বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস

৩ ডিসেম্বর ।। বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস

প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশেই কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। পালনীয় সেই সমস্ত দিবসগুলোর মধ্যে একটি হল বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস (International Day of Disabled Persons)।

প্রতি বছর ৩ ডিসেম্বর তারিখে সারা বিশ্ব জুড়ে ‘বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস’ পালিত হয়। প্রতিবন্ধী মানুষদের সামাজিক মর্যাদা, অধিকার এবং জীবনের কল্যাণের জন্য নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে তুলতে বছরের এই বিশেষ দিনটি পালিত হয়ে থাকে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে আরো বেশিমাত্রায় প্রতিবন্ধীদের প্রত্যক্ষে নিয়ে আসার জন্য এই দিনটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। প্রতি বছর নতুন নতুন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে, উদ্দেশ্য নিয়ে এই দিনটি উদ্‌যাপিত হয়।

সাধারণত অক্ষমতা হল এমন একটি অবস্থা যার ভিত্তিতে কোনো গোষ্ঠীর এক ব্যক্তিকে প্রতিবন্ধী হিসেবে পৃথক করা যায়। এই অক্ষমতা বা disability বলতে মূলত শারীরিক প্রতিবন্ধকতা অথবা সংবেদনশীল বৈকল্যকে বোঝায়, তাছাড়াও মানসিক সমস্যা কিংবা জ্ঞান আহরণের অক্ষমতাও (Cognitive Impairment) এর মধ্যে পড়ে। প্রতিবন্ধীদের ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংখ্যালঘু’ বলা হয়ে থাকে। সারা বিশ্বের জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মানুষই কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী। ১৯৯২ সালে প্রথম রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে এই দিনটি সারা বিশ্বে পালিত হয়। এর আগে রাষ্ট্রসংঘ ১৯৮১-র সমগ্র বছরটিকে ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী বছর’ (International Year for Disabled Persons) হিসেবে ঘোষণা করেছিল। সুযোগের সাম্য, পুনর্বাসন প্রকল্প এবং প্রতিবন্ধী-সমস্যা নির্মূলীকরণের লক্ষ্যে এই ঘোষণা করা হয়েছিল। এই উদ্‌যাপনের ফলশ্রুতি হিসেবে ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে বিশ্বব্যাপী নানা কর্মসূচি পরিকল্পনা করে যা প্রতিবন্ধীদের অধিকার সম্পর্কিত কনভেনশন তৈরির প্রথম ধাপ ছিল। মূলত এর পরেই পাকাপাকিভাবে ‘প্রতিবন্ধী অধিকার’ (Rights for Disabled Persons) তৈরি হয়। এই কনভেনশন অনুযায়ী মানুষের শরীরে ও মনে আসা যে কোনো রকম প্রতিবন্ধকতাই অক্ষমতার উপাদান হতে পারে। কনভেনশন এও বলে যে অক্ষমতা (Disability) মানুষকে স্বাভাবিকভাবে সমাজে অন্যান্যদের সঙ্গে অংশগ্রহণে মনোভাব ও পরিবেশজনিত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। সমাজে প্রতিবন্ধীদের প্রাধান্য এবং অন্তর্ভুক্তি তাদের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। এ প্রসঙ্গেই উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল রাষ্ট্রসংঘ ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এক দশক অর্থাৎ দীর্ঘ দশ বছরকে ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দশক’ বলে চিহ্নিত করে। রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভায় তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাবিভাগের সহকারী সম্পাদক ড. রবার্ট আর ড্যাভিলার উপযুক্ত বক্তব্য পরিবেশনের মধ্য দিয়ে এই দশকের সমাপ্তি ঘটে। প্রধানত প্রতিবন্ধীদের জন্য যে কর্মসুচি নেওয়া হয়েছিল, সরকার এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলির পক্ষ থেকে তা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে অনেকটা সময় প্রয়োজন ছিল যা এই দশকজুড়ে চলতে থাকে। এরপর থেকেই অর্থাৎ ১৯৯২ সাল থেকে ৩ ডিসেম্বর তারিখটিতে প্রতি বছর ‘বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। যদিও এই আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী বছর পালনের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন একজন তরুণ ব্রিটিশ গায়ক-গীতিকার আয়ান ডুরি (Ian Dury)। ১৯৮১ সালে ‘স্প্যাস্টিকাস অটিস্টিকাস’ (Spasticus Autisticus) নামে একটি গান লেখেন যেখানে এই উদ্‌যাপনকে অত্যন্ত অসংবেদনশীল বলে দাবি করেন তিনি। আয়ান ডুরি নিজেই একজন প্রতিবন্ধী ছিলেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

