গওহর জান

গওহর জান

গওহর জান (Gauhar Jaan) একজন স্বনামধন্য ভারতীয় গায়িকা ও নৃত্যশিল্পী যিনি ভারতের প্রথম নারী সুপারস্টার হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। তিনিই প্রথম ভারতীয় শিল্পী যাঁর গান গ্রামোফোন কোম্পানি দ্বারা রেকর্ড করা হয়।  হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের ঠুমরি, দাদরা, ভজন, গজল, বিষ্ণুপুরী, ইত্যাদি গানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন তিনি। গানের পাশাপাশি নাচেও তিনি অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন।

১৮৭৩ সালের ২৬ জুন ভারতের আজমগড়ে এক ইহুদি পরিবারে গওহর জানের জন্ম হয়। বাবা মায়ের দেওয়া নাম ছিল অ্যাঞ্জেলিনা ইওয়ার্ড। তাঁর বাবা উইলিয়াম ইওয়ার্ড পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে স্থানীয় বরফ কারখানায় কাজ করতেন। তাঁর মা ভিক্টোরিয়া হেমিংস নাচ ও গানে যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। গওহর জানের স্বামীর নাম সৈয়দ আব্বাস যিনি বিয়ের আগে গওহর জানের ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন।  

গওহর জানের বয়স যখন ছয় তখন তাঁর মা-বাবার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। মা ভিক্টোরিয়া শিশু অ্যাঞ্জেলিনা(গওহর জান)কে নিয়ে বেনারস চলে যান এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।  ভিক্টোরিয়া নাম বদলে নিজের নাম রাখেন বড়ি মালকা জান (তাঁর সময়ে আরও তিনজন মালকা জান ছিল – আগ্রার মালকা জান, মুল্ক পুখরাজের মালকা জান এবং চুলবুলির মালকা জান।  ভিক্টোরিয়া বয়সে এঁদের সবার থেকে বড় ছিলেন) এবং মেয়ে অ্যাঞ্জেলিনার নাম বদলে রাখেন গওহর জান। ১৮৮৩ সালে দশ বছর বয়সে গওহর মায়ের সাথে কলকাতায় যান। সেখানে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের দরবারে নবাবের ব্যক্তিগত অনুরাগিণী ও নর্তকী হিসেবে যুক্ত হন মালকা জান।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

মায়ের হাত ধরেই দশ বছর বয়স থেকে গওহর জানের সাংস্কৃতিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। কলকাতায় তাঁর মা মালকা তাঁকে হিন্দুস্তানি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। সে সময় নবাব ওয়াজিদ আলির দরবারে আনাগোনা লেগেই থাকত ভারতবর্ষের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দিকপাল ব্যক্তিত্বদের। মায়ের সুবাদে তাঁদের কাছেই সঙ্গীতচর্চা শুরু করেন গওহর। এভাবেই ঠুমরি, দাদরা, ভজন, গজল, বিষ্ণুপুরী সহ ধ্রুপদী সঙ্গীতে পারদর্শী হতে থাকেন তিনি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীতও শিখতে শুরু করেন তিনি। চরণ দাসের কাছে বাংলা কীর্তনও শিখতেন গওহর জান। কেবল সঙ্গীতেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি তিনি, নৃত্যেও নিজেকে পারদর্শী করে তোলেন তিনি। সাংস্কৃতিক শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষাও শিখতে শুরু করেন গওহর। প্রায় ডজনখানেক ভাষায় পারদর্শী ছিলেন তিনি।

সাংস্কৃতিক অঙ্গণে তাঁর কর্মজীবনের অভিষেক ঘটে ১৮৮৭ সালে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে। গওহর জনসমক্ষে বিহারের মহারাজা লক্ষমেশ্বর সিং বাহাদুরের দ্বারভাঙ্গা দরবারে তাঁর জীবনের প্রথম গান ও নাচ পরিবেশন করেন।  গওহর জানের গান ও নাচে মুগ্ধ হয়ে প্রথম পরিবেশনাতেই তাঁকে দরবারের প্রধান সঙ্গীত ও নৃত্যশিল্পী  হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

