যুদ্ধক্ষেত্রে মাইন-বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হয়ে কোনো চিকিৎসার অভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেই নিজের ক্ষতিগ্রস্ত পা খুখরী দিয়ে কেটে বাদ দিয়েছিলেন গোর্খা রাইফেলসের মেজর জেনারেল ইয়ান কার্ডোজো (Ian Cardozo)। ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমির ছাত্র হিসেবে তিনিই প্রথম একই বছরে সোনা ও রূপোর পদক অর্জন করেন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধে এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন ইয়ান। শারীরিকভাবে অক্ষম হয়েও কাঠের পা নিয়ে তিনি ব্রিগেড ও ব্যাটেলিয়নের নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৪ সালে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন ইয়ান কার্ডোজো এবং সেনাবাহিনী থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন ১৯৯৩ সালে। তিনিই প্রথম যুদ্ধাহত আর্মি অফিসার যিনি ব্যাটেলিয়ন ও ব্রিগেডকে নেতৃত্ব দেন। পাক যুদ্ধে সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সেনা পদক লাভ করেন তিনি। সম্প্রতি তাঁর জীবন অবলম্বনে ‘গোর্খা’ নামের একটি চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপন প্রকাশ পেয়েছে যেখানে অক্ষয় কুমার ইয়ান কার্ডোজোর চরিত্রে অভিনয় করবেন বলে জানা গেছে।
১৯৩৭ সালের ৭ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের বম্বে প্রেসিডেন্সিতে ইয়ান কার্ডোজোর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম ভিনসেন্ট কার্ডোজো এবং মায়ের নাম ডায়ানা। ছোটোবেলা থেকেই দেশের জন্য বড়ো কিছু করতে চাইতেন ইয়ান আর তার একমাত্র রাস্তা তাঁর জানা ছিল দেশের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া।
ফোর্টের সেন্ট জেভিয়ার্স হাই স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় এবং পরে বম্বের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণ করেন ইয়ান কার্ডোজো। তারপরে ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমি থেকে স্নাতক হন ইয়ান। ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতে তিনিই ছিলেন প্রথম ছাত্র যে একই বছরে সোনা ও রূপোর পদক অর্জন করে। সার্বিক ক্ষেত্রে সেরাকে সোনার পদক এবং সেরা নম্বর প্রাপককে রূপোর পদক দেওয়া হয়। ইয়ান কার্ডোজোই ছিলেন এই দুই পদক প্রাপক প্রথম ব্যক্তি। এরপরে তিনি যোগ দেন ইণ্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে যেখান থেকে ৫ নং গোর্খা রাইফেলসে নিযুক্ত হন ইয়ান। ক্রমে গোর্খা রাইফেলসের পঞ্চম রেজিমেন্টের ১ম ব্যাটেলিয়নের দায়িত্ব দিয়ে বদলি করা হয় এবং পরে তিনি এই রেজিমেন্টেরই চতুর্থ ও দ্বিতীয় ব্যাটেলিয়নেরও দায়িত্বে ছিলেন। গোর্খা রাইফেলসের মেজর জেনারেল পদে আসীন ইয়ান কার্ডোজোর সেনা-জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘটনা হল ১৯৬৫ সালে ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৬৫ সালের ইন্দো-পাক যুদ্ধে অংশ নেবার পরে ১৯৭১ সালে ভারত বনাম পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধে ব্যাটেলিয়নের সেকেণ্ড ইন কম্যাণ্ড পদে আসীন হন