মার্কো পোলো

মার্কো পোলো

ইতিহাসে এমন একেকজন বণিক অভিযাত্রীর হদিশ পাওয়া যায়, যাঁরা পরবর্তীদের জন্য রেখে গেছেন অমূল্য পথের সন্ধান, যাঁদের লেখায় প্রাচীন যুগ, সংস্কৃতির খুঁটিনাটি রয়ে গেছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে। তেমনই একজন কিংবদন্তি ভেনিসীয় পর্যটক ছিলেন মার্কো পোলো (Marco Polo)। সিল্ক রুট ধরে এশিয়া ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। এশিয়া মহাদেশে তাঁর পর্যটনের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন মার্কো পোলো, যা ইউরোপীয়দের কাছে রহস্যময় প্রাচ্যদেশীয় সংস্কৃতির ভান্ডারকে প্রথম খুলে ধরেছিল। মঙ্গোল সাম্রাজ্য, চীন, ভারত, জাপান, পারস্য ইত্যাদি এশীয় দেশগুলির বিস্তৃত তথ্য মার্কো পোলোর রচনায় উঠে এসেছিল। মার্কোকে কুবলাই খান তাঁর দরবারে স্থান দিয়েছিলেন এবং বিদেশি দূত হিসেবেও নিযুক্ত করেছিলেন৷ তাঁর লেখায় চীনের অভ্যন্তর যেভাবে উঠে এসেছিল, তার পূর্বে আর কখনও তেমনটা হয়নি।

১২৫৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ইতালির ভেনিস শহরে এক সমৃদ্ধ বণিক পরিবারে মার্কো পোলোর জন্ম হয়। তাঁর পিতা নিকোলো এবং তাঁর এক কাকা মাফিও, মার্কোর জন্মের বছরখানেক আগে এক বাণিজ্যিক অভিযানে চলে গিয়েছিলেন। মার্কোর মা নিকোল আনা ডিফুসেহ-এরও মৃত্যু হয়েছিল অল্পবয়সেই ফলে পিতামাতার অনুপস্থিতিতে কিছু আত্মীয়ের কাছে বড় হয়েছিলেন তিনি। কিছু ক্রোয়েশিয়ান সূত্র মার্কোর পূর্বপুরুষদের সুদূর ডালমাটিয়ান বংশোদ্ভূত বলে দাবি করে, কিন্তু অধিকাংশ ইতিহাসবিদ এটিকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, কারণ ৯৭১ সাল থেকেই মার্কোর পরিবার ভেনিসে বসবাস করছিল।

ভেনিস প্রজাতন্ত্রের আর্কাইভে মার্কো পোলোকে মার্কো পাওলো দে কনফিনিও সান্তি আইওহানিস গ্রিসোস্টোমি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর যে ডাকনামটি ছিল, তা হল, মিলিয়নে অর্থাৎ সহজ করে বললে মিলিয়ন, যা লক্ষ সংখ্যা বোঝায়। ১৫ শতকের মানবতাবাদী জিওভান্নি বাতিস্তা রামুসিওর মতে, কুবলাই খানের হয়ে কাজ করে যখন অবশেষে ভেনিসে ফিরে এসেছিলেন মার্কো, তখন তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে এই ডাকনামে ভূষিত করেছিল কারণ কুবলাই খানের সম্পদের পরিমাণ ছিল লক্ষাধিক। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, তাঁর ডাকনাম দেওয়া হয়েছিল মেসার মার্কো মিলিয়নি অর্থাৎ মিস্টার মার্কো মিলিয়নস। মার্কোর বাবা নিকোলোর ডাকনামও নাকি ছিল মিলিয়নে। অনেকে তাই মনে করেন অন্যান্য পোলো পরিবার থেকে নিকোলো এবং মার্কোর শাখাটিকে আলাদা করবার জন্য এই ডাকনামের ব্যবহার হয়েছিল।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

মার্কোর বাবা এবং কাকা নিকোলো এবং মাফিও প্রাচ্যদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন এবং অনেক প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলেন। মার্কো পোলোর বই থেকে জানা যায় নিকোলো এবং মাফিও নাকি কুবলাই খানের সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ১২৬৯ সালে বাণিজ্য থেকে ভেনিসে ফিরে আসেন নিকোলো এবং মাফিও। ফিরে এসে সেই প্রথমবার মার্কোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর বাবা নিকোলোর। এখানে বলা প্রয়োজন যে, ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত মার্কোর শৈশব সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না৷ তবে যে আত্মীয়ের কাছে মানুষ হয়েছিলেন তিনি, তাঁদের কাছে ভাল শিক্ষাই পেয়েছিলেন। জানা যায় যে, বিদেশি মুদ্রার মূল্যায়ন এবং পণ্যবাহী জাহাজ পরিচালনা শিখেছিলেন মার্কো। তবে লাতিন ভাষা খুব কম শিখেছিলেন।

