মেচেদা

মেচেদা

পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত পূর্ব মেদিনীপুর জেলার একটি অন‍্যতম প্রসিদ্ধ ইতিহাস বিজড়িত জনপদ হল মেচেদা (Mecheda)। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লকের অধীনে রয়েছে এই মেচেদা জনপদটি।

ভৌগোলিক দিক থেকে দেখলে মেচেদা ২২.৪০° উত্তর অক্ষাংশ ও ৮৭.৮৫° পূর্ব দ্রাঘিমাংশের অন্তর্গত। এই অঞ্চলের উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে বয়ে গিয়েছে রূপনারায়ণ নদী। মেচেদার নিকটবর্তী স্থান হিসেবে রয়েছে হলদিয়া, কোলাঘাট, তমলুক, দিঘা, কন্টাই ও এগরা। কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও হলদিয়া শিল্পাঞ্চল মেচেদাকে যাতায়াতের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ করেছে। এই অঞ্চলের মানুষ এখান থেকে সহজেই কলকাতা এবং খড়গপুরে যাতায়াত করতে পারে

কাকডিহি, শান্তিপুর, গুলড়িয়া, আন্দুলিয়া, বড়গাছিয়া, শ্রীকৃষ্ণপুর, রামচন্দ্রপুর এই গ্রামগুলি সবই মেচেদার অন্তর্গত। বলে রাখা প্রয়োজন যে, মেচেদা শহর ও মেচেদা গ্রাম দুটি আলাদা আর এই শহর ও গ্রামের মধ্যে দেড় কিলোমিটারের দূরত্ব রয়েছে।

মেচেদার আঞ্চলিক ইতিহাসের দিকে তাকালে জানা যায়, এই অঞ্চলটি একসময় নিচু জলাভূমি দ্বারা বেষ্টিত ছিল। একে চলতি কথায় বলা হত ‘দহ’। গাছ-গাছালিতে ভরা এই সব জলাভূমিতে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়ার দরুণ এই অঞ্চলকে প্রথমে মাছের দহ বলা হত। পরে সেই থেকেই প্রথমে মেছো দহ, তারপরে মেছোদা, ক্রমে মেছেদা থেকে সর্বশেষ লোকমুখে ‘মেচেদা’ নামকরণ হয় এই জনপদের। 

জনপদটির ইতিহাসে দেখা যায় বর্ধমান রাজার অধীনে মঙ্গল ঘাট পরগণার অন্তর্গত ছিল এই মেচেদা অঞ্চল। সেই সময় এই মেচেদা গ্রামের দুটি অংশ ছিল কিসমত মেছেদা এবং মেচেদা যা কিনা দুজন পৃথক জমিদারের অধীনে ছিল। যদিও পরে এই মেচেদা গ্রাম মৌজা হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পায়। সেই সময় মেছেদা গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই ছিল কৃষিজীবী। ১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ আমলে বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ে কোম্পানি হাওড়া থেকে খড়গপুর পর্যন্ত নতুন রেললাইন তৈরির সময় হাওড়া থেকে কোলাঘাট হয়ে খড়গপুরের সঙ্গে সংযুক্ত করার মাঝে মেচেদার উপর দিয়ে লাইন গড়ে তোলা হয়। মেছেদা গ্রামের উপর দিয়ে এই রেললাইন গড়ে ওঠার কারণে গ্রামটি দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। বর্তমানে যে অঞ্চলটি ঘুঘুপোল নামে পরিচিত সেটি ঐ তখনই গড়ে উঠেছিল মূলত গ্রামের দুটি অংশের মধ্যে সুষ্ঠু জলনিকাশির সুবিধের জন্য। আজ যে অঞ্চলের নাম মেছেদা পুরাতন বাজার তার আগেকার নাম ছিল হরির হাট বা বটতলার বাজার। মেছেদা গ্রামের সংলগ্ন কাকডিহি গ্রামের বটতলায় বসত এই বাজার। ১৯০১ সালে মেছেদা গ্রামের দেড় কিলোমিটার পশ্চিম দিকে গুড়ুলিয়া আর বাড়বহলা গ্রামের মাঝে আধুনিক মেচেদা রেলস্টেশনটি গড়ে ওঠে। জানা যায় গোবিন্দ সামন্ত নামে এই এলাকার জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে ব্রিটিশ অধিকর্তাদের ঘনিষ্ঠতার সুবাদেই নাকি এই অঞ্চলের উপর দিয়ে রেললাইন বসানো হয়েছিল আর তার ফলেই পুরো জনপদের চরিত্রটাই ধীরে ধীরে বদলে যায়। রেললাইন বসার পরে অধিকাংশ কৃষিজীবী মানুষ রেলের দপ্তরে চাকরি পান। ১৯৬০ সালে মেচেদা স্টেশন থেকে তমলুক পর্যন্ত বাস চলাচলের রাস্তা তৈরি হয়। এরপর ধীরে ধীরে সমস্ত এলাকার বাস চলাচল শুরু হয় এই অঞ্চল থেকে,গড়ে ওঠে মেচেদা সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড। ১৯৭৩ সালে কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য মেছেদা গ্রামের অধিকাংশ কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে নেওয়া হয় যার ফলে কৃষিকাজকে পেশা করে বেঁচে থাকা মানুষের সংখ্যা একেবারে কমে যায়। বর্তমানে কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উত্তর দিকে রয়েছে সেই মেছেদা গ্রাম, কিন্তু তার অবস্থা একেবারেই অনুন্নত। স্থানীয় লোকদের কথায় কিছুদিন আগে পর্যন্তও এই অঞ্চলে হোগলার বন দেখা যেত। মেচেদা বাজারের প্রগতির ছায়াও পড়েনি যেন এই মেছেদা গ্রামে। মেছেদা গ্রামের বাসিন্দারা নিজের অস্তিত্বকে পৃথক করতে অনেকসময় নিজেদের গ্রাম মেচেদার বাসিন্দা বলে থাকেন। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে ওঠার পরে মেচেদা বাজার ক্রমে ক্রমে আরও জমজমাট হয়ে উঠেছে। আশির দশক থেকে নগরায়ণের হাওয়া লাগে মেচেদায়, তা ধীরে ধীরে একটি পরিকল্পিত উপনগরীর চেহারা নেয়।

