মলয় রায়চৌধুরী (Malay Roy Choudhury) বাংলা সাহিত্য জগতে বিখ্যাত হয়ে আছেন মূলত হাংরি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। বাংলা সাহিত্যের পটভূমিতে যত রকমের সাহিত্য আন্দোলন ঘটেছে, সেই সব আন্দোলনগুলির মধ্যে অন্যতম হাংরি জেনারেশন আন্দোলন৷ জিওফ্রে চসারের ‘In Sowre Hungry Tyme’ বাক্য থেকে ‘হাংরি’ শব্দটি বেছে নিয়েছিলেন তিনি৷ হাংরি আন্দোলনের সাথে যুক্ত কবি সাহিত্যিকদের ‘হাংরি জেনারেশন’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়। মলয় রায়চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের হাংরি আন্দোলনের একজন উল্লেখযোগ্য কর্মী হিসেবে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি, কবি,গল্পকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, নাট্যকার, চিন্তাবিদ হিসেবেও সমান জনপ্রিয় ৷
১৯৩৯ সালের ২৯ অক্টোবর বিহারের পাটনায় জন্ম হয় মলয় রায়চৌধুরীর ৷ মলয় রায়চৌধুরীর বাবা রণজীৎ রায়চৌধুরী পাটনার নামকরা ফটোগ্রাফার ছিলেন৷ মলয় রায়চৌধুরীর মা অমিতা দেবী উচ্চবিত্ত, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বড় হওয়া বিশিষ্ট পরিবারের মহিলা, উনিশ শতকের নবজাগরণের সাথে যে পরিবার সরাসরি যুক্ত ছিল৷ কলকাতার জন্মের পিছনে যে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের অবদান রয়েছে, সেই পরিবারের বংশধর মলয় রায়চৌধুরী৷ তাঁর বড় দাদার নাম সমীর রায়চৌধুরী, তিনিও হাংরি আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন৷
মলয়ের ছোটবেলা কেটেছে বাংলার বাইরে, বিহারের পাটনায়, দলিত ও শিয়া মুসলিম সম্প্রদায় অধ্যুষিত অঞ্চলে৷ তিন বছর বয়সে মলয় রায়চৌধুরীকে আঞ্চলিক ক্যাথলিক স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়৷ তিনি পরবর্তী সময়ে কলকাতায় এসে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলে ভর্তি হন৷ সম্ভবত ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি’- ই ছিল ভারতবর্ষের প্রথম প্রাইভেট স্কুল বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে পড়াশুনো করানোর জন্য তৈরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ ভাবে ব্রাহ্ম সমাজ দ্বারা পরিচালিত হত৷ ছোট মলয় এই স্কুলেই প্রথম পরিচিত হন বাংলা এবং সংস্কৃত ভাষার সাথে, স্কুলের ছাত্রী এবং গ্রন্থাগারিক নমিতা চক্রবর্তী তাঁকে সংস্কৃত ও বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী সাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন৷ বিদ্যালয়ের পরিমন্ডলে কড়া ভাবে ধর্মীয় শিক্ষা ও আচার আচরন নিষিদ্ধ ছিল৷ মলয়ের মতে, সেখান থেকেই তাঁর মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাভাবনার বীজ বপন করা হয়েছিল৷
মলয় রায়চৌধুরী মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও, ইংরাজী, হিন্দি, মৈথিলীতে অনর্গল কথা বলতে পারেন৷ শিয়া মুসলিম প্রতিবেশীর থেকে তিনি গালিব, ফৈজি সম্পর্কে পরিচিত হয়েছিলেন৷ এর পাশাপাশি তুলসী দাসের লেখা রামচরিত মানস, কবির, দাদু, রহিমের মতন সন্ত কবিদের দোঁহা, কাব্য রসের স্বাদ নিয়েছিলেন৷
উচ্চ বর্ণের, বিত্তশালী পরিবারের ছেলে হয়েও সমাজের প্রান্তিক মানুষের সাথে ছিল তাঁর অবাধ যোগাযোগ৷ এই যোগাযোগ, জিজ্ঞাসা, তাঁর কর্মকান্ড ও জীবনবোধকে প্রভাবিত করেছিল৷ তাই গ্রামীন এলাকার উন্নয়ণ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে উচ্চ শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন তিনি৷ পরবর্তী সময়ে ‘NABARD’(নাবার্ড)-এ চাকরী পাওয়ার সূত্রে খুব কাছ থেকে কৃষক, জেলে, তাঁতি, মৃৎশিল্পী, আলুর ফলনদার, মজদুর, ছুঁতোর প্রমুখ, ভারতীয় অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের, অবহেলিত, প্রান্তিক, চিরশোষিত ভারতীয়দের খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন৷
