ছোট থেকেই আমরা শুনে আসছি খাজা মানে পুরী আর রসগোল্লা মানে বাংলা। বেশ কিছুদিন হল ওড়িশার দাবী যে রসগোল্লার আবিষ্কার প্রথম তাদের রাজ্যেই হয়, তাও আবার জগন্নাথের জন্য। জেনে নেওয়া যাক এই রসগোল্লা কার।
১৮৬৪ সালে কোলকাতার চিৎপুরে মিষ্টির দোকান করেন বিখ্যাত ময়রা নবীনচন্দ্র দাস। চার বছরের চেষ্টার পর ১৮৬৮ সালে বিশ্বের প্রথম রসগোল্লা তৈরি করেন তিনি।এমনকি চৈতন্য চরিতামৃততেও রসগোল্লার উল্লেখ আছে বলে শোনা যায়।
ওদিকে ওড়িশার বক্তব্য হল- রথযাত্রা শেষে মন্দিরে ফেরার পর স্ত্রীয়ের মান ভাঙাতে এই রসগোল্লারই শরণাপন্ন হন জগন্নাথ। পুরীর মন্দিরে বছরের এই একটি দিনই বাইরে তৈরি ভোগ ভিতরে ঢোকে। রীতিমাফিক এ দিন সকাল থেকেই রসগোল্লার ছড়াছড়ি তাঁর রথ নন্দীঘোষে। লক্ষ্মীর সেবায়েতদের বাধা টপকে বহু কষ্টে জগন্নাথদেব কে ঢুকতে হবে ভিতরে। বোন সুভদ্রা ও দাদা বলভদ্রের পরে জগন্নাথ ঢুকতে গেলেই সিংহদুয়ার আটকে রুখে দাঁড়ান মা-লক্ষ্মীর প্রতিনিধিরা। আগে দেবদাসীরা দরজা আটকাতেন। এখন পরম্পরা মেনে মন্দিরের সেবায়েতদের একাংশই লক্ষ্মীর হয়ে ঝগড়া করেন! কেন স্ত্রীকে ফেলে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন মহাপ্রভু! জগন্নাথের প্রতিনিধি মুখ্য দয়িতাপতি তাদের বোঝান, ভাশুরঠাকুর বলরাম যেখানে রয়েছেন, সেখানে মা-লক্ষ্মীর যাওয়াটা কী করে শোভা পায়! লক্ষ্মীর দলের পাল্টা যুক্তি, বোন সুভদ্রা সঙ্গে যেতে পারলে মা-লক্ষ্মীর যেতেই বা কী অসুবিধে ছিল?
রীতিমাফিক এই তর্কে হার হয় জগন্নাথের প্রতিনিধিরই। স্বয়ং মহাপ্রভু মন্দিরে ঢুকতে না-পেরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন বলে এক সময়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারেন না মুখ্য দয়িতাপতি। পরের বার এমন ভুল আর করবেন না-বলে স্বামীর তরফে আশ্বাস পেয়ে তবে মন গলে লক্ষ্মী ঠাকরুণের। মন্দিরের রত্নভাণ্ডারের কাছে লক্ষ্মী-নারায়ণের পুষ্পাঞ্জলি পুজোর পরেই রসগোল্লা-ভোগ স্ত্রীকে অর্পণ করেন জগন্নাথ।
প্রতিবছর উল্টোরথের আগের দিন গোটা ওডিশায় পালিত হয় ‘রসগোল্লা দিবস’।ওড়িশার বিশেষজ্ঞদের দাবি, জগন্নাথধামে ক্ষীরমোহন নামে এক ধরনের মিষ্টিই রসগোল্লার পূর্বপুরুষ। ওড়িশার রসগোল্লা স্বাদে বাংলার থেকে খানিকটা মিষ্টি, কিছুটা ঘিয়ে-রঙা ও শক্ত। ওড়িশার দাবি, সে-রসগোল্লাই পরে বাংলায় ঢুকেছে।
এতকিছু থাকতে রসগোল্লা কেন? এসবই হল গিয়ে জি.আই রেজিস্ট্রেশন এর জন্য। জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন বা জিআই রেজিস্ট্রেশনের অর্থ হল, কোনও একটি বিশেষ পণ্যের ওপর কোনও অঞ্চলের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া। জিআই রেজিস্ট্রেশন তখনই দেওয়া হয়, যখন প্রমাণিত হয় যে সেই নির্দিষ্ট পণ্যটি কোনও একটি বিশেষ অঞ্চলেই আবিষ্কৃত হয়েছে বা তৈরি হয়, এবং তা তৈরি করার সময় কিছু সনাতন পদ্ধতি মেনে চলা হয়, তার একটি নির্দিষ্ট গুণমান আছে।
সম্প্রতি রসগোল্লা নিয়ে বঙ্গ ও কলিঙ্গের এই যুদ্ধে রসগোল্লা আবিষ্কারের কৃতিত্ব বাংলারই থেকেছে। সরকারি ভাবে জিআই কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: রসগোল্লার বয়স খুব বেশি হলে ১৫০ বছর। বাগবাজারের নবীন দাশ বা ফুলিয়ার হারাধন ময়রাদের হাতে তার শ্রীবৃদ্ধি। তা ছাড়া, মধ্য যুগে দুধ ছিন্ন করে সৃষ্ট ছানা দেবতার নৈবেদ্যর উপযোগী নয় বলেই ধরা হতো। ছানা থেকে খাদ্যসামগ্রী তৈরির কৌশল সপ্তদশ শতকে বাংলাকে শেখায় পর্তুগিজরা। পরে ছানা দিয়ে মিষ্টি সৃষ্টির কারিকুরি একান্তই বাংলার। বাংলার রসগোল্লার বৈশিষ্ট্য হিসেবে, নিখাদ গরুর দুধের ছানা ও চিনির রসের উপাদানের কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
তথ্যসূত্র
- http://www.anandabazar.com/state/west-bengal-and-odisha-engaged-in-rasogolla-war
- https://ebela.in/state/hearing-on-rasogolla-s-ownership-is-starting-today-dgtl-1.461737
- http://www.benarnews.org/bengali/news/Ind-sweet-09242015104841.html
- https://www.anandabazar.com/state/rejecting-odisha-s-claim-gi-declared-that-rosogolla-belongs-to-bengal-1.707454
- https://www.bbc.com/bengali/news-41980819
One comment