জগন্নাথধামের পৌরাণিক কাহিনী

জগন্নাথধামের পৌরাণিক কাহিনী

জগন্নাথধাম হল হিন্দুধর্মের চারধামের অন্যতম একটি ধাম। অন্য তিনটি ধাম হল বদরিনাথ, রামেশ্বরম ও দ্বারকা। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী শ্রীবিষ্ণু রামেশ্বরমে স্নান করে বদরিনাথে ধ্যান করেন, তারপর পুরীর জগন্নাথধামে খাবার খেয়ে দ্বারকায় বিশ্রাম করেন। পুরীর জগ্ননাথধামই ভারতের একমাত্র মন্দির যেখানে মূর্তিগুলি কিছু বছর পর বদলে ফেলে নতুন মূর্তি তৈরি করা হয়। আসুন, এই সুযোগে জগন্নাথধামের পৌরাণিক কাহিনী জেনে নেওয়া যাক।

জগন্নাথধামের প্রথম পৌরাণিক কাহিনী বলছে মহাভারতের যুদ্ধ শেষে দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের চরণকে পাখি ভেবে ভুল করে এক শবর বাণ মেরেছিল, যার ফলে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর দেহ সৎকারের পর যখন নাভিদেশ পুড়ছিল না, তখন দৈববাণী অনুসারে অর্জুন সেই নাভিদেশ সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন। সমুদ্রে ভেসে চলা সেই নাভি দেখে সমুদ্রের তীর ধরে সেই শবর ছুটতে ছুটতে দ্বারকা থেকে পুরী চলে আসেন। তারপর শ্রীকৃষ্ণ তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাঁর নাভিদেশ সমুদ্র থেকে তুলে নিতে বলেন। সঙ্গে এও জানান তিনি সেই শবরের বংশধরদের হাতে নীলমাধব রূপে পূজিত হবেন। সেই থেকে শবরেরা বংশপরম্পরায় নীলমাধবের পূজা করে থাকে।

কলিযুগে বিষ্ণুভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন দেব তৎকালীন পুরীতে বিষ্ণুর আরাধনার জন্য জগন্নাথধাম গড়ে তুলল। বিষ্ণুর রূপ নীলমাধবকে এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য সে তার রাজ্যের চারদিকে লোক পাঠাল। তাদের মধ্যে একজন ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি নীলমাধবকে খুঁজতে গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলে। সেখানে শবররাজ বিশ্ববসুর কন্যা ললিতা তাকে উদ্ধার করে। দুজন দুজনকে ভালবেসে বিয়েও করে নেয়। বিয়ের পর বিদ্যাপতি জানতে পারে রোজ সকালে তার শ্বশুরমশাই শবররাজ বিশ্ববসু জঙ্গলের মধ্যে গোপনে নীলমাধবের পূজা করে। নীলমাধবকে দেখার জন্য শ্বশুরকে অনুরোধ করে সে। বিশ্ববসু তাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাবে বলে যাতে রাস্তার সন্ধান সে না পায়। কিন্তু বিদ্যাপতি চোখ বাঁধা অবস্থায় যাওয়ার সময় গোটা পথে সরষের দানা ছড়াতে ছড়াতে যায় যাতে পরে সে পথের সন্ধান পেতে পারে। তারপর নীলমাধবের দর্শনে সে মুগ্ধ হয়ে যায়। ফিরে এসে সে রাজার কাছে খবর পৌঁছে দিলে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন নীলমাধবকে আনতে যায়। কিন্তু সেখানে পৌঁছনোর পরও নীলমাধবকে পায় না। তখন দৈববাণী হয় যে সমুদ্রের জলে একটি কাঠ ভেসে আসবে যা থেকে বিগ্রহ বানাতে হবে। সেই অনুযায়ী কাঠ ভেসে এলেও সেই কাঠ কেউ তুলতে পারে না। অবশেষে কাঠের একদিক শবররাজ বিশ্ববসু আর অন্যদিক তার জামাই বিদ্যাপতি ধরে তুলে আনতে সক্ষম হয়। তারপর রাজা তার কারিগরদের মূর্তি বানাতে বলে। কিন্তু সেই কাঠ এমনই পাথরের মত শক্ত যে ছেনি, হাতুড়ি সবই ভেঙে যায়। তখন স্বয়ং বিশ্বকর্মা কারিগরের বেশে রাজার কাছে আসেন। অন্যমতে বলা হয় স্বয়ং জগন্নাথ আসেন রাজার কাছে। তিনি শর্ত রাখেন ২১ দিন দরজা বন্ধ করে তিনি মূর্তি গড়বেন। কেউ যেন তাঁকে বিরক্ত না করে। তিনি নিজে দরজা না খুললে কেউ যেন তাঁর ঘরে না আসে। রাজা মেনে নিলে তিনি দরজা বন্ধ করে কাজ শুরু করেন। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের রানী গুন্ডিচা রোজই বন্ধ দরজায় কান পেতে কাঠ কাটার ঠক্ ঠক্ শব্দ শোনেন। একদিন রানী শব্দ শুনতে না পেয়ে রাজাকে জানায়। তারা কৌতূহলবশত দরজা খুলে দেখেন কারিগর উধাও এবং তিনটি অসমাপ্ত মূর্তি পড়ে আছে। মূর্তির হাত,পা কিছুই গড়া হয়নি। তখন রাজা ও রানী দুঃখে ভেঙে পড়লে রাজাকে স্বপ্ন দিয়ে জগন্নাথ বললেন এই রূপেই তিনি পূজিত হতে চান। বিশ্বাস করা হয় সেই থেকেই জগন্নাথের মূর্তি ওভাবেই পূজিত হয়ে আসছে।

আরও একটি জগন্নাথধামের পৌরাণিক কাহিনী আছে। বৃন্দাবনে একদিন গোপীরা সুভদ্রাকে দরজায় পাহারা দিতে বলে কৃষ্ণকে নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তাঁরা সুভদ্রাকে পাহারায় রেখেছিলেন যাতে তাঁদের আলোচনার সময় কৃষ্ণ এলে সুভদ্রা তা জানিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু তাঁদের আলোচনায় সুভদ্রা নিজেই এত মুগ্ধ ও রোমাঞ্চিত হয়ে যান যে দাদা কৃষ্ণ বলরামকে আসতে দেখেননি। এদিকে কৃষ্ণ বলরামও গোপীদের কাহিনী শুনে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠেন। তিন ভাইবোনেরই চুল খাড়া হয়ে ওঠে, হাত গুটিয়ে আসে এবং চোখ বড়ো হয়ে যায়। তাই বৈষ্ণবরা এই রূপেই তাঁদের পুজো করে থাকেন।

তথ্যসূত্র


  1. প্রচলিত জনশ্রুতি
  2. https://eisamay.indiatimes.com/
  3. https://bengali.news18.com/
  4. https://www.kolkata24x7.com/

One comment

আপনার মতামত জানান