ধীরে ধীরে কলকাতার অভিজাত মহল এবং জমিদারদের সঙ্গীত সভায় জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেন গওহর জান। ঠুমরী গাইতে গাইতে গওহর জানের নৃত্য ছিল বেশি আকর্ষণীয়। এমনকি একটা সময় কলকাতার মেহফিল ও মজলিসগুলোয় প্রধান আকর্ষণ হয়ে  ওঠেন গওহর। ক্রমে তিনি ডাক পেতে শুরু করেন ভারতবর্ষের দেশীয় রাজ্যগুলির রাজসভা থেকে। ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের দিল্লি দরবারেও তাঁর গান পরিবেশনার বিশেষ আমন্ত্রণ পান গওহর।

গওহর জান তাঁর গায়কী জীবনে সুপারস্টার হয়ে উঠেন গ্রামোফোন রেকর্ডের মাধ্যমে। কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে স্থানীয় কার্যালয় খুলতে ভারতে আসেন গ্রামোফোন ও টাইপরাইটার লিমিটেডের রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম ফ্রেডরিক গেইসবার্গ। এক বাঙালি বাবুর দরবারে নৈশভোজের আমন্ত্রণ পান উইলিয়াম। গওহর জানও সেখানে উপস্থিত ছিলেন গান পরিবেশনার জন্য।

গওহরের গানে মুগ্ধ হয়ে সেই নৈশভোজেই উইলিয়াম সিদ্ধান্ত নেন গওহরকে দিয়েই তিনি প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড করাবেন। রেকর্ডিংয়ের প্রতি সেশনের জন্য তিন হাজার টাকা দাবি করেছিলেন গওহর। সে দাবি মেনেই তাঁকে দিয়ে গান রেকর্ড করার চুক্তি পাকা করেন গেইসবার্গ। 

১৯০২ সালের ১১ নভেম্বর কলকাতার এক হোটেলের ঘরে অস্থায়ীভাবে তৈরী স্টুডিওতে প্রথম গান রেকর্ড করা হয় গওহর জানের। এটি ছিল কোন ভারতীয়ের করা সর্বপ্রথম রেকর্ডিং।  আর গ্রামোফোনোর রেকর্ড করা গান অল্পদিনের মধ্যে খ্যাতি এনে দেয় গওহর জানের। কলকাতার সব সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয় তাঁর ছবি। গ্রামোফোনে গান রেকর্ড হওয়া এবং প্রতিটি গানের শেষে নিজকণ্ঠে “মাই নেম ইজ গওহর জান” ঘোষণার মাধ্যমে ভারতের সঙ্গীত জগতে বিখ্যাত হয়ে উঠেন গওহর জান।  তাঁর রেকর্ডে লেখা থাকত ‘ফার্স্ট ডান্সিং গার্ল’। এই গান রেকর্ডিংয়ের মধ্য দিয়েই উপমহাদেশের সঙ্গীত জগতের প্রথম নারী সুপারস্টার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন গওহর।

এই রেকর্ডের মাধ্যমেই রাজ দরবার ও দেশের দূর-দূরান্তের গ্রামে-মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ে গওহর জানের পরিচিতি।  গান গাইতে কলকাতায় বারো বগির আস্ত একটা ট্রেন পাঠিয়ে গওহর জানকে নিয়ে যেতেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের রাজারা। গওহরের খ্যাতি এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছিল যে অস্ট্রিয়া এবং চেকোশ্লোভাকিয়াতে তৈরি হওয়া দেশলাইয়ের বাক্সতেও থাকত তাঁর ছবি যা কলকাতার বাজারে বেশ চড়া দামেই বিক্রি হত।

১৯২০ সালে কংগ্রেসের স্বরাজ আন্দোলনের তহবিল সংগ্রহের জন্য কলকাতায় এসেছিলেন গান্ধীজি।  সে সময় এক সভায় গওহর জানের সঙ্গে দেখা হলে একটি চ্যারিটি কনসার্ট করে কিছু অনুদান তুলে দিতে বলেন তিনি। গওহর জান শর্ত দেন অবশ্যই চ্যারিটি কনসার্ট করবেন কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে গান্ধীজিকে উপস্থিত থাকতে হবে। গান্ধীজি গওহরের শর্তে রাজী হন। গওহরের সেই কনসার্টে বেশ সাড়া দিয়েছিলো কলকাতার মানুষ। টিকিট বিক্রি করে মোট ২৪ হাজার টাকা উঠেছিল। যদিও বিশেষ রাজনৈতিক কর্মসূচীর কারণে সেদিন কনসার্টে আসতে পারেননি গান্ধীজি। 