১২৭১ সালে, যখন মার্কো পোলোর বয়স সতেরো বছর, তখন নিকোলো এবং মাফিওর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন তিনি নিজেও। ডোগে লরেঞ্জো টাইপোলোর শাসনামল তখন। তাঁরা তিনজন এশিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন এবং এই দুঃসাহসিক ও রোমাঞ্চকর অভিযানের কথা পরবর্তীকালে লিপিবদ্ধ করে রাখেন মার্কো। প্রথমে তাঁরা ইজরায়েলের উত্তর জেলার একটি অঞ্চল একর বা আক্কায় গিয়ে পৌঁছন। সেখান থেকে তাদের উট নিয়ে স্থলপথে চলে যান পারস্য বন্দর হরমুজে। যাত্রার প্রথম পর্যায়ে, তারা একরে কয়েক মাস অবস্থান করেছিল এবং পিয়াসেঞ্জার আর্চডেকন টেডালডো ভিসকন্টির সাথে কথা বলতে সক্ষম হয়েছিল। দীর্ঘদিন পোপের পদ শূন্য থাকার কারণে তাঁরা দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। অবশ্য ভ্রমণের সময়তেই ৩৩ মাস পর নতুন পোপ নির্বাচনের খবর পেয়েছিলেন তাঁরা।

যাইহোক, হরমুজ বন্দরে মার্কোরা মনের মতো কোনো জলযান না পাওয়ায় ঠিক করেছিল স্থলপথের বণিকদের পথ ধরেই যাবেন। এই পথই ১৯ শতকে সিল্ক রুট নামে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছিল। পরবর্তী তিন বছর তাঁরা মরুভূমি, উঁচু পাহাড়ি গিরিপথ এবং অন্যান্য রুক্ষ ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ট্রেক করে গিয়েছিলেন, পথে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির লোকেদের সাথে দেখা হয়েছিল তাঁদের। পারস্য, আর্মেনিয়া, আফগানিস্থান এবং পামির পর্বতমালা অতিক্রম করে, গোবি মরুভূমি পেরিয়ে তাঁরা চীনের কুবলাই খানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। অবশেষে ১২৭৫ সালে মার্কোরা আধুনিক বেইজিং-এর শাংদুতে কুবলাই খানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ জানাদুতে পৌঁছন। তিনজনকেই সম্রাটের দরবারে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং তিনজনই চীনা ভাষা ও সংস্কৃতিতে নিমগ্ন হয়েছিলেন।

অন্যদিকে কুবলাই খান, যিনি সাধারণত তার সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য বিদেশীদের উপর নির্ভর করতেন, মার্কো পোলোকে তাঁর দরবারে নিয়ে যান, সম্ভবত একজন কর আদায়কারী হিসাবে। মার্কোর বুদ্ধিমত্তা এবং নম্রতায় মুগ্ধ হয়ে কুবলাই খান তাঁকে ভারত ও বার্মায় বিদেশী দূত হিসেবে নিযুক্ত করেন, ফলে মার্কো পোলোর কাছে এশিয়া ভ্রমণের সুযোগ এসে যায়। একে একে তিনি তিব্বত, বার্মা, ভারত দেখতে থাকেন এবং সম্ভবত মার্কো পোলো-ই প্রথম ইউরোপীয় যিনি এই দেশগুলিতে ভ্রমণ করেছিলেন। মার্কোকে কুবলাই খান তাঁর সাম্রাজ্যজুড়ে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় (বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম) অনেক কূটনৈতিক মিশনে পাঠিয়েছিলেন।

সম্রাটের প্রতি তাঁর সেবা ছিল অনুকরণীয়; ফলস্বরূপ, তিনি একটি চীনা শহরের গভর্নরের উপাধি পেয়েছিলেন এবং সম্রাটের পরিষদে একটি আসন অর্জন করেছিলেন। ১৭ বছর চীনদেশে বসবাসের ফলে প্রচুর সম্পত্তিও অর্জন করেছিলেন তাঁরা।

কুবলাই খান প্রাথমিকভাবে বহুবার মার্কো পোলোদের ইউরোপ প্রত্যাবর্তনের আবেদন খারিজ করে দিয়েছিলেন, কারণ কুবলাই খানের কাছে তাঁরা প্রায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন৷

