবলম্বনে ২০১৮ সালে এডওয়ার্ড ক্যারে একটি বই লেখেন ‘লিটল’ নামে।
১৮৫০ সালের ১৬ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে মেরি তুসোর মৃত্যু হয়।
2 comments