বর্তমানে বিশ্বের সর্বত্রই এই বিশেষ দিনটিতে নানাবিধ কল্যাণমূলক কর্মসূচি নেওয়া হয়। ভারতে ২০১৯ সালে উপরাষ্ট্রপতি ভেঙ্কাইয়া নাইডু এই দিনটির নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেন যে বহু গুণী মানুষ প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের দরবারে তাঁদের কৃতিত্বের প্রদর্শন করেছে, বিশ্ব তাঁদের অমর করে রেখেছে। তাই এই দিনটির নাম ‘বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস’-এর বদলে হওয়া উচিত ‘বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস’। তিনি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন যে, ২০১১ সালের জনগণনায় দেখা যাচ্ছে প্রায় ২.৬৮ কোটি অক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ আছেন ভারতে এবং এদের মধ্যে বেশিরভাগই রাস্তার দূর্ঘটনায় প্রতিবন্ধী হয়েছেন। তাই তিনি রাস্তার নিরাপত্তার দিকটিও গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখতে বলেছেন। বাংলাদেশেও ২০১৪ সালে বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস উদ্‌যাপনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সর্বক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমানাধিকার ও সমান সুযোগ দেওয়া কাম্য বলেছেন এবং তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করার সুফল দেখিয়েছেন। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে প্রতিবন্ধীদের জন্য বাধ্যতামূলক কর্মসংস্থানের ঘোষণা করে। প্রতিবন্ধী মানুষদের কাজ দেবার মাধ্যমে দেশের কল্যাণে তাদের অঙ্গীভূত করে নিতে বলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ঐ বছরই ভারত সরকার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের কল্যাণার্থে একটি প্রকল্প চালু করে রাষ্ট্রসংঘের কনভেনশনের ৯ নং আর্টিকেলের অনুসরণে। এই প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয় ‘Accesible India Campaign’। 

১৯৯২ সাল থেকে রাষ্ট্রসংঘ কর্তৃক এই দিনটিতে নতুন নতুন থিম ঘোষণা করা হয়। তবে ১৯৮১ সালের প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী বছর উদযাপনের থিম ছিল – ‘স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং সাম্য’ ( Full Participation & equality)। এরপর ১৯৯৮ সাল থেকে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন থিম নিয়ে এই বিশেষ দিনটি পালিত হয়েছে। ১৯৯৮ সালের থিম ছিল – ‘শিল্প, সংস্কৃতি এবং স্বাধীন জীবন’ (Arts, Culture and Independent living)। ২০১৬ সালের থিম ছিল – ‘আকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য ১৭টি লক্ষ্যপূরণ’ (Achieving 17 goals for the future we want)। ২০১৭ সালের থিম ‘সকলের জন্য পরিবর্তন, একটি স্থিতিশীল এবং সহনশীল সমাজের লক্ষ্যে’ (Transformation toward sustainable and resilient society for all)। ২০১৮ সালে থিম ছিল ‘প্রতিবন্ধীদের ক্ষমতায়ন, সামাজিক সাম্য এবং অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতকরণ’ (Empowering persons with disabilities and ensuring inclusiveness and equality)। ২০১৯ সালের থিম ছিল ‘প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণে সহায়তা – ২০৩০-এর উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে প্রতিবন্ধীদের নেতৃত্বদান’ (Promoting the participation of persons with disabilities and their leadership: taking action on the  2030 Development Agenda)। ২০২০ সালের থিম ‘সুস্থ সুন্দর পুনর্গঠন : কোভিড-পরবর্তী প্রতিবন্ধকতাযুক্ত সহনশীল এক পৃথিবীর লক্ষ্যে’ (Building Back Better : toward a disability-inclusive, accessible and sustainable post COVID-19 World)। 

One comment

আপনার মতামত জানান