হেমেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি

হেমেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি

ডায়েরিয়ার চিকিৎসায় প্রথম ভারতীয় বিজ্ঞানী হিসেবে ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশান বা ওআরএস-এর সফল প্রয়োগ করেন ডা. হেমেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি (Hemendranath-Chatterjee)। ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসে এই বিষয়ে তাঁর গবেষণাপত্রটি ‘ল্যান্সেট’ পত্রিকায় প্রকাশ পায়। ঐ গবেষণাপত্রেই তিনি প্রথম বলেন যে কলেরার সময় বমি আটকাতে অ্যাভোমিন ওষুধ ব্যবহার করা শ্রেয় এবং কলেরার প্রতিকারস্বরূপ ওআরএস ব্যবহারের কথা বলেন তিনি। ১৯৫৩ সালেই কলকাতার হাসপাতালে ১৮৬ জন কলেরা আক্রান্তের উপর এই ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশান প্রয়োগ করে সাফল্য পেয়েছিলেন তিনি। তিনিই প্রথম শিরার ভিতর স্যালাইন প্রবাহের পরিবর্তে এই বিশেষ পদ্ধতি আবিষ্কার করে সাড়া ফেলে দেন। ৪ গ্রাম সোডিয়াম ক্লোরাইড, ২৫ গ্রাম গ্লুকোজ আর ১ লিটার জলের মিশ্রিত দ্রবণ ‘ওআরএস’ (ORS) নামে পরিচিত আর এই উপাদান সমবায়ের ফর্মুলা আবিষ্কারের কৃতিত্বও ডা. হেমেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জির। তাঁর অনুসরণে জনৈক ইরাকের চিকিৎসক কায়েস-আল-অঊকাতি ১৯৬৬ সালে বাগদাদে দেখা দেওয়া ভয়ঙ্কর কলেরা মহামারীর প্রতিকার করেন। যদিও কলেরার চিকিৎসার ক্ষেত্রে উভয়ের পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত।

শিক্ষাগত ক্ষেত্রে হেমেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি এম.ডি, এম.এস ও বি.এ ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। পরবর্তীকালে কলকাতার চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের সংক্রামক ব্যাধি বিভাগে কর্মরত ছিলেন হেমেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি।

পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে কলকাতায় এক ভয়ঙ্কর মহামারী দেখা দেয়। ঠিক সেই সময়েই ১৯৫১ সালে একটি প্রবন্ধ লেখেন হেমেন্দ্রনাথ ‘রিডাকশন অফ কলেরা মর্টালিটি বাই দ্য কন্ট্রোল অফ বাওয়েল সিম্পটমস অ্যাণ্ড আদার কম্পলিকেশনস’ নামে। এই প্রবন্ধে তিনি তৎকালীন কলকাতার স্থানীয় মানুষদের ব্যবহৃত কিছু দেশীয় পদ্ধতির উল্লেখ করেন যা তিনি নিজেও পরীক্ষা করেছিলেন। কলেরায় মৃত্যুহার কমাতে হেমেন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন মূলত বমি আর ডায়েরিয়ার অবসান ঘটাতে। ১৯৫১ সাল নাগাদ বাংলার গ্রামে গ্রামে এই বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি লক্ষ করেন স্থানীয় মানুষেরা ‘পাথরচূড়’ গাছের পাতার রস প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহার করত ডায়েরিয়া এবং বমি হওয়া থেকে বাঁচতে। এই গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম ছিল কোলাস অ্যারোমেটিকাস। সেই সময় চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের পাশের বাগানে প্রচুর পরিমাণে এই গাছ পাওয়া যেত। হেমেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি কলেরায় আক্রান্তদের ক্ষেত্রে লক্ষ করেছেন যে এই বিশেষ পাতার রসের প্রয়োগে মৃত্যুহার ২০ শতাংশ থেকে কমে ৮.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। পরে টেরামাইসিনের সঙ্গে এই বিশেষ রস মিশিয়ে তিনি পরীক্ষা করেছিলেন কিন্তু তাতে বিশেষ ফল মেলেনি। আবার অন্য আরেকটি দেশীয় উদ্ভিদ যাকে বাংলায় ‘ক্ষীরাই’ বলা হয়, এর পাতার রসও প্রয়োগ করতে লক্ষ করেছিলেন হেমেন্দ্রনাথ। এই গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম ইউফরবিয়া পিলুইফেরা। দুটি ক্ষেত্রেই আট ঘন্টা অন্তর সেই গাছের পাতার রস রোগীকে তিন দিন পর্যন্ত খাওয়ালে ডায়েরিয়া এবং বমি কমে যেতে দেখেছিলেন রোগীদের। এই পর্যবেক্ষণের কথা হেমেন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এর কোন শারীরবৃত্তীয় স্পষ্ট ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি আর সেই কারণেই তাঁর এই বক্তব্য চিকিৎসক মহলে খুব বেশি আলোড়ন ফেলতে পারেনি। ১৯৫৩ সালে বিখ্যাত জনস্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক পত্রিকা ‘ল্যান্সেট’-এ তাঁর একটি প্রবন্ধ প্রকাশ পায় ‘কন্ট্রোল অফ ভমিটিং ইন কলেরা অ্যাণ্ড ওরাল রিপ্লেসমেন্ট অফ ফ্লুইড’ নামে। এই প্রবন্ধেই হেমেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি প্রথম ওআরএস ব্যবহার করে কলেরা নির্মূল করার কথা বলেন। ১৯৫৩ সালেই কলকাতার হাসপাতালে ১৮৬ জন কলেরা আক্রান্তের উপর এই ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশান প্রয়োগ করে সাফল্য পেয়েছিলেন তিনি।     

আপনার মতামত জানান