সববাংলায়

কুরু ।। যে রোগে হাসতে হাসতে মৃত্যু হয়

বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি। সত্যিই বিশাল এই পৃথিবীর কোনায় কোনায় কত যে বিস্ময় লুকিয়ে রয়েছে তার কটা খবর আমরা রাখি ! পৃথিবীর খবর তো অনেক দূরের ব্যাপার, আমাদের শরীরের মধ্যেই কত যে বিস্ময় লুকিয়ে রয়েছে তা আমরা ধারণাও করতে পারি না । আজ সেরকমই বিচিত্র কিন্তু ভয়ঙ্কর এক রোগের কথা বলব যার কথা তথাকথিত সভ্য সমাজ জানে না বললেই চলে।  ভয়ঙ্কর এই মারণ ব্যাধির নাম কুরু (kuru)। এটি মূলত মস্তিস্কের একটি রোগ। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল এই রোগটির উপসর্গ।  এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি একবার হাসি শুরু করলে আর থামতে পারে না।  দমফাটা হাসির সাথে রোজ একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। এই কারণে কুরুকে ‘লাফিং সিকনেসও বলা হয়ে থাকে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় কুরু হল ট্রান্সমিসিবল স্পঞ্জিফর্ম এনসেফালোপ্যাথি (transmissible spongiform encephalopathy)  (TSE) এর একটি রূপ যা অস্বাভাবিক আকৃতির ভাঁজযুক্ত প্রায়ন (prion) প্রোটিনের সংক্রমনের কারণে সৃষ্টি হয়। এই রোগে স্নায়ুতন্ত্র সরাসরি আক্রান্ত হয় যার ফলস্বরূপ আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে এমনই শারীরবৃত্তীয় এবং স্নায়বিক জটিলতা সৃষ্টি হয় যে আক্রান্ত ব্যক্তি  ক্রমে  মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। সেরিবেলার অ্যাটাক্সিয়া বা পেশির নড়াচড়ার উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাওয়া এই রোগের একটি মূল লক্ষণ। এছাড়াও প্রচন্ড শারীরিক কম্পনের ফলে শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাথে মস্তিষ্কের সমন্বয়ও শিথিল হয়ে পড়ে। এমনকি এই রোগের তৃতীয় পর্যায়ে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিহীনতার লক্ষণ দেখা যায়, আচরণে অদ্ভুত পরিবর্তন আসে, কথা বলারও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন আক্রান্ত ব্যক্তি। খাদ্য গলাধঃকরণে অসুবিধার কারণে অনাহার এবং তা থেকে অপুষ্টিরও শিকার হতে হয় কুরু রুগীকে। কিছু ক্ষেত্রে এর সাথে যোগ হয় অনিয়ন্ত্রিত দমফাটা  হাসি। 

আরও পড়ুন:  মাকড়শা নিজের জালে আটকায় না কেন

১৯৩০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষই জানত না যে পাপুয়া নিউ গিনির উচ্চভূমিতে কোন জনজাতির বসবাস আছে। অস্ট্রেলিয়ার সোনা অনুসন্ধানকারীদের একটি দল  এলাকাটি জরিপ করার সময়  বুঝতে পেরেছিলেন যে সেখানে প্রায় দশ লক্ষ মানুষের বসবাস। ১৯৫০-এর দশকে গবেষকরা সেই গ্রামে আশ্চর্য একটি বিষয় লক্ষ করেন যে ফোরে (Fore) নামের একটি উপজাতিদের মধ্যে প্রতি বছর প্রায় দু’শো জনের মৃত্যু হচ্ছে এক অজানা রোগে৷ স্থানীয় মানুষরাই এই অজানা রোগটির নাম দেয় ‘কুরু’, যার অর্থ কম্পন। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে এই রোগ মহামারীর আকার ধারণ করে। এই রোগে আক্রান্ত হলে  আক্রান্ত ব্যক্তির প্রথমে  হাঁটার সমস্যা হত, তারপর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলত সে, এমনকি অনিয়ন্ত্রিত হাসিও ছিল এর অন্যতম  লক্ষণ। গবেষকরা লক্ষ করেন প্রাথমিকভাবে প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা এবং ৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যেই কুরু রোগের প্রকোপ বেশি।