অবশেষে তাঁরা কুবলাই খানের কাছে এক রাজকুমারীকে বিবাহের জন্য মোঙ্গল শাসক আরঘুনের কাছে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন। ১২৯২ সালে জাইতুন (বর্তমানে চীনের কোয়ানঝো) থেকে ১৪টি নৌকো সহযোগে রাজকুমারীর সঙ্গে যাত্রা করেন মার্কোরাও। সুমাত্রায় সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য থামেন তাঁরা এবং ১৮ মাস পর পারস্যে অবতরণ করে জানতে পারেন আরঘুনের মৃত্যু হয়েছে। তখন আরঘুনের ছেলের সঙ্গে সেই রাজকুমারীর বিবাহ হয়েছিল। মার্কোরা আরঘুনের ভাইয়ের সঙ্গে নয়মাস কাটিয়ে তারপর ট্রেবিজন্ড (বর্তমানে তুরস্কের ট্রাবজন), কনস্টান্টিনোপল এবং নেগ্রেপন্ট (বর্তমানে গ্রীসের ইউবোয়া) হয়ে ১২৯৫ সালে ভেনিসে ফিরেছিলেন।

১২৯৫ সালে মার্কোরা যখন ফিরে আসেন, তখন ভেনিস জেনোয়া প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ভেনিসের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী জেনোয়াদের দ্বারা যুদ্ধের সময় বন্দী হন মার্কো পোলো। তিনি সম্ভবত ১২৯৬ সালে আদানা এবং আলেকজান্দ্রেটা উপসাগরের মধ্যে আনাতোলিয়ান উপকূলে একটি সংঘর্ষে জেনোয়ানদের হাতে ধরা পড়েছিলেন। কারাগারে থাকাকালীন তিনি অ্যাডভেঞ্চার লেখক রুস্টিচেলো দা পিসার সাথে পরিচিত হয়েছিলেন এবং ১২৯৮ সালে তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে ‘ডেসক্রিপশন অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ পান্ডুলিপির কাজ করেন। এটিই পরবর্তীকালে ‘দ্য ট্রাভেলস অফ মার্কো পোলো’ নামে অতি জনপ্রিয় ও বিখ্যাত হয়ে ওঠে। ১২৯৯ সালে একটি জেনোজ-ভেনিসিয়ান শান্তিচুক্তি মার্কো পোলোকে দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়। এরপরে সম্ভবত আর কখনও ভেনিস ছেড়ে বেরোননি তিনি। ফিরে এসে তিনি বাবা এবং কাকার গড়ে তোলা কোম্পানি ও ব্যবসা দেখেন এবং খুব শীঘ্রই একজন ধনী ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। ১৩০০ সালে ভিটালে বাডোয়ের নামক এক বণিকের কন্যা ডোনাটা বাডোয়েরকে বিবাহ করেন মার্কো পোলো। তাঁদের তিনটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছিল।

মার্কো পোলোর ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে ইউরোপীয় সমাজের কাছে প্রাচ্যদেশের রহস্য অনেকটাই উন্মোচিত হয়ে গিয়েছিল। সেখানকার সংস্কৃতির অনুপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যাবে সেই বইতে। অনেকে অবশ্য মার্কোর চীন ভ্রমণকে সন্দেহের চোখে দেখেন কারণ তাঁর বর্ণনার মধ্যে চীনের প্রাচীর সম্পর্কে কোনও উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না। তবে মার্কো পোলোর চীনের বিবরণ সেই সময়ের অন্যান্য ভ্রমণকারীদের বিবরণের তুলনায় যে খুবই সঠিক এবং বিশদ তার প্রমাণ রয়েছে বইটির মধ্যেই। মাঝে মাঝে তিনি অন্যান্য ইউরোপীয় বিবরণে প্রদত্ত ‘আশ্চর্যজনক’ কল্পকাহিনী এবং কিংবদন্তিগুলিকেও খণ্ডন করেছিল। লবণ উৎপাদন, রাজস্ব, কাগজের টাকা, চীনামাটির বাসন, বারুদ, কয়লা ইত্যাদি প্রাচ্যদেশীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনের বিস্তারিত বর্ণনা ইউরোপের সামনে তুলে ধরেছিল মার্কো পোলোর গ্রন্থটি। তৎকালীন এশীয় প্রকৃতির একটি চমৎকার নথি হয়ে রয়েছে এই বই। এছাড়াও কুবলাই খানের দরবার, সেখানকার রীতিনীতিরও বিশদ বর্ণনা পাওয়া যাবে বইটিতে। আশ্চর্য এই ভ্রমণকাহিনীটি মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের আগে লিখিত এবং পন্ডিতরা হাতে হাতে এটির কপি করেছিলেন। এই গ্রন্থ পরবর্তীকালে ক্রিস্টোফার কলম্বাসকেও অনুপ্রাণিত করেছিল।

১৩২৩ সালে অসুস্থ হয়ে মার্কো পোলো বিছানায় বন্দী হয়ে ছিলেন। অবশেষে চিকিৎসকদের প্রভূত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ১৩২৪ সালের ৮ জানুয়ারি ভেনিসে এই কিংবদন্তি বণিক, পর্যটক ও লেখক মার্কো পোলোর মৃত্যু হয়।

One comment

আপনার মতামত জানান