১৯০২ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত আঠারো বছরের দীর্ঘ সঙ্গীত রেকর্ডিং জীবনে গওহর জান বাংলা, উর্দু ও পার্শির পাশাপাশি ইংরেজি, ফরাসি,আরবী, তামিল, মারাঠি, গুজরাটি, পশতু, পেশোয়ারি সহ দশটিরও বেশি ভাষায় প্রায় ছয়শোর কাছাকাছি গান রেকর্ড করেছিলেন।

গওহর জান কেবল অসামান্য সঙ্গীত শিল্পী ও নৃত্য পটিয়সীই ছিলেন না, তিনি একজন কবি, গীতিকার ও সুরকারও ছিলেন।  ‘হমদম’ এবং ‘গওহর পিয়া’ ছদ্মনামে তিনি সঙ্গীত রচনাও করতেন।  বিখ্যাত ‘রসকে ভরে তোরে নয়ন’ ঠুমরিটি গওহর জানের লেখা।  এছাড়াও গওহর জান লিখেছেন, ‘ফাঁকি দিয়ে প্রাণের পাখি উড়ে গেলো আর এলো না’। 

ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর চালচলনে ছিল রাজকীয় ভাব।  দরবারে গান পরিবেশন করে রাজা ও জমিদারদের কাছ থেকে দামি উপহার পেয়েছেন অজস্র। কর্মময় জীবনে প্রচুর আয়ও করেছেন দুই হাতভরে। তাঁর সময়ে সাধারণ জনগণের জন্য ঘোড়ার গাড়িতে চড়া নিষিদ্ধ ছিল। ভাইসরয়কে দিনে এক হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে সামনে-পিছনে চারটি ঘোড়া নিয়ে কলকাতার রাস্তায় বেড়াতেন তিনি।  তাঁর পোষ্য বেড়ালের বিয়ে উপলক্ষ্যে সেই সময়ে দুই হাজার টাকা খরচা করেছিলেন। তার কয়েক মাস পর সেই বেড়ালের ছানা হওয়ার আনন্দে বাইশ হাজার টাকা খরচ করে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করেছিলেন। তাঁর সাজগোজেও ছিলো রাজকীয় মেজাজ। রানী মহারানীদের মতোই পোশাকে বেড়াতেন তিনি।  

তিনি সংসার জীবন শুরু করেছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত সচিব ও তবলচি সৈয়দ আব্বাসকে বিয়ে করে।  গওহরের চেয়ে বয়সে বেশ ছোট আব্বাস-ই তাঁর রাজকীয় সম্পত্তি ধ্বংস করে দেয়।  আদালতের মাধ্যমে আব্বাসের সাথে ছাড়াছাড়ি হলেও, ততদিনে তাঁর সকল সম্পত্তি শেষ হয়ে যায়। এমনই কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন তিনি, যে শেষ বয়সে এক টাকায় এক একটি বন্দীশ বিক্রি করে জীবন চালাতে হত তাঁকে। 

গওহর জান তাঁর সারা জীবনে সম্মাননা হিসেবে পেয়েছেন কেবল খ্যাতি ও নজরানা । ২০১৮ সালের ২৬ জুন তাঁর ১৪৫ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে ডুডুলের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানায় গুগল।

সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে, ১৯২৮ সালে ১ আগস্ট মাত্র পাঁচশো টাকা মাসিক বেতনে মাইসোরের মহারাজার দরবারে সভা গায়ক হিসাবে যোগ দেন গওহর জান। কিন্তু তত দিনে মানসিক অশান্তি, দুশ্চিন্তা ও অর্থাভাবে তাঁর মনের গভীরে বাসা বেঁধেছে চরম অবসাদ।

১৯৩০ সালের জানুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে গওহর জানকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবশেষে ১৯৩০ সালের ১৭ জানুয়ারি গওহর জানের মৃত্যু হয়।

One comment

আপনার মতামত জানান