ইয়ান কার্ডোজো। এই যুদ্ধেই একটি পা বাদ চলে যায় ইয়ানের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম তখন শুরু হয়ে গেছে। পঞ্চম গোর্খা রাইফেলসের চতুর্থ ব্যাটেলিয়ন মেজর জেনারেল কার্ডোজোর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে ঘাঁটি গেড়েছে। জেনারেল কার্ডোজোর বদলি হয়েছিল তখন তামিলনাড়ুর ওয়েলিংটনে ডিফেন্স সার্ভিস স্টাফ কলেজে। ইতিমধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাটেলিয়নের সেকেণ্ড-ইন-কম্যাণ্ড নিহত হলে দ্রুত কার্ডোজোর বদলি বাতিল করে যুদ্ধক্ষেত্রে ডেকে পাঠানো হয় তাঁকে। এই যুদ্ধেই প্রথম ভারতীয় আর্মির হেলিকপ্টার অপারেশন দেখা যায়। মাত্র ৪৮০ জনের ব্যাটেলিয়ন নিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ৭০০০ সেনা এবং তিনটি ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যুদ্ধ করা ইতিহাসে এক অন্যতম নজির সৃষ্টি করেছে। এই সময়ে গোর্খা রেজিমেন্টের ব্যাটেলিয়নের সকলের কাছে ইয়ান ‘কার্তুজ সাহিব’ নামে পরিচিত হন। ব্যাটেলিয়নের সদস্যরা তাঁর নাম ঠিকমতো উচ্চারণ করতে না পারায় তাঁকে এই ডাকনাম দিয়েছিল। ইতিমধ্যে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর পতনের পরে ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন যুদ্ধবন্দীদের একত্র করছে, সেই সময় একজন বিএসএফ কমাণ্ডারকে সাহায্য করতে যাওয়ার সময়েই মেজর জেনারেল ইয়ান কার্ডোজো এক বিপজ্জনক দুর্ঘটনার মুখোমুখি হন তিনি। দুর্ভাগ্যবশত একটি গোপন ল্যাণ্ডমাইনে পা পড়ে যাওয়ায় এক বিপজ্জনক বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হন তিনি। তাঁর একটি পা সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। কিন্তু তক্ষুনি তার চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ ছিল না। বাংলাদেশি এক সৈনিক তাঁর এই অবস্থা দেখে তাঁকে উদ্ধার করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। কিন্তু ক্যাম্পেও ডাক্তার ছিল না কোনো। অন্যান্য সেনাদের কাছে মরফিন চান প্রথম ইয়ান কার্ডোজো। সেই মরফিনও না পেয়ে এবং কোনো প্রকার অস্ত্রোপচারের সুবিধে না থাকায় বাধ্য হয়ে নিজের খুখরী দিয়ে নিজেই সেই পা কেটে বাদ দিয়ে দেন দুঃসাহসী ইয়ান কার্ডোজো। প্রথমে তাঁর একজন সহকারীকে পা কেটে বাদ দিতে বললে তিনি অসম্মত হন। তাই নিজেকেই এই কাজ করতে হয়। পরে এক পাকিস্তানি আর্মি সার্জেন মেজর মহম্মদ বশীরকে ধরে নিয়ে আসে ভারতীয় সেনারা যিনি কার্ডোজোর অস্ত্রোপচার করেন। এই ঘটনার পরে সকলে ভেবেছিল যে ফিল্ড অফিসারের পদ থেকে তাঁকে হয়তো অবসর নিতে হবে বাধ্য হয়ে। কিন্তু মেজর কার্ডোজো এই যন্ত্রণা সহ্য করে পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে মনোনিবেশ করেন। কমাণ্ডারের পদে প্রবলভাবে যুদ্ধ করেন তিনি। এমনকি দুই পা থাকা অফিসারদের থেকেও বেশি সক্ষমতা প্রদর্শন করেন তিনি। শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষায় দুই পা যুক্ত অফিসারদেরকেও পিছনে ফেলে দেন ইয়ান কার্ডোজো। সেই ইয়ান কার্ডোজো যখন যুদ্ধাহত অবস্থায় কাঠের পা নিয়ে শুধু একটা ব্যাটেলিয়ন নয়, তার সঙ্গে একটি ব্রিগেডও নেতৃত্ব দেন, এই অভাবিত ইতিহাস তৈরি