টিকা বা ভ্যাকসিন (vaccine) রোগ প্রতিরোধের জন্য অন্যতম সেরা উপায়। করোনা ভাইরাসের টিকা এখনও আমাদের হাতে না থাকায় সারা বিশ্বে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে এই ভাইরাস। আমরা অনেকেই টিকাকরণ এর বিষয়ে শুনেছি ইংরাজিতে যাকে vaccination বলে। শৈশবে বেশ কিছু রোগের প্রতিষেধক বা টিকা সকলেরই নেওয়া প্রয়োজন, পরবর্তীকালেও প্রয়োজন অনুসারে টিকা নেওয়া দরকার। আমরা সকলেই জানি টিকা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং যে রোগের প্রতিষেধক বা টিকা নেওয়া হয় সেই রোগ আর হয় না, কিন্তু রোগ প্রতিষেধক বা টিকা কাজ করে কিভাবে তা আমরা অনেকেই জানি না বা সামান্য কিছু জানলেও স্বচ্ছ কোন ধারনা নেই। এখানে আমরা টিকা কাজ করে কিভাবে সেই বিষয়ে আলোচনা করব।
টিকা বা প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন জৈব পদ্ধতিতে তৈরি করা জৈব-রাসায়নিক যৌগ বা মিশ্রণ যা দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি করার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি বাড়াতে সাহায্য করে। টিকা কি বোঝাতে গিয়ে আমাদেরকে ‘অ্যান্টিবডি’, ‘ইমিউনিটি’ শব্দগুলি ব্যবহার করতে হয়েছে আর এই বিষয়গুলি বুঝতে পারলেই টিকা কাজ করে কিভাবে সহজেই বোঝা যাবে। প্রথমেই আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম (immune system) ভাল করে বুঝতে হবে।
যখন কোন রোগ সৃষ্টিকারী জীবানু (ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া) দেহে প্রবেশ করে তখন দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেমে নিম্নলিখিত ঘটনাগুলি ঘটে –
- রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জীবানুটিকে বিদেশি বস্তু (শরীরের বাইরের বস্তু) হিসেবে চিহ্নিত করে যাকে অ্যান্টিজেন বলা হয়।
- রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দেহে এক ধরনের প্রোটিন তৈরি করে যাকে অ্যান্টিবডি বলে। অ্যান্টিবডি জীবানুগুলিকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে। তবে বেশির ভাগ সময় এই পদ্ধতি খুব দ্রুত কাজ করে না, বেশ কিছুটা সময় নেয় তাই আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। তবে কিছুদিন পর শরীর জীবাণুগুলিকে ধ্বংস করার মত বিপুল পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সমর্থ হয় ও আমাদেরকে পুনরায় সুস্থ করে তোলে।
- রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সেই বিশেষ জীবানু বা অ্যান্টিজেনটিকে কিভাবে নষ্ট করতে হয় তা মনে রাখে ও ভবিষ্যতে একই জীবানুর সংক্রমণ হলে খুব তাড়াতাড়ি অ্যান্টিবডি তৈরি করে অসুস্থ হওয়ার আগেই জীবানুগুলিকে নষ্ট করে ফেলে।
ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কিভাবে কাজ করে বুঝলে দেখা যায় যে কোনও বিশেষ জীবানুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে শেখাতে হবে সেই বিশেষ জীবানুর বিরুদ্ধে কিভাবে লড়তে হয়। একে ইমিউন সিস্টেমকে ট্রেনিং করানোও বলা যেতে পারে। তাহলে কি আমাদের একবার করে অসুস্থ হতেই হবে? না, সেই পদ্ধতিটাই টিকাকরণের মধ্য দিয়ে হয়। টিকা বা ভ্যাকসিন আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জীবানুর বিরুদ্ধে লড়ার পদ্ধতিটা শিখিয়ে দেয় অথচ আমরা অসুস্থও হই না (কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ কিছু উপসর্গ ছাড়া)। সাধারণত টিকা বা ভ্যাকসিন হল মৃত বা নিষ্ক্রিয় বা কম শক্তিশালী ভাইরাস বা জীবানু বা তাদের থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকারক প্রোটিন। টিকা দেওয়া হলে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা সাধারণ জীবানু সংক্রমণের মতোই কাজ করে অর্থাৎ
- টিকার জীবানুকে বিদেশি বস্তু বা অ্যান্টিজেন হিসেবে চিহ্নিত করে।
- সত্যিকারের জীবানু প্রবেশ করলে যেমন অ্যান্টিবডি তৈরি করে টিকার ক্ষেত্রেও সেই একই ভাবে অ্যান্টিবডি তৈরি করে।
- জীবানুগুলিকে কিভাবে ধ্বংস করতে হয় তা মনে রাখে। ফলে ভবিষ্যতে যখন সত্যি সত্যি সংক্রমণ ঘটে তখন দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা খুব দ্রুত অ্যান্টিবডি তৈরি করে জীবানুগুলিকে ধ্বংস করে ফেলে ও শরীর সুস্থ থাকে। এই ভাবেই টিকার মাধ্যমে দেহের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি পায়।
আমরা হয়ত অনেকেই মা-ঠাকুমার মুখে শুনেছি, গুটিবসন্ত (chicken pox) একবার হলে আর হয় না। তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতা দিয়ে জেনেছেন এই তথ্য, আর এখানে জানা গেল তার আসল কারণ কি। এক্ষেত্রে একবার চিকেনপক্স হলে তা আমাদের দেহের চিকেন পক্সের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে মজবুত করে তোলে। তবে হ্যাঁ, অনেক সময় ভাইরাসেরও বিভিন্ন রকম প্রজাতি (strain) থাকে তাই অন্য ধরণের স্ট্রেইনের পক্সের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থেকেই যায়। এরকমই এক ঘটনা থেকেই আসলে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছিলেন এডওয়ার্ড জেনার। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন গোয়ালাদের কম ক্ষতিকারক গোবসন্ত হলেও জীবন হানিকর স্মল পক্স হত না। আর সেই পর্যবেক্ষণ থেকে শিক্ষা নিয়েই তিনি স্মল পক্সের টিকা ১৭৯৮ সালে আবিষ্কার করেন। পরবর্তীকালে স্মল পক্স বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা গেছে।
বোঝার সুবিধার জন্য আমাদের খুব পরিচিত কিছু ভ্যাকসিন এর নাম দেওয়া হল – পোলিও টিকা পোলিও রোগের জন্য; রেবিস টিকা জলাতঙ্ক রোগের জন্য, সাধারণত কুকুরে কামড়ালে দেওয়া হয়; টিটেনাস ধনুষ্টঙ্কার রোগের জন্য, সাধারণত কেটে গেলে দেওয়া হয় যাকে চলতি ভাষায় অনেকেই টেটভ্যাক বলে থাকেন। এই সব ক্ষেত্রেই রোগাক্রান্ত হলে তার সুচিকিৎসা নেই। তাই প্রয়োজন টিকা নেওয়ার। টিকা কাজ করে কিভাবে জানা থাকলে টিকাকরণ সম্পর্কিত ভীতি ও ভ্রান্ত ধারণা কেটে যাবে এবং মানুষ সুস্থ ও দীর্ঘজীবন লাভ করবে।