তমলুকের সঙ্গে সংযোগকারী মেচেদার রিচার্ডসন রোড একসময় গড়ে উঠেছিল রিচার্ডসন সাহেবের নামানুসারে। প্রথমে তা ছিল মাটির রাস্তা, পরে সেখানেই পাকা রাস্তা হয় এবং তা দিয়ে বাস চলাচল শুরু হয়।

এই জনপদের শিক্ষার দিকে তাকালে দেখা যায় মেচেদায়  বহু স্কুল রয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কে.টি.পি.পি হাই স্কুল, কোলা ইউনিয়ন হাই স্কুল, গোপালগঞ্জ প্রিয়নাথ বাণীভবন (উ.মা.), রামচন্দ্রপুর হাই স্কুল, শান্তিপুর শিশু শিক্ষা নিকেতন, হাকোলা হাই স্কুল, বরনান হাই স্কুল, ছাত্রকুঞ্জ রানি বাণী ভবন ইত্যাদি। তাছাড়া এখানে একটি ডিগ্রি কলেজও রয়েছে আর একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রয়েছে যার নাম কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, কোলাঘাট। ১৯৯৮ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তথা জনৈক শিক্ষাবিদ শঙ্কর সেনের চেষ্টায় এই কলেজটি গঠিত হয়েছিল যা প্রথমে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ছিল। পরবর্তীকালে ২০০১ সালে ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি গঠিত হলে এই প্রতিষ্ঠানটিও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলির মত এক ছাদের নিচে চলে আসে।

মেচেদায় প্রায় সব উৎসবই পালন করা হয়। দুর্গাপূজা ও কালীপূজা বেশ ধুমধাম করে পালিত হয় এখানে। এছাড়া এখানকার স্থানীয় ইস্কন মন্দিরে রথযাত্রা উৎসব মেচেদার সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

মেচেদার আলুর চপ আর ভেজিটেবল চপের খ্যাতি ছড়িয়ে আছে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। মেচেদা থেকে প্রকাশিত হয় এমন বহু পত্রিকা আছে। যেমন ‘ঋতুপাঠ’, ‘ভাষামৃগ’। এখানে একটি স্পোর্টস ইউনিট রয়েছে যা ‘মেচেদা স্পোর্টস ইউনিট’ নামে পরিচিত। এছাড়াও ক‍্যালচারাল অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। দেখতে গেলে এই অঞ্চলটি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সক্রিয়।

মেচেদার বাসিন্দারা বেশিরভাগই কৃষির ওপর নির্ভর ছিল একসময়। তারপর তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র ও রেলস্টেশন গড়ে ওঠার ফলে বহু মানুষ এই সমস্ত ক্ষেত্রগুলিতে চাকুরীরত হয়। এখানে মাছ ও পানের বেশ বড় বাজার রয়েছে। এই অঞ্চলে পান চাষ বেশ লাভজনক। মেচেদার স্থানীয় বাজার ‘হরির হাট’ বা বটতলার বাজার বেশ প্রসিদ্ধ।  এই বাজারে মাছ, পান, সবজি আর ফুলের ব্যবসা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এর পাশাপাশি এখানে গড়ে উঠেছে সিমেন্ট কারখানাও।

সাম্প্রতিককালে মেচেদার সৌরভ পাঁজা  সাবানের ওপর সর্বাধিক ভাস্কর্য‍ তৈরি করে ‘ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডস’ (India Book of Records) করেছেন।

এখানকার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে স্থানীয় ইস্কন মন্দির, বুড়া শিব মন্দির আর রয়েছে অ্যাশ পুকুর (Ash pond)। মেচেদা থেকে পরিবহন ব্যবস্থার সুবিধা থাকায় নানা স্থানে ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে।

মেচেদা পূর্ব মেদিনীপুরের এমন একটি অঞ্চল যা সময়ের সাথে সাথে গ্রাম থেকে শহরাঞ্চলে পরিণত হচ্ছে। এছাড়া ধীরে ধীরে কল-কারখানা, বহুতল গড়ে উঠছে,যা এটিকে শহরে পরিণত করছে। প্রগতি আর নগরায়ণের হাওয়ায় মেচেদা এখনও ক্রম-অগ্রসরমান।

আপনার মতামত জানান