হয়। একটি ব্রিগেডে সাধারণত তিনটি থেকে ছয়টি ব্যাটেলিয়ন ও অন্যান্য সহায়ক দল থাকে। এই পূর্ণ ব্রিগেডকে শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত তৈরি করেন ইয়ান। মেডিকেল অফিসাররা তাঁকে শারীরিকভাবে অক্ষম প্রমাণ করলে তিনি মুখ্য আর্মি স্টাফ জেনারেল তাপীশ্বর রায়নার কাছে আবেদন করেন। ইয়ানের সহ্যশক্তি ও ধৈর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে জেনারেল তাঁকে নিজের সঙ্গে লাদাখে নিয়ে যেতে অনুমোদন দেন। একটি পা বাদ যাওয়ায় কাঠের পা পরতে হয় বাধ্য হয়েই আর এই কাঠের পা নিয়েই পাহাড়ের চড়াইতে বরফের মধ্যে হাঁটতে দেখে সেনাপ্রধান তাপীশ্বর নারায়ণ রায়না তাঁর পদোন্নতিতে অনুমোদন দেন। এরপরেই ১৯৮৪ সালে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন তিনি। সাধারণভাবে শারীরিকভাবে অক্ষম সেনাদের বাধ্যতামূলকভাবে অবসর নিতে হয়। কিন্তু অক্ষম হয়েও চূড়ান্ত রকমের সক্ষমতার প্রদর্শন করেছিলেন ইয়ান কার্ডোজো। সেনাপ্রধান রায়নার ব্যক্তিগত অনুমোদনে ইয়ান কার্ডোজো একটি ব্যাটেলিয়নকে নেতৃত্ব দেন। ১৯৯৩ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন তিনি।
অবসর গ্রহণের পরে ২০০৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ভারতীয় পুনর্বাসন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন ইয়ান কার্ডোজো। সাহসিকতার স্বীকৃতি স্বরূপ ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ‘অতি বিশিষ্ট সেবা পদক’ এবং ‘সেনা পদক’ লাভ করেন তিনি। তাছাড়া পুর্বী স্টার পদক, রক্ষা পদক, সংগ্রাম পদক, সমর সেবা পদক, সৈন্য সেবা পদক লাভ করেছেন তিনি।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাস ও গৌরব বিষয়ে বহু বই লিখেছেন তিনি। সেইসব বইগুলির মধ্যে ‘ভারতীয় সেনা কা গৌরবশালী ইতিহাস’, ‘ইণ্ডিয়া ইন ওয়ার্ল্ড ওয়ার ১ : অ্যান ইলাস্ট্রেটেড স্টোরি’, ‘পরম বীর : আওয়ার হিরোস ইন ব্যাটল’, ‘পরমবীর চক্র : মনোজ পাণ্ডে’, ‘দ্য ইণ্ডিয়ান আর্মি : আ ব্রিফ হিস্ট্রি’, ‘১৯৭১ – স্টোরিস অফ গ্রিট অ্যাণ্ড গ্লোরি ফ্রম দ্য ইন্দো-পাক ওয়ার’, ‘দ্য সিংকিং অফ আইএনএস খুখরি : সার্ভাইভারস স্টোরিস’, ‘ব্যাটল অফ রেজাং লা ইন ১৯৬২’, ‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল বিলমোরিয়া : হিজ লাইফ অ্যাণ্ড টাইমস’ ইত্যাদি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।
সম্প্রতি তাঁর জীবন অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার কথা উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমে। ‘গোর্খা’ নামক সেই চলচ্চিত্রে ইয়ান কার্ডোজোর চরিত্রে অক্ষয় কুমার অভিনয় করবেন বলে জানা গিয়েছে বিজ্ঞাপনে।
৮১ বছর বয়সে তিন পুত্র এবং স্ত্রী প্রিস্কিলা কার্ডোজোর সঙ্গে নিউ দিল্লিতে বাস করছেন প্রাক্তন মেজর জেনারেল ইয়ান কার্ডোজো। এখনও তিনি কাঠের কৃত্রিম পা নিয়েই ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নেন।
তথ্যসূত্র
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.thehindu.com/
- https://www.jagrantv.com/
- https://indianexpress.com/
- https://www.anandabazar.com/
- https://www.thebetterindia.com/