অবশেষে নিউইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটির একজন মেডিকেল নৃবিজ্ঞানী শার্লি লিন্ডেনবাউম এবং অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসা গবেষক মাইকেল অ্যালপারস এই কুরু রোগের কারণ অনুসন্ধান শুরু করেন। তাঁরা একের পর এক গ্রাম ঘুরতে থাকেন এই রোগের উৎস সন্ধানে।  অবশেষে তাঁরা চূড়ান্ত যে  সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন তা হল, এই কুরু রোগের সঙ্গে ফোরে উপজাতির নরমাংস ভক্ষণের আচার-অনুষ্ঠান ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কোনো মৃত ব্যক্তির, মূলত মস্তিস্কটিকে রান্না করে খাওয়ার একটি রীতি প্রচলিত আছে ফোরেদের মধ্যে। মৃতদেহকে কবর দিলে তা পোকামাকড়ে ভক্ষণ করে, তার বদলে মৃতকে যারা ভালোবাসে তারা যদি অন্ত্যেষ্টির সময় সেই মৃতদেহ ভক্ষণ করে তবে মৃত ব্যক্তির আত্মা রয়ে যায় জীবিতদের মধ্যে, এইরকম একটি বিশ্বাস প্রচলিত ছিল ফোরে উপজাতির মধ্যে। মূলত প্রাপ্তবয়স্ক মহিলারা এইরকম অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন কারণ তাদের শরীরই নাকি বিপজ্জনক আত্মাকে আশ্রয়  দান এবং নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। সেই কারণে মহিলারা মৃতের মস্তিষ্ক বের করে ফার্নের সঙ্গে মিশিয়ে রান্না করে খেত। কেবল পিত্তথলি ছাড়া সবই খেত তারা। সেই খাদ্য কখনও কখনও মহিলারা বাচ্চাদেরকেও খাওয়াতো। পুরুষরা মূলত খেত মৃতের মাংস কিন্তু মহিলারা খেতেন মৃতের মস্তিষ্কের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি, যেখানে প্রায়ন প্রোটিনের কণাগুলি বিশেষভাবে ঘনীভূত থাকে। যেহেতু মস্তিষ্ক সংক্রামক প্রায়নে সমৃদ্ধ, তাই মৃতের মস্তিষ্ক ভক্ষণকারী মহিলা এবং শিশুদের মধ্যেই কুরু রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা গিয়েছিল। অথচ ফোরে উপজাতির মানুষেরা বিশ্বাস করতেন এই রোগটির  নেপথ্যে কোনো অলৌকিক কালাজাদুর হাত আছে, কারণ কুরুতে আক্রান্ত মানুষ কম্পনের সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত আচরণও করত।

আরও পড়ুন:  টার্ডিগ্রেড

যখন কুরু রোগ একটি মহামারীর আকার নেয় তখন ড্যানিয়েল কার্লটন গাজদুসেক (Daniel Carleton Gajdusek) নামে একজন ভাইরোলজিস্ট এবং ভিনসেন্ট জিগাস নামে এক চিকিৎসক এই রোগের ওপর গবেষণা শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে গাজদুসেক এবং জিগাস একটি প্রতিবেদনে জানান যে  কুরুর একটি জেনেটিক উৎস রয়েছে। কুরু রোগের কারণ বোঝার জন্য গাজদুসেক ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (এনআইএইচ)-এ শিম্পাঞ্জিদের উপর প্রথম একটি পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। মাইকেল অ্যালপারস গাজদুসেককে এগারো বছর বয়সী একটি কুরু আক্রান্ত মৃত মেয়ের মস্তিষ্কের টিস্যুর নমুনা এনে দেন। গাজদুসেক সেই টিস্যু শিম্পাঞ্জির মধ্যে ইনজেক্ট করান এবং কিছুদিন পরে সেই শিম্পাঞ্জিটি কুরু রোগে আক্রান্ত হয়। এই আবিষ্কারকে মানব চিকিৎসায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসাবে বিবেচনা করা হয় যার ফলে ১৯৭৬ সালে গাজদুসেককে ফিজিওলজি অর মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী মোটামুটি ২০১০ সাল থেকে কুরু রোগে আর কোনো মৃত্যু হয়নি বলেই জানা গেছে। 

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

চৈতন্যদেবের অসামান্য জীবনী দেখুন

চৈতন্য জীবনী

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন