মনসা ব্রত

এক বিধবা বেনেনী ছিল। তার পাঁচ ছেলে আর পাঁচ বউ ছিল। বড় চার বউয়ের বাপের বাড়ি অবস্থাপন্ন হওয়ায় মাঝে মাঝেই তাঁদের বাপের বাড়ি থেকে নানারকম জিনিষ আসত। কিন্তু ছোট বউয়ের বাপ খুব গরীব ছিল, তাই তার বাপের বাড়ি থেকে কোন তত্ত্ব তালাশ না আসায়, তার চার জা আর বেনেনী মিলে ছোট বউকে পাঁচ কথা শোনাত। ছোট বউ সবই সহ্য করে নিত।

আষাঢ় মাসের শেষ সংক্রান্তি। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ে চলেছে, আর চার বউ মিলে পাশা খেলছে আর গল্প করছে। এমন সময় বড় বউ বলে আজ গরম খিচুড়ি হলে পেট ভরে খেতাম, মেজ বলে মুড়ি তেলে ভাজা খেতাম, কেউ বলে ঝাল আচার দিয়ে মুড়ি মেখে খেতাম। এইভাবে চার জায়ে খুব গল্প করছে, কিন্তু ছোট বউ একধারে চুপ করে থাকায় তারা ছোট বউকে কি খেতে ইচ্ছা করছে জিজ্ঞাসা করে। তা শুনে ছোট বউ বলে- “এই বৃষ্টির দিনে আমার পান্তা ভাত আর পুঁটি মাছের টক খেতে ইচ্ছা করছে।” বিকালে পাঁচ বউ মিলে বনের ধারে পুকুরে গা ধুতে গেল। ক্রমে সন্ধ্যা হয়ে এল। সেই বনেতে অষ্টনাগ বাস করত।হঠাৎ একদিন বনে আগুন লাগাতে তারা সেই পুকুরে মাছ হয়ে লুকিয়ে ছিল। ছোট বউ গা ধুয়ে কাপড় কাচছে, এমন সময় তার পায়ের কাছে কি সব কিলবিল করে উঠল। সে সেগুলোকে মাছ-এর বাচ্চা ভেবে গামছায় ছেঁকে জল থেকে তুলে মাটির হাঁড়িতে জিইয়ে রাখল।পরদিন চাপা খুলে দেখে সেগুলো সব সাপের বাচ্চা। তা দেখে ছোট বউ আর কি করে তাদের গরম দুধ আর পাকা কলা খেতে দিলে। এই সাপগুলো ছিল মা মনসার ছেলে। একটু বড় হয়ে ওরা স্বর্গে চলে গেল।

এইদিকে মনসা তার ছেলেদের দেখতে না পেয়ে কেঁদে আকুল। ছেলেরা স্বর্গে গিয়ে মা মনসাকে ছোট বউএর দুঃখের গল্প শোনায়। ছোট বউয়ের দুঃখের গল্প শোনায়। ছোট বউয়ের দুঃখ দেখে মা মনসা বৃদ্ধার বেশ ধরে বেনে বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হয়, সেখানে দেখেন বেনেনী চার বউয়ের সাথে মিলে ছোট’র বাপের নিন্দা করছে। বৃদ্ধাকে দেখে বেনেনী জিজ্ঞাসা করে কে তুমি? তখন মা মনসা বললেন আমি ছোট বউয়ের মাসী, আমি ওকে নিতে এসেছি। তার ছোট বউকে চোখ বন্ধ করতে বলে তাকে রথে চাপিয়ে স্বর্গে গিয়ে হাজির হলেন।স্বর্গে পৌঁছে মা মনসা ছোট বউকে চোখ খুলতে বললে তখন সে তাকিয়ে দেখে তার হারানো সাপেরা সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখন মা মনসা বলে বাছা, আমি তোমার মাসি নই, আমি মনসাদেবী। তুমি রোজ আমার পুজা কর আর সাপ ভাইদের জন্য দুধ গরম করে রেখো। কিন্তু দক্ষিণদিকে যাবে এবং তাকিয়েও দেখবে না। ছোট বউ তাই করে ভক্তিভরে মা মনসার পুজো করে আর সাপ ভাইদের দুধ গরম করে খাওয়ায়। একদিন বনে এসে দক্ষিণদিকে তাকিয়ে দেখে মা মনসা নৃত্য করছেন। তাই দেখে সে অবাক হয়ে সেই দিকে তাকিয়ে রইল। এইভাবে তন্ময় হয়ে দেখতে দেখতে সে সাপেদের জন্য দুধ গরম করতে ভুলে গেল, পরে মনে পড়াতে তাড়াতাড়ি দুধ গরম করে তাদের খেতে দিলে, সেই দুধ খেয়ে সাপেদের মুখ পুড়ে গেল। তখন তারা মা মনসার কাছে নালিশ করলে ছোট বউ আমাদের মুখ পুড়িয়ে দিয়েছে আমরা ওকে কামড়ে দেব। তা শুনে মা মনসা বললেন এখানে এইসব হবেনা, আমি ওকে শ্বশুরবাড়ি রেখে আসছি সেখানে গিয়ে কামড়া।তারা ছোট বউয়ের গায়ে গা ভর্তি করে সবরকম গয়না পরিয়ে তাকে তার শ্বশুরবাড়ি রেখে আসল। বউয়ের গায়ে এত গয়না দেখে শাশুড়ি জায়েরা বলে এ আবার কি ঢং? তাই শুনে ছোট বউ বলে ” বেঁচে থাক আমার আড়োন,পাড়োন, ঢোঁড়া, বোড়া, পুঁয়ে, আরুল,পারুল, সব সাপ ভাইয়েরা।” ওরা থাকতে আমার গয়নার অভাব হয়? এইবার এক গা গয়না পড়ে এসেছি। পরের বার আরও এক গা গয়না পড়ে আসব। এই দিকে সেই অষ্টনাগ বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিল। বউয়ের কাছে তাদের প্রশংসা শুনে স্বর্গে গিয়ে, মনসাকে তা বলে ছোড়দি খুব ভাল, শ্বশুরবাড়িতে আমাদের খুব প্রশংসা করেছে, তাই আমাদের আর ওকে কামড়ান হল না। তাই শুনে মা মনসা আবার ছোট বউয়ের কাছে গিয়ে তাকে আরও এক গা গয়না পরিয়ে বলে- তুই আমার পূজো দেশের চারদিকে প্রচার করবি। দশহরার দিন, আষাঢ় মাসের সংক্রান্তিতে যথারীতি বাড়ির উঠানে মনসাগাছের ডাল পুঁতে পুজো করবি। সাপ ভাইদের দুধ কলা খেতে দিবি। আর ওদের প্রশংসা করবি। তাহলে আর সাপের ভয় থাকবে না। আষাঢ় মাসের সংক্রান্তিতে যে মনসা পুজো করে আর সাপেদের উদ্দেশ্যে ভোগ দেয় তাদের কোনকালে সাপের ভয় থাকে না।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

তথ্যসূত্র


  1. মেয়েদের ব্রতকথা- শ্রী অরুণ মজুমদার
  2. মেয়েদের ব্রতকথা- নির্মল কুমার সাহা

 

3 comments

আপনার মতামত জানান