মলয় রায়চৌধুরীর পেশাগত জীবনের তুলনায় তাঁর সাহিত্য আন্দোলনের জীবন বর্ণময়, রঙীন, বৈচিত্র্যে ভরা। তাঁকে কেন্দ্র করে যে ভিন্ন ধারার সাহিত্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল, বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে তা ক্রমে একটি মাইল ফলক হয়ে ওঠে৷ ষাটের দশকের শুরুতে, বাংলায় সমাজের উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঘরের একদল তরুণ কবি, মেধায় ভরপুর , তাঁরা ভারতীয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রথাগত শিল্পের বিরোধীতা করতে শুরু করলেন৷ মলয় রায়চৌধুরীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পবোধ, সমাজবোধ, সাংস্কৃতিক বোধের বিপরীত স্রোতে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে শুরু করলেন৷ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিপ্লবের প্রাক্কালে, হাংরি আন্দোলন ক্রমে দৃঢ়, অন্তর্ভেদী এবং সুতীব্র হয়ে ওঠে৷ হাংরি আন্দোলন দেশলাই এর ছোট্ট আগুন শিখা থেকে শুরু হলেও,অল্প সময়ের মধ্যেই দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে৷ মলয় রায়চৌধুরীর সাথে, তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরী ছিলেন। এছাড়া দেবী রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় সহ আরো তিরিশ জন কবি যুক্ত হয়েছিলেন যাঁদের মধ্যে বিনয় মজুমদার, উৎপল কুমার বসু, রবীন্দ্র গুহ, ফাল্গুনি রায় প্রমুখ বিখ্যাত ছিলেন৷ হাংরি প্রজন্মের আন্দোলনের মূল নির্যাস ছিল ভারতীয় সাহিত্যের শুদ্ধিকরণ। ভারতীয় সাহিত্যের বা বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত সীমাবদ্ধ ও প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তার বাইরে বেরিয়ে হাংরি আন্দোলন কপটতা, ভন্ডামির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল৷ সমসাময়িক পঞ্চাশের দশকের কৃত্তিবাসী আন্দোলন যা মূলত কৃত্তিবাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল, হাংরি আন্দোলনের প্রভাব কৃত্তিবাস আন্দোলনকেও প্রভাবিত করেছিল৷
মলয় রায়চৌধুরী প্রায় সত্তরটির মতন বই লিখেছেন৷ বইগুলি সমসাময়িক আন্দোলনের দলিল বলা যায়৷ তাঁর লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক সাহিত্যিক আঙ্গিকে সম্পূর্ণ ভাবে স্বতন্ত্র বলা যায়। ১৯৬৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রায় এগারো জন হাংরি কবির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জাড়ি করে৷ মলয় রায়চৌধুরীর সাথে তাঁর দাদা এবং আরো কয়েজনকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে হাজির থাকতে হয়৷ মলয় রায়চৌধুরীদের বিরুদ্ধে অনেক কবি সাক্ষী দিয়েছিলেন। তাঁর কবিতা ” প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” এর জন্য, একমাস জেল খেটেছিলেন তিনি।
মলয় রায়চৌধুরী ২০০৩ সালে সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পান যা তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। মলয় রায়চৌধুরী ১৯৬২ সালের এপ্রিলে একটি ইস্তেহার প্রকাশ করেন। এই ইস্তেহারে তাঁর সাহিত্য আন্দোলন সৃষ্টির অন্তর্ভেদী দর্শন সম্পর্কে বলা হয়েছে। তাঁর কথায় – ‘মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র পরাজিত। কবিতাই এখন একমাত্র আশ্রয়।’ তিনি ‘শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এখন কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত’ বলে মনে করেছিলেন।
মলয় রায়চৌধুরী স্ত্রী শালিলাকে নিয়ে মুম্বাইতে বসবাস করেন৷ তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে৷ মলয় রায়চৌধুরির বিতর্কিত কবিতা “প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” অবলম্বনে ২০১৪ সালে মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায় এবং হায়াস তন্ময় স্বল্প সময়ের চলচ্চিত্র তৈরী করেন। সিনেমাটি বহু আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়েছে। পনেরোটি দেশের কুড়িটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অভিনন্দিত হয়েছে৷
এই ধরণের তথ্য লিখে আয় করতে চাইলে…
আপনার নিজের একটি তথ্যমূলক লেখা আপনার নাম ও যোগাযোগ নম্বরসহ আমাদের ইমেল করুন contact@sobbanglay.com এ
তথ্যসূত্র
- হাংরি জেনারেশনের স্রষ্টাদের ক্ষুধার্ত সংকলন – সম্পাদনা শৈলেশ্বর ঘোষ – সাহিত্য অকাডেমি , নিউ দিল্লী
- https://en.wikipedia.org/wiki/Malay_Roy_Choudhury
- https://www.anandabazar.com/calcutta/the-hungryalists-written-by-maitreyee-b-chowdhury-was-released-at-oxford-book-store-dgtl-1.943791
- https://en.wikipedia.org/
- https://www.poemhunter.com/

Pingback: লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী | সববাংলায়