খনা

মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম খ্যাতনামা একজন কবি ও জ্যোতির্বিদ ছিলেন খনা (Khana)। খনা ছিলেন জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী এক বিদুষী নারী যিনি বচন রচনার জন্যেই বেশি সমাদৃত। রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের নবরত্ন সভার এক রত্ন প্রখ্যাত গণিতবিদ তথা জ্যোতির্বিজ্ঞানী বরাহমিহিরের পুত্রবধূ ছিলেন খনা তিনি। খনা নাম শুনলেই দুটি কথা সহজেই মাথায় আসে – খনার বচন আর খনার জিভ কাটার বেদনা। প্রচলিত মত অনুসারে খনার জ্ঞানের পরিধি এতটাই বিস্তার লাভ করেছিল যে ঈর্ষান্বিত হয়ে তার জিভ কেটে দেওয়া হয়েছিল এবং তাতেই মৃত্যু হয় তাঁর।

অনুমান করা হয় খনার জন্মকাল ৮০০ থেকে ১১০০ সাল। যদি বরাহ খনার শ্বশুর হন তবে খনার আরও কয়েক শতক আগে জন্ম হওয়া উচিত। খনার বচনগুলির ভাষা, আঙ্গিক ও বাক্য গঠনের রীতি দেখে ভাষা বিশেষজ্ঞদের মতামত বচনগুলির প্রাচীনত্ব চারশত বছরের বেশি হবে না। এটা ধরে নিলে খনার জীবনকাল ৮০০-১১০০ এর থেকে আরও কয়েক শতক পরে হওয়ার কথা।তবে এটা সম্ভব যে বচনগুলির ভাষা কালের নিয়মে পরিবর্তিত ও পুনর্লিখিত হয়েছে কারন সেগুলি শ্রুতি রূপেই প্রচলিত ছিল।কথিত আছে খনার আসল নাম লীলাবতী। মূলতঃ খনার করা ভবিষ্যতবাণীগুলোই ‘খনার বচন’ নামে বহুল পরিচিত কিংবদন্তি অনুসারে তিনি বাস করতেন পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসাত মহকুমার বেড়াচাঁপার দেউলিয়া গ্রামে (বর্তমান চন্দ্রকেতুগড় প্রত্নস্থল, যেটি খনামিহিরের ঢিবি নামে পরিচিত)। খনার পিতার নাম অনাচার্য। অন্য একটি কিংবদন্তি অনুসারে, তিনি ছিলেন সিংহলরাজের কন্যা। রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজ সভার প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহের ছেলে মিহিরকে খনার স্বামীরূপে পাওয়া যায়। কথিত আছে বরাহ তাঁর পুত্রের জন্ম কোষ্ঠি গণনা করে পুত্রের আয়ু এক বছর দেখতে পেয়ে শিশু পুত্র মিহিরকে একটি পাত্রে করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেন। পাত্রটি ভাসতে ভাসতে সিংহল দ্বীপে পৌছলে সিংহলরাজ শিশুটিকে লালন পালন করেন এবং পরে কন্যা খনার সাথে তাঁর বিয়ে দেন।

খনা এবং মিহির দুজনেই জ্যোতিষশাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। মিহির একসময় বিক্রমাদিত্যের সভাসদ হন। একদিন পিতা বরাহ এবং পুত্র মিহির আকাশের তারা গণনায় সমস্যায় পড়লে, খনা এ সমস্যার সমাধান দিয়ে রাজা বিক্রমাদিত্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গণনা করে খনার দেওয়া পূর্বাভাস রাজ্যের কৃষকরা উপকৃত হতো বলে রাজা বিক্রমাদিত্য খনাকে দশম রত্ন হিসেবে আখ্যা দেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

বরাহ ছিলেন রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভার রাজ জ্যোতিষি নবরত্নের এক রত্ন। তিনি গননা করে জানতে পারেন তাঁর পুত্র এক বছর বয়সে মারা যাবে। তাই পুত্র জন্মের পর তাঁর স্ত্রী যখন মারা যান তিনি তাঁর পুত্র মিহিরকে তামার পাত্রে বিদ্যাবতী নদীতে দৈববশে প্রান রক্ষার জন্য ভাসিয়ে দেন। পুত্র ভাসতে ভাসতে সিংহল দ্বীপে পৌঁছায় এবং সিংহল রাজ তাকে লালন পালন করেন। লীলাবতী ও মিহির এক সাথে বড় হতে থাকে। দুজনেই জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠে। পরবর্তী কালে দুজনের বিবাহ সম্পন্ন হয়। নিজের পিতার খোঁজে পরে মিহির ও খনা বরাহের কাছে ফিরে আসে।

দিন দিন রাজসভায় খনার প্রতিপত্তি বেড়েই চলেছিল। নানা দেশের অনেক মানুষের সঙ্গে তাঁর আলাপ আলোচনা হত। রাজসভায় খনাকে যেতে বারণ করলেও লাভ হতনা। কারণ গণনায় কোনও সমস্যা হলে রাজা বিক্রমাদিত্যই লোক পাঠিয়ে ডেকে আনতেন খনাকে। মিহির ও বরাহের তুলনায় খনার গ্রহণযোগ্যতা রাজা স্বয়ং এবং সাধারণ প্রজার কাছে অনেক বেশি ছিল। খনার বচন বাংলা সাহিত্যের আদি কীর্তির মধ্যে পড়ে। তাঁর বচন সাহিত্যের সিংহভাগ জুড়ে চাষাবাদের তত্ত্বকথা। জ্যোতিষশাস্ত্রে গভীরজ্ঞানী তো ছিলেনই, অধিকন্তু আবহাওয়াদর্শন ও কৃষিবিদ্যারও নানা রহস্য মোচন হত তাঁর বচনে বচনে। এই আধুনিক যুগেও তার অনেক বচনই সত্য থেকে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে –

১} সরিষা বনে কলাই মুগ/ বুনে বেড়াও চাপড়ে বুক ।।

(একই জমিতে যদি সরিষা ও মুগ বা সরিষা ও কলাই একসাথে বোনা যায় তাহলে দুটি ফসলই একসাথে পাওয়া যায়।)

২) বাপ বেটাই চাই/ তদ অভাবে ছোট ভাই ।।

(যে কৃষক পরের সাহায্যে চাষ করে তার আশা বৃথা । বাপ-ছেলে কাজ করলে সবচেয়ে ভাল ফসল ফলানো যায় তা না হলে সহোদর ভাইকে নিলেও ঠিকমত কাজ করবে । অন্যরা ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করবে ।)

৩) ষোল চাষে মুলা/তার অর্ধেক তুলা/তার অর্ধেক ধান/বিনা চাষে পান ।।

(ষোলো দিন চাষ করার পর সেই জমিতে মূলা চাষ করলে ভাল জাতের ফলন পাওয়া যায় । তুলা লাগানোর জমিতে আট দিন চাষ করতে হবে , ধানের জমিতে চার দিন চাষ করে ধান লাগালে ভাল ফলন পাওয়া যায়। পানের জমিতে চাষের প্রয়োজন হয় না ।)

৪) কলা রুয়ে না কেটো পাত/ তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত ।।

(কলাগাছের ফলন শেষে গাছের গোড়া যেন না কাটে কৃষক, কেননা তাতেই সারা বছর ভাত-কাপড় জুটবে তাদের।)

৫) যদি বর্ষে আগুনে/রাজা যায় মাগনে ।।

(আগুনে অর্থাৎ অঘ্রাণে, আর, মাগুনে মানে ভিক্ষাবৃত্তির কথা বোঝাতে ব্যবহৃত, অর্থাৎ যদি অঘ্রাণে বৃষ্টিপাত হয়, তো, রাজারও ভিক্ষাবৃত্তির দশা, আকাল অবস্থায় পতিত হওয়াকে বোঝায়।)

পুত্রবধূর জ্যোতিষচর্চার নৈপুণ্যে একসময় সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন দেশবরেণ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী বরাহমিহির। বরাহের অঙ্গগণনা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের চেয়েও ঢের নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী ফলে উঠছিল খনার জ্যোতিষবিচারে। যে ভবিষ্যদ্বাণী খনা কবিতা আকারে বলে যেতেন মুখে মুখে। বরাহ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজ সভার নবরত্নের এক রত্ন ছিলেন। সেই সভায় খনারও ডাক পরে এবং দশমরত্নে ভূষিত হয় খনা। খনা এবং মিহির দু’জনেই জ্যোতিষশাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। মিহির একসময় বিক্রমাদিত্যের সভাসদ হন। একদিন পিতা বরাহ এবং পুত্র মিহির আকাশের তারা গণনায় সমস্যায় পড়লে, খনা এ সমস্যার সমাধান দিয়ে রাজা বিক্রমাদিত্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গণনা করে খনার দেওয়া পূর্বাভাসে রাজ্যের কৃষকরা উপকৃত হত বলে রাজা বিক্রমাদিত্য খনাকে দশম রত্ন হিসেবে আখ্যা দেন।

রাজসভায় প্রতিপত্তি হারানোর ভয়ে প্রতিহিংসায় বরাহের আদেশে মিহির লীলাবতীর জিভ কেটে দেন। এর কিছুকাল পরে খনার মৃত্যু হয়। তবে আমৃত্যু লীলাবতী সত্যের প্রতীক হয়ে ছিলেন। তিনি এমন ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, যা হুবহু ফলে যেত। বাঙালি লোকসংস্কৃতিতে এখনো অমৃতবাণীর মতো খনার বচনের প্রচলন রয়েছে।

আপনার